–slotonline–motobolaslot – বিতর্কঃ সাহিত্যে অশ্লীলতার প্রয়োগ, লিখেছেন – ভজন দত্ত

আয়োজক সম্পাদককে বলেছিলাম, আমাকে ভাই এ খেলায় নিও না। এখানে রেফারি নেই, এত এত ফাউল,তলপেটে লাথ, লালকার্ড হাতে কেউ নেই। বংশীধর হয়ে বসে আছেন সব।মালটি হাতে নিয়ে বসে আছেন, সুযোগ পেলেই আছুলা বা ছুলা ভরে দেবেন।রক্ষাকর্তা বা কালী কেউ নেই।কেউ কি নেই? আছেন, আছেন। আছেন বইকি। মননশীল পাঠক আছেন, সেই সব পাঠকদের শ্রদ্ধা। প্রিয় পাঠক, আপনারাই তো শ্রেষ্ঠ বিচারক।পক্ষ তো দুটি। শুক্ল ও কৃষ্ণ। বাদী আর বিবাদী। থুড়ি থুড়ি।আদালত নয়। এটা বিতর্ক। ফরমানে, কোন একটিকে বেছে নেওয়া ছাড়া আমার বিকল্প নেই। তা না হলে, নিজেকে মধ্যপন্থি বলতে পারলেই ভালো হত। কিন্তু সে অপশন নেই। তাই বাধ্য হয়েই একপক্ষের হয়ে বলতে গেলে, বলি, আমি পারি না লেখায় অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করতে, ব্যবহার করতে। কারণ, সে সৎ বা অসৎ, সাহস বা দুঃসাহস কোনটাই আমার নেই। কিন্তু আমি এর পক্ষেই আছি।
কোনটি শ্লীল আর কোনটি অশ্লীল তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে এই বিতর্ক তো আজকের নয়! এই যে পাতাল রেলের ঘটনা নিয়েই ভাবুন না।দেখুন সেই শ্লীল ও অশ্লীল বিভাজনের খেলা। এ খেলা চলছে, চলবে। যতদূর মনে পড়ছে,সমরেশ বসু (প্রজাপতি), বুদ্ধদেব বসু (রাতভর বৃষ্টি) কে লেখার জন্য একসময় আদালতের মামলায় জড়ানো হয়েছিল।অবশেষে অশ্লীলতার দায় থেকে তাঁরা অব্যাহতি পেয়েছিলেন আদালতের রায়ে। বিশাল ব্যবসা করেছিল বই দুটি। কিন্তু সে সময় তার থেকেও আরো রগরগে লেখাপত্র অনুবাদ সাহিত্যের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গণে জোরকদমে ঘোরাঘুরি করছে জেমস হেডলি চেজের সব উপন্যাস, নবোকভ-র ললিতা- র মতো মশলাদার সব উপন্যাস। লুকিয়ে চুরিয়ে চটির রমরমা তো সব কালেই, শোনা যায়, তা ভালো ব্যবসাও করে। ‘ঘোমটার তলায় খ্যামটা’ ছিলই। জানি না এক, দেড় জিবির ‘ফিরি’ নেটের ভারতে এখনো চটির সেই বাজার আছে কি না? যদিও সেগুলিকে এই সমাজ কিন্তু সাহিত্যের মর্যাদা দেয়নি।সাহিত্যে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে এই ধারা। অর্থাৎ যা কিছু একান্ত গোপন তা পাঠকদের সামনে উপস্থিত করার ধারা বহু প্রাচীন।আদিরসাত্মক রচনার প্রতি মানুষের আকর্ষণের ইতিহাসও আদি। তা ছিল, আছে, থাকবে।তা নিয়ে বিতর্ক করা তো অনর্থক সময় অপচয় করা।বিকৃত এক মানসিকতার জন্মদানে সেগুলির ভূমিকা নিয়ে আলোচনাও হয়। আমার সেসব নিয়ে কোন বক্তব্য নেই। আলোচনা শুধুমাত্র সমাজ-স্বীকৃত সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
