পাড়ায় আজ সাজ সাজ রব, বঙ্কু ক্লাস ইলেভেনে দুর্দান্ত রেজাল্ট করেছে। বঙ্কু, আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে, এলাকার যত অরাজনৈতিক ঝঞ্ঝাট, সবেতেই তার নাম সর্বাগ্রে। নেহাৎ মাধ্যমিকে চার বার আটকে গিয়েছিলো, নইলে এতদিনে এলাকার সমস্ত নেতাদের নয়নমণি হয়ে উঠত নিশ্চিত। মা সরস্বতীর অসীম করুণা তিনি বঙ্কুকে এখনও উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করিয়ে রাজনৈতিকভাবে সাবালক করে তোলেননি। তা এই হেন বঙ্কু এমন অসাধারণ কাণ্ড করে ফেলেছে শুনে ভীষণ চিন্তিত হয়ে স্বগৃহে এসে নন্দিতাকে জানাতে সে আমার মনে আতঙ্কের মাত্রা আরও চার ডেসিবেল বাড়িয়ে তুললো। বললো বঙ্কু নাকি এবার তাদের ফার্স্ট বয়ের চেয়েও ভালো রেজাল্ট করেছে এমন নাকি রটনা।
আমি অবাক মুখে বললাম, “এমনও নাকি ঘটে!”
সংশয় দূর করতে নন্দিতা বললো, “তা ঘটে না? এই তো গেলবার বঙ্কুর বাবা সারাক্ষণ বঙ্কুকে ওদের ফার্স্ট বয় অনিকেতের পড়াশোনার উদাহরণ দিয়ে উত্যক্ত করতো। তা টেস্ট পরীক্ষার আগে অনিকেত পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে, বঙ্কু তার সাইকেল কেড়ে নিয়ে মেরেধরে এমন কাণ্ড বাধালো যে অনি হাসপাতালে আর পরীক্ষা মাথায়। খুব আশা করেছিলো টেস্টে অনি আটকে গেলে তাকে নতুন ফার্স্ট বয়ের উদাহরণ শুনতে হবে। তা দু’জনের বাবা-ই সমাজে অতি পরিচিত ব্যক্তি বলে স্কুল থেকে দুজনেরই আলাদা করে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল পরে। তখনই অনিকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলো বঙ্কু যে ফাইনালে ভালো রেজাল্ট করে দেখিয়ে দেবে। তা সেটাই করে দেখিয়েছে। আশ্চর্য কী? সবাইকে নিন্দে করা কবিদের একটা স্বভাব।”
একটা খটকা মনের কোনে রেখে সান্ধ্য আড্ডা সেরে ভজুয়াদের মুরগীর খামারের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছি রাত দশটার সময়, আসতে সেখান থেকে একটা বিচিত্র খসখসে আওয়াজ শুনে শুনে হাঁক দিলাম, “কে রে, বঙ্কু নাকি?”
খানিকক্ষণের জন্য আওয়াজ স্তব্ধ, একটু পরে কাঁচুমাচু হয়ে সম্মুখে বঙ্কুর আগমন, “আস্তে সতুদা, রাত্রে ফিস্ট আছে। লোকে শুনে ফেলবে।”
“তা একটা ভালো খবর পেলাম, সত্যি নাকি? তারই খাওয়া-দাওয়া বুঝি? তা একেবারে ফার্স্ট হলি কী করে, সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার তো!”
“তোমরাই আমায় খারাপ বলো, আমি চাইলে যে কী করতে পারি তা জানো না। দেখিয়ে দিলাম তো তাহলে?”
“সেই তো দেখছি, তা টোটাল কত পেলি?”
“আমি তো আর্টস, সব মিলিয়ে সাতাত্তর, রিভিউ করলে আরও একটু বাড়বে।”
“পাঁচশোয় সাতাত্তর! এ তো পাশও করিসনি দেখছি এবারও, অনির চেয়ে বেশি পেলি কী করে?”
“কেন, অনি যে প্রতিটা সাবজেক্টে আশিটা করে কোশ্চেন পড়ে গিয়ে আটটা করে কমন পেলো? আর আমি তিনটে পড়ে গিয়ে দুটো। এবার এভারেজ করো।”
আমি বললাম, “তা বটে, তুই তো দেখছি বাই চান্স আশিটা করে পড়ে ফেললে আগামী তিন-চার বছর ইলেভেনের সাজেশন নিয়ে বাঙালির কোনও চিন্তাই থাকত না।”
“তা হলেই বলো, আমিও দেখিয়ে দিলাম বঙ্কু চাইলে সব পারে। নৈতিকভাবে জিতলাম তো?”
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই বাঙালি অপরাজেয় একটি জাতিবিশেষ। এই জাতির ইতিহাস পরাজয় শব্দটি বহন করে না। পুরাণ ঘেঁটে মহাভারতের যুগে দেখা গেছে সেই সময় বঙ্গদেশের রাজা ছিলেন ভগদত্ত। তার আমলে বঙ্গ প্রদেশের সেনা ছিল রণহস্তিচালনায় বিশেষ পারদর্শি। এই হেন যুদ্ধপ্রিয় বাঙালি রাজা উদ্বুদ্ধ হন দুর্যোধনের ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী’ কথাটি শুনে। তখন ভগবানেও নিদান দিয়ে দিয়েছেন যে কুরুপক্ষের অহংকার এতই তীব্র যে তাদের পতন নিশ্চিত। কিন্তু ভগদত্ত তা অস্বীকার করলেন। তীব্র বামপন্থা অবলম্বন করে তিনি বঙ্গবাসীদের জানালেন যে জাতি প্রকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে, তার সংগ্রামকে লাল সেলাম, কমরেড দুর্যোধন জিন্দাবাদ। এই বলে তিনি রাজমাহুত গদাই লস্করকে লাগাম তুলতে বললেন। সমগ্র বাঙালি জাতিও অমনি নিজস্ব হাতির পিঠে বসে দুর্যোধনের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ শ্লোগান দিতে দিতে কুরুক্ষেত্র অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। যদিও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কভারেজ কপিরাইট তৎকালীন মেডিয়া পার্টনার এস টিভি ওরফে সঞ্জয় টিভির দখলে ছিলো বলে এই অনুষ্ঠান রেকর্ডেড হয়নি।
শাস্ত্রজ্ঞ্ররা বলেন ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুর মূল আমাদের সনাতনী পুরাণ। সুতরাং সেই মতে বামপন্থারও উদ্ভব সনাতনী ভারতেই। কিন্তু ভগদত্ত কর্তৃক সেই হস্তিচালনাই ভারতবর্ষের প্রথম কমিউনিস্ট উদ্যোগ তা অনেকেরই বিস্মৃতির অতলে। সে যাই হোক, হাতি নিয়ে গদাই লস্করী চালে যতক্ষণে ভগদত্ত কুরুক্ষেত্র পৌঁছালেন ততদিনে যুদ্ধ শেষে দুর্যোধন পর্যূদস্ত এবং ভীমকর্তৃক নিকেশ হয়েছেন। লাল ইউনিফর্ম পরা বঙ্গসৈনিকদের দেখে দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলেকে পাঠানো হলো কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধশেষে এ কোন তৃতীয়পক্ষের আগমন হলো আবার। যুদ্ধাবস্থায় তাদের বেকারত্ব নিন্দনীয় হয়ে উঠছিলো বড়। ভগদত্ত দেখলেন সমূহ বিপদ, তারা