এই ধরুন রামায়ণে সীতাহরণ, মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ।পাঠক একবার ভাবুন শ্লীল থেকে অশ্লীলে যাওয়ার সব উপাদান সেখানে আছে। কিন্তু বাল্মীকি বা ব্যাসদেব, উভয়ের কেউই সে পথ মাড়াননি।এখন কোন লেখক বা পাঠক যদি ঐ দুটি দৃশ্যপট নিজের মনের মত করে লেখেন, রিকনস্ট্রাকশন করেন,মনের ভেতর নিজের মত করে সাজান আর অশ্লীল অশ্লীল করে চিৎকার করেন, তবে তা করতেই পারেন।নেটদুনিয়ায় এখন সহজলভ্য নির্মম ধর্ষণ দৃশ্যের ভিডিও দেখে,সংবাদ পাঠ করে বা কোন গল্পে বা উপন্যাসে অনুরূপ একটি ঘটনা পাঠ করে কেউ যদি যৌণ উত্তেজনা অনুভব করেন তবে কি আমরা লেখককে দোষ দেব, বলুন? আর যে সমাজে ধর্ষণ হচ্ছে সেই সমাজকে কি আমরা শালগ্রামশিলার মত মাথায় করে রাখবো? আমরা কি বলবো, লেখকরা সব “এরম ওরম ” লেখে বলেই সমাজ উচ্ছন্নে যাচ্ছে? আর আমাদের দেশে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে কথাটা ভাবুন। একজন লেখকের একটি বই এখন কত কপি ছাপা হয়? কতজন কেনেন সে বই? বড় বড় বাণিজ্যিক সংস্থা গুটিকয় আছে তাদের কথা বাদ দিলে, অভিজ্ঞতা থেকে জানি, একজন লেখকের কবিতার বই ২০০-৫০০, খুব জোর ১০০০, গল্পের, প্রবন্ধের ও অন্যান্য বইয়ের পরিমাণও কমবেশি ঐ। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যাকে বই সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই তো জানা যাবে কতজন মানুষ সে বইটি পড়েন।এই হিসেবে, কলেজস্ট্রিটের ফুটপাথে পাঁচ টাকায় কবিতার বই বিক্রি হওয়ার হিসেব ধরলেও তাই হবে।কেননা ছাপার সংখ্যা তো ঐ।কাজেই সেসব বইয়ের সমাজ কে প্রভাবিত করার সুযোগ কম। হ্যাঁ, তবে সেসব লেখা থেকে লেখকদের কয়েকজন প্রভাবিত হবেন, সেটা গ্যারান্টি। কারণ, অধিকাংশ লেখকরাই ওইসব বইয়ের পাঠক। আর তারাই নাকি এব্যাপারে বেশি চিৎকার করেন।
কিছু লেখা , নামী লেখকদের কথা বলছি। তাঁদেরকে অনুরোধে বা আদেশে কখনো কখনো লিখতে হয়। সেইসব লেখায় ‘ফড়ং’ দিতেই হয়। আর সাঁতলানোর শব্দটি আগেই সম্ভাব্য পাঠকদের মগজে ঠুসে দেওয়ার নামই বর্তমান বিপনন কৌশল। এটাই চলছে বিগ পাব্লিশিং হাউসে। তারা লেখকদের মাইনে দিয়ে রাখেন, লেখা ছাপার জন্য টাকা দেন।তারা তো আর সমাজসেবা করার জন্য প্রকাশন সংস্থা খোলেন নি। তারা পরিষ্কার, ব্যবসা করেন। তাদের উদ্দেশ্য লাভ করা। আর যত বেশি ক্রেতা, ততবেশি বিজ্ঞাপণ, ততবেশি ছাপা, ততবেশি মুনাফা। পাঠক ভাবুন, কিছুদিন আগেও মহালয়াকে লক্ষ্য করে বানিজ্যিক শারদ সংখ্যাগুলি প্রকাশিত হত। আর এখন, পুজোর প্রায় ৫০-৬০ দিন আগেই প্রকাশিত হয়ে যায় ঐসব পত্রিকা।বাজার। বাজার একটা বড় ব্যাপার তাদের কাছে। তাই বাজারের উপকরণ সেখানে কিছু রাখতেই হয়। বিশেষ বিশেষ উদ্যেশ্য পূরণের জন্য এই যে অপ্রয়োজনীয় অশ্লীলতা আমদানি করা হয় যেখানে, সেখানে সচেতন পাঠকরা জানেন কী করতে হয়,তাঁরা তাই করেন। এই যে ছোট পত্রিকার পাঠক ক্রমবর্ধমান তার অন্যতম একটি কারণ পাঠকদের সচেতনতা নয় কি?