কুরুপক্ষের হয়ে লড়তে এসেছে জানতে পারলে আর বঙ্গদেশে সশরীরে ফিরতে হবে না। তিনি তখন ফেডারাল ফ্রন্ট গঠন ইস্তক পাণ্ডবপক্ষের সন্ধি করে বঙ্গে ফেরেন এবং বঙ্গবাসীদের আশ্বাস দেন যুদ্ধে তাদেরই জয় হয়েছে। এরপর অর্জুন যখন অশ্বমেধের ঘোড়াকে অনুসরণ করে বঙ্গদেশে উপস্থিত হন তখন ভগদত্তের উত্তরসূরী সমুদ্র সেন কর্তৃক তারা বাধাপ্রাপ্ত হয় না। এতে বঙ্গবাসী তাদের নিন্দে শুরু করলে সমুদ্র সেন আশ্বাস দেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বাঙালিরা যা পারদর্শিতা দেখিয়েছে, তাতে অর্জুনের ঘোড়া আটকানো এবং পাণ্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞ ভণ্ডুল করা ছিলো নিমিত্ত ব্যাপার। কিন্তু সে সব ঝামেলায় না গিয়ে বাঙালি অর্জুনকে আপ্যায়ন করে দেখিয়ে দিলো নৈতিক জয় তাদেরই হয়েছে।
সেন বংশের এই ধারা বজায় ছিলো লক্ষণ সেন অবধি। সে কথায় পরে আসছি। দ্বাপর যুগের পর এই কলিযুগেও বাঙালি লড়তে জানে, হারতে জানে না। এই কয়েকদিন আগেই রাজ্য প্রশাসনে সিবিআই হানায় আমাদের পাড়াতুতো এক ঘটনা মনে পড়ে গেল। বঙ্কুর আগে আমাদের আমলে তার পূর্বসূরী ছিলো সজু। সজুর মা দুর্গাপিসি ছিলো পাড়ার মধ্যে খানদানী এক মহিলা। ছোটবেলায় ‘সজু-উ-উ…’ বলে তার ডাক বাড়ির থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে তালবাগানে তাড়ি খেতে খেতে সজু শুনতে পেলেই সোজা বাড়ি চলে যেত। তা, একদিন সজু কোনও এক দুর্ঘটনা ঘটানোয় পুলিশ তাকে তাড়া করতে সে বাড়িতে ফিরে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল তুলেছে। পুলিশ তার খোঁজে বাড়িতে ঢুকতেই দুর্গাপিসি একখানি কাটারি মেজোবাবুর গলায় ধরে বললো, “সজুরে ধরতে আইছস, ড্যাকরার সাহস তো মন্দ নয়।”
মেজোবাবু তাই দেখে কুঁই কুঁই করে বললেন, “আমরা পস্ট দেখেছি ধনার গাড়ির চাকা খুলে নিলো ওটা সজুই ছিলো।”
“অ, তাই দেখেই চলে এলি। সজু তোদের সাথে যাবে না যাঃ। বেশি চেঁচামেচি করবি তো কাটারি দিয়ে তোর মুণ্ডুটা…”
শেষে মেজোবাবু খেপে গিয়ে আদালত থেকে ওয়ারেন্ট বের করে, জেলা সদর থেকে ফোর্স নিয়ে এসে সজুকে ধরে নিয়ে যখন চলে গেলো, তখন দুর্গাপিসি জাতির উদ্দেশ্যে বলেছিলো, “এঃ, কত্ত বড় সাহস আমার সজুকে দেখতে পেয়েই ধরতে চলে আসবে। এবার বোঝ, আদালত থেকে কাগজ হাতে ফোর্স নিয়ে আসতে হলো তো? দ্যাখ কেমন লাগে।” সজুও হাতকড়া পরে জাতির উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে নাড়তে সেবার লকআপে ঢুকেছিলো। আজও এই ঘটনা আমাদের মধ্যে বীরগাথা হিসেবে চর্চিত হয়।
বাঙালি বীর হতে গেলেও কম পরিশ্রম নেই অবশ্য। এই ধরা যাক নেতাজীর পর বাঙালির ত্রাতা হিসেবে যখন সৌরভ গাঙ্গুলীর উত্থান হলো, তখন তাকেও কী কম স্ট্রাগল করতে হয়েছে? ফরেনে দু-দুটো সেঞ্চুরীর পরও তাকে শুনতে হয়েছে, ‘অত চোখ পিটপিট করলে আর বল দেখবি কখন?’, অথবা যখন সে জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন্সি পেলো, তখনও অনেক বাঙালি গোয়েন্দা তার পেছনে ডালমিয়ার হাত আছে বলে তদন্তের দাবী তুলেছিলো। এখনও শোয়েব আখতারের ডেলিভারীতে তার মাটিতে পড়ে থাকার দৃশ্যটি মাঝে মাঝে সোশাল মেডিয়ায় ভাইরাল হলেই দেখা যায় তাতে পাঁচশো হাসির ইমোটিকন। এখনও আমাদের মহারাজা দলের সেরা ক্যাপ্টেন লিখে ফেসবুকে পোস্টান, দেখবেন দশটার মধ্যে আটটা কমেন্টেই ধোনির সঙ্গে তুলনামূলক হীন করে তোলা হবে তাকে। অবশ্য আমাদের দাদামণি তাই দেখে স্মীত হাসেন, এবং ভাবেন আজ থেকে একশো বছর পরে বাঙালি কেন, নেতাজীকে ‘তোজোর কুকুর’ বলা বামপন্থীরাও অধুনা তাদের নেতাজী পুজোর মতোই দাদা-মহোৎসবও করবে নিশ্চিত। এটাই তাঁর নৈতিক জয়। তবে জীবাবস্থায় তিনি তা দেখতে পাবেন না এটুকুই যা আক্ষেপের।
তবু বাঙালি লড়ে চলে। দাদার বাঙালি হিরো হওয়ার না হয় একটা নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু মরোণোত্তর প্রধানমন্ত্রীত্ব পাওয়ার বিষয়টি কেন যে ভারতীয় সংবিধান চালু করেনি তা নিয়ে বঙ্গীয় রাজনৈতিক মহলের চর্চা অনেকদিনের। সেই ‘হিস্টোরিক্যাল মিসটেক’-এর আমল থেকে দেখা যাক আমাদের বঙ্গীয় রাজনৈতিক সমীকরণ। ধরা যাক ‘ক’ হলো পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, ‘খ’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও ‘গ’ প্রধানমন্ত্রী দাবীদার বিরোধী নেতা। ‘ক’-এর সদিচ্ছা সে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবে, কিন্তু তার ক্ষমতা ‘খ’-এর তুলনায় নিমিত্ত। তাই সে ‘গ’-এর হাত শক্ত করলো এবং আগামী লোকসভা নির্বাচনে ‘খ’-কে পর্যুদস্ত করলো। এরপর নানারকম বাকবিতণ্ডার মাধ্যমে ‘গ’ সদ্যনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী স্বীকৃত হলো এবং ‘ক’ জাতির উদ্দেশ্যে সদর্পে ঘোষণা করলো, প্রধানমন্ত্রীত্ব পাওয়া না পাওয়া বড় কথা নয়, বড় কথা হলো বাঙালির ক্ষমতা আছে প্রধানমন্ত্রীকে ঠ্যাং ধরে উৎখাত করার। তাই বাঙালিদের বেশি ঘাঁটাবেন না। এটাই ‘ক’-এর নৈতিক জয় যা জীবাবস্থায় বাঙালির একমাত্র আরাধ্য বস্তু।