একটি ছোট্ট বাচ্চা, যখন তার মা বা বাবাকে প্রশ্ন করে জানতে চায় তার জন্মরহস্য।সাহিত্যেই লেখকরা বলতে পারেন, ‘ইচ্ছে হয়েছিলি, মনের মাঝারে’। এখন কোন সাহিত্যিক সেটি ঘুরিয়ে, অন্যভাবেও দেখাতে পারেন। সেকথা যদি বিজ্ঞান সম্মত ভাবে জানতে হয়,জানাতে হয়, তবে বিজ্ঞান পড়তে হয়। আর বিজ্ঞান পড়ে কেউ যদি বলেন অশ্লীল, বলতে পারেন,বলার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু তাতে তো বিজ্ঞানকে অস্বীকার করতে হয়। “কতদিন ভাবে ফুল উড়ে যাবে কবে”। এ কি আর বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, না যাবে? এরকম উদাহরণ আপনারা সকলেই জানেন।সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা যায় রূপকের ব্যবহার করা হয় এবং তার চলও বেশ প্রাচীন। তবে সময় বদলায়,বদলায় মানুষের রুচি,পছন্দ,চাহিদা। বর্তমানে এই রুচি,পছন্দ, চাহিদা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতির এক বিরাট ভূমিকা আছে। বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ে (১৯৯০ এর পর) দেখুন পোষাক, খাদ্য, বাসস্থান,সংস্কৃতি যেন সারা বিশ্বে একই রকম। প্যান্ট-শার্ট কি রকম আন্তর্জাতিক পোষাক হয়ে গেছে ভাবুন একবার!পিৎজা,বার্গার, কে এফ সি, চিকেন আন্তর্জাতিক খাবার, মল-সংস্কৃতির বিকাশ এসবেতেই বাজার অর্থনীতির প্রভাব কি অস্বীকার করা যায়? অর্থনীতিকে ভিত্তি ধরলে সাহিত্য উপরিসৌধ।ভিত্তিই সাহিত্যের মূলধারাটি ঠিক করে। তবে পরিবর্তন হচ্ছে,আরো পরিবর্তন হবে। নিত্য নতুন আসবে সবকিছুতেই আর সাহিত্য একই জায়গায় থমকে থাকবে তা তো আর হতে পারে না।তাই অতীতের পথ ধরে বর্তমানেও কবিতায়,গল্পে অনেকেই তথাকথিত অশ্লীল শব্দাবলি ব্যবহার করছেন। এই ব্যবহারের পিছনে অনেকেই সস্তা জনপ্রিয়তার যুক্তি দেখিয়ে থাকেন। প্রচারের আলো টেনে নেওয়ার কৌশল বলে সমালোচনা করেন।কুরুচিসম্পন্ন ইত্যাদি বলে গালাগালিও করেন।
তবুও আমার অভিমত, সুস্পষ্ট ভাবে বলি,লেখক তাঁর বক্তব্য কি ভাবে বলবেন, প্রকাশ করবেন, জানাবেন তার স্বাধীনতা লেখকের আছে। পাঠক তা কীভাবে গ্রহণ করবেন তা পাঠকের ব্যাপার।সেনিয়ে অযথা বিতর্ক করে লাভ কী? শব্দ তো ব্রহ্ম! তা কী করে অশ্লীল হতে পারে! আপনি যদি হাতকে হাত, কর,বাহু, বলেন তবে তা শ্লীল আর আপনার যৌনাঙ্গটিকে যদি বিভিন্ন নামে বোঝানো হয়ে থাকে তবে তা অশ্লীল হবে কেন? কেউ যদি তা লেখেন,লিখতে পারেন অকপট তবে কেন আঙুল উঠবে তাঁর দিকে। কতজনকেই তো দেখি, তথাকথিত অশ্লীল শব্দগুলির কী সুন্দর প্রতীকী ব্যবহার করেছেন তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যে। তাঁরা পেরেছেন, তাঁদের সে ধক আছে, তাই তাঁরা করেছেন।
একা নয়, সহিত। সহিত শব্দটিকে ঘিরে, অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে সাহিত্য। লেখক লেখেন,পাঠক পড়েন।লেখকের সঙ্গে পাঠকের পরিচয়,জানাশোনা সাহিত্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। কে, কেমন, কী, কেন, লিখবেন তা লেখকই ঠিক করেন প্রাথমিক ভাবে।সেই ঠিকটি হতে পারে তাঁর শিক্ষা, রুচি, পছন্দ, পেশা ইত্যাদির ওপর। আবার বাজার, জনপ্রিয়তা বা বিতর্কিত হওয়ার জন্য, সহজেই প্রচারের সবটুকু আলো কেড়ে নেওয়ার জন্য অনেক সময় লেখক ইচ্ছাকৃতভাবে তথাকথিত অশ্লীল শব্দভান্ডার থেকে কিছু শব্দ প্রয়োগ করে থাকেন। দেখুন, আমি যাবো না,আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব না,বা আমার যাওয়ার মত পরিস্থিতি নেই ইত্যাদি যেমন বলা বা লেখা যায় তেমনি, আমি ড্যাশ যাবোও বলা যেতে পারে। ঐ যে ড্যাশ,সেই ড্যাশে কোন যৌণগন্ধী শব্দ,বা যৌণাঙ্গের ব্যবহারও করা যেতেই পারে।এখন একটু কান পাতলেই তো এসব শব্দ শোনা যায় আকছার। তো,কোন লেখক যখন সেই সব শব্দ ব্যবহার করে সাহিত্য সৃষ্টি করেন, তখনি শোনা যায় গেল গেল রব। একজন লেখক, তিনি বস্তিবাসীর জীবন নিয়ে, কিংবা এখনকার কলেজ পড়ুয়াদের নিয়ে যদি তিনি কিছু লেখেন, তাদের মুখের কথা,ভাষা , যদি রাখেন সব, তবে তো পুরো অশ্লীলতার বাণে ভেসে যাবেন বিপক্ষীয়রা। কি বলবেন তাঁরা? এই যে বর্তমান সমাজ, বলুন তো বুকে হাত দিয়ে তা কতখানি শ্লীল? একজন লেখক, তিনি যা সৃষ্টি করছেন সেখানে তো ছাপা থাকছে তাঁর নাম। সেই লেখা পড়ছেন তাঁর আত্মীয়, পরিবার, পরিজন, প্রতিবেশী, সহকর্মী এমনকি তাঁদের সন্তানসন্ততিরাও। সোজা কথা ওসব শব্দ প্রয়োগ করতে বুকের,মনের জোর লাগে। যাঁদের আছে সেই দম তাঁরা লেখেন। হ্যাঁ,তাঁদের অধিকাংশজনই স্বনামে লেখেন। সাহসী না হলে ঐ তথাকথিত অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করে যথার্থ সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তো, বিতর্ক কিসের? এই বিতর্ক সেই সব সাহসী লেখকদের হাতে হাতকড়া পরাতে পারবে না। লিখুন যিনি লিখছেন, প্রয়োগ করুন, যিনি করছেন, পাঠকরা পড়তে পারেন, নাও পড়তে পারেন, সকলের স্বাধীনতা আছে নির্বাচনের। আর তাতে গেল গেল গেল রব তোলেন শুধু তারাই যাদের অন্য কিছু নিয়ে বলার,লেখার নেই।
এখন কেউ যদি বলেন, লেখকের লেখা তো,তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে।বিতর্ক হলেই তো ভালো।হোক। তাতে কার কী? তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমেই একটি সঠিক পথে পৌঁছানো যায়। আর সাহিত্যের তো কোন একটি পথ নেই। শত শত তার পথ, গলি, তস্যগলি, ভুলভুলাইয়া সাহিত্যে চির বিরাজমান। থাক না, শত ফুল বিকশিত হোক না, অসুবিধে কী?
এই যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে, আমরা
“পাঠক – পাঠিকা “, “লেখক-লেখিকা” বলে সবেতেই লিঙ্গ-লিঙ্গ করে থাকি, তা কি লিঙ্গ বৈষম্য না? যিনি লেখেন, তিনিই তো লেখক। যিনি পড়েন তিনিই পাঠক। তার আবার লিঙ্গটি দেখার কী দরকার? খুব শ্লীল কি তা? এসব নিয়ে বিতর্ক করুন,তা না শ্লীল- অশ্লীল!
বিতর্কঃ সাহিত্যে অশ্লীলতার প্রয়োগ
(লেখাটি অর্বাচীন, ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা। জুন-২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছিল। আরো বেশি পাঠকের কাছে এই বিতর্ক পৌঁছে দেওয়ার জন্য অর্বাচীন পত্রিকার সম্পাদকের অনুমতিতে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।)
মুখ্য সম্পাদক
(টেকটাচ টক)