নৈতিক জয় নিয়ে এই গবেষণাপত্রটি লেখার সময় তার উৎসসন্ধানে বেরিয়ে দেখলাম পৃথিবীর ইতিহাসে এর প্রথম উদাহরণ যা দেওয়া আছে, তা আলেক্সান্ডারের ভারত আক্রমণের সময়কার এবং সেটি আমাদের বহুলচর্চিত রাজাধিরাজ পুরুর সেই বীরোচিত বিখ্যাত আখ্যান। অধুনা গ্রীসপ্রদেশে এক চর্চায় উঠে এসেছে এই ঘটনার মাধ্যমে নাকি আলেক্সান্ডারের অন্তর্দেশ থেকে বার্তা আসে যে এমন বিশ্বজয় করে আর কী লাভ? তাই তিনি সদলবলে আলেক্সান্দ্রিয়া ফেরার পরিকল্পনা করেন এবং এই খেদেই পানাসক্ত হয়ে ব্যবিলনে মারা যান। সন্দেহ করা হচ্ছে কখনও পরাজিত না হওয়ার এই সনাতনী গোপন তত্ত্বটি যাতে কখনই যবনদের হস্তগত না হয় তার জন্যও ব্যবিলনে ষড়যন্ত্র করা হতে পারে। কে জানে, এর ফলেই হয়ত আজও নৈতিক জয় সম্পর্কে পশ্চিমাবিশ্ব অবগত নয়।
কিন্তু কালক্রমে নৈতিক জয়ের ব্যবহার আলেক্সান্ডার ফিরে যাওয়ার পর সর্বভারতীয় ইতিহাসে আর তেমন লক্ষ্য করা যায় না। তবে শোনা যায় উমাপতিধরের আমলে যখন নবদ্বীপে প্রবলভাবে ইতিহাসচর্চা চলছে তখন নাকি সেখানকার পণ্ডিতরা মাটি খুঁড়ে এই গোপন তত্ত্ব বাংলায় নিয়ে আসেন। তদানীন্তন বৃদ্ধ বঙ্গরাজ লক্ষণ সেন যখন বখতিয়ার খলজির আক্রমণে রাজ্যছাড়া হয়ে বিক্রমপুরে মনোঃকষ্টে ভুগছেন তখন উমাপতিধরই সেখানে গিয়ে তাঁকে বোঝান যে বখতিয়ার তার রাজধানী, সম্পদ সব নিলেও বঙ্গের যে গর্বের পঞ্চরত্ন, তা এখনও তাঁর সঙ্গেই রয়েছেন। এই বলে তিনি ধোয়ী, জয়দেব, শরণ ও গোবর্ধন আচার্যের সঙ্গে তাঁরও স্বাক্ষরীকৃত একটি চুক্তিপত্র দেখিয়ে কৌটিল্যের বাণী শোনান যে রাজা নিজ রাজ্যেই শুধু পূজিত হয়, কিন্তু বিদ্বান সর্বত্র। সুতরাং ভেঙে পড়ার কোনও কারণ নেই, তাঁরা যে স্থানে অবস্থান করবেন, সেখানি সম্মান পাবেন। এরপর এই প্রবচনে উদ্দিপীত হয়ে লক্ষণ সেন পূর্ববঙ্গ থেকে আবার তার একখানি ছোট রাজত্ব চালাতে উদ্যমী হন।
এরপর থেকে বারংবার বাংলা সঙ্গস্কৃতিতে উচ্চারিত হয়েছে নৈতিক জয়ের মাহাত্ম্যকথা। যেমন শরৎচন্দ্রের দেবদাস, এক সুযোগ্য মাতালের প্রেমের প্রতি হাউহাউ করে কেঁদেছে বাঙালি কিম্বা কাদম্বরী মরিয়া প্রমাণ করিয়াছিলো সে মরে নাই। একটু খুঁজলেই বঙ্গজনজীবনে নৈতিক জয়ের প্রভাব বার বার লক্ষ্য করা যাবে। আধুনিক যুগে এর ব্যাপ্তী আরও বিস্তৃত হয়েছে বাংলা লিটিল ম্যাগাজিনগুলোর মাধ্যমে। পত্রিকাচত্বরে এই প্রথা চালুর ব্যাপারে উদ্যোগী হন ষাটের দশকের কিছু কবি। তাদের দাবী ছিলো যে তাদের সৃষ্টি প্রাতিষ্ঠানিক হতে পারে না কোনও মতেই। এই বলে তারা সেই সময়কার নামকরা এক বড় পত্রিকাচত্বর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং নিজেদের মতো একখানি পত্রিকার উদ্যোগ নেন এবং তা বহুল প্রচারিত হয়ে সাফল্য পায়। কিন্তু বছর কয়েক পরে তাদের মধ্যে গোলযোগ বাধে এবং এই নব্যনির্মিত পত্রিকাটিও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে অভিযোগে সেখান থেকে বিদ্রোহীরা বেরিয়ে আসেন। এরপর গত পাঁচ দশকে পত্রিকাটির কমসেকম পঁচিশবার নবজন্ম হয়েছে এবং তাদের প্রতিটা পক্ষই নৈতিক ভাবে নিজ নিজ মতাদর্শে জয়ী।
শেষবার যখন পত্রিকাটি ভেঙে নতুনভাবে এক দাঁড়াবার জায়গা পায়, তখন তাদের মধ্যে এক বিদ্রোহী আমার পূর্বপরিচিত ছিলো। এই পুনর্ভাঙন সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করি এই ভাঙনের কারণ জানতে। সে উত্তর দেয় দাঁড়াবার জায়গা পেতে তাদের পথপ্রদর্শকের কবিতা আগে ছাপা হতো তেত্রিশ পৃষ্ঠায়। গত কয়েক সংখ্যা ধরেই তাকে হীন প্রতিপণ্যে ছাপ্পান্ন নম্বর পৃষ্ঠায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তাই তারা ছেড়ে বেরিয়ে এসে নতুন পত্রিকায় তিন নম্বর পৃষ্ঠায় তাঁকে এনে দাঁড় করিয়েছে। সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মুখের উপর এ হলো তাদের জবাব, এ জয় তাদের এক বড় জয়। এই শুনে মনে মনে ভাবলাম সর্বপ্রথম যে প্রতিষ্ঠান ভেঙে এদের আবির্ভাব হয়েছিলো, সেই পত্রিকা আজ একটি আঞ্চলিক পত্রিকা হিসেবে সর্ববৃহৎ এবং তবুও সে পরাজিত। অপরদিকে তাকে ভেঙে যে পঁচিশটি ছোট পত্রিকা তৈরী হলো এবং যাদের মধ্যে তেইশটিরই বিলুপ্তি ঘটেছে তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিজয়ী। বাঙালী জাতি কোনওদিন মহীরুহের বশ্যতা স্বীকার করেনি। এই জাতি বৃহৎক্ষেত্রে জয়ী না হতে পারে, তবে কখনও পরাজিতও হতে পারে না। কারণ এই জাতির মধ্যে নৈতিক জয় বর্তমান এবং তারা এই নিয়েই খুশি।
কাগুজে লিটিল ম্যাগাজিন ছেড়ে নৈতিক জয়েরও ডিজিটালাইজেশন হয়েছে। কয়েকদিন আগেই আমাকে পরিচিত এক লেখক দাদার সঙ্গে ফেসবুকীয় সাহিত্য নিয়ে কথা হচ্ছিলো। তিনি এক মস্ত বড় সাহিত্যগ্রুপের স্বনামধন্য লেখক এবং কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম সেই গ্রুপ ছেড়ে তিনি তার নিজস্ব গ্রুপ খুলেছেন। তিনিই এডমিন এবং চল্লিশ হাজারি গ্রুপে তিনি একটা লেখা দিলে যেখানে দুইশো লাইক পড়তো, নিজের ঢাই হাজারি গ্রুপে তার লেখায় একশো লাইক পড়ে। আমি প্রশ্ন করলাম তা লাইক কমে গেলো যে।
তিনি বললেন, “উঁহু! তুমি ভাই এভারেজ করে দেখো আমারই নৈতিক জয় হচ্ছে কিনা।”
আমি কর গুনে হিসেব করে দেখলাম, তাই তো!
দূর থেকে যেন কানে ভেসে এলো বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে কবিগুরুর লেখা স্তোত্র, “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই…”