জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর।
বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন।
চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।
লোকসাধারণের শ্রীরামকৃষ্ণ
ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় ও চন্দ্রামণি দেবীর পুত্র গদাধর চট্টোপাধ্যায় ( ১৮.০২.১৮৩৬ – ১৬.০৮.১৮৮৬) অতি সাধারণ মানুষ হয়েও কি করে যেন বাংলা নবজাগরণের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে লেখাপড়া শেখেন নি। কিন্তু যে আলোকমুখীনতা ভিতরে গড়ে উঠলে সম সময়ের সবচেয়ে আলোকদীপ্ত মানুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র সেন প্রমুখ ব্যক্তিত্বগণের কাছে গিয়ে আলাপ করার আগ্রহ জন্মায়, তা তাঁর ছিল। এই যে আলোকমুখীনতা, সেরা শিক্ষাবিদ, সেরা সাহিত্যিকের কাছে যাওয়ার আগ্রহ বোধ করা, এটা লক্ষ করে আমি গদাধর চট্টোপাধ্যায় বা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে কিছুতেই আর পাঁচটা ধর্মব্যবসায়ীর সাথে সামিল করে দেখতে পারি না।
সদ্যোযুবক নরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর কাছে আসতেন। বয়সে তাঁর থেকে সাতাশ বছরের ছোট, সে যুগে তো বটেই, এখনকার হিসেবেও পুত্রতুল্য, সেই নরেন দত্তকে যেভাবে তিনি মানবজীবনমুখী করে গড়ে তোলেন, তা আমায় আশ্চর্য করে। পিতৃহারা নরেন্দ্রনাথ না কি তাঁর গুরুকে বলেছিলেন, আমাকে এমন করে দাও যাতে সর্বক্ষণ সমাধি হয়ে থাকে।
সমাধি কি জিনিস, তা আমি জানি না, কিন্তু রামকৃষ্ণ যা বলেছিলেন, তা মনে বেশ দাগ কেটেছিল। সুদর্শন, সুগায়ক, ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন যুবকটিকে তাঁর গুরু বলেছিলেন, কই, আমি যে ভেবেছিলুম তুই সকলের আশ্রয় হবি, লোকে তোর কাছে এসে শান্তি পাবে, আর তুই নিজের মুক্তি চাইছিস!
এই বোধটা নরেন্দ্রনাথকে অন্যরকম করে গড়ে তোলে।
“নারী নরকের দ্বার”, এই টিপিক্যাল সনাতনী হিন্দুয়ানি থেকে রামকৃষ্ণ মুক্ত ছিলেন। নিজের স্ত্রী সারদা দেবীকে সন্তানহীনতার জন্য মানসিক কষ্ট পেতে দেখলে, তিনি বলেছিলেন, চিন্তা কোরো না, তোমাকে এমন সব ছেলে এনে দেব, মাথা খুঁড়লেও লোকে যা পায় না। যে যুগে মানুষ নারীকে অজ্ঞানতার প্রতিমূর্তি রূপে জানত, বলত ও বিশ্বাস করত যে পড়াশুনা করলে মেয়েরা বিধবা হয়, সে যুগে রামকৃষ্ণ তাঁর স্ত্রী সম্বন্ধে বলতেন, ও সারদা, সরস্বতী, জ্ঞান দিতে এসেছে। নিজের স্ত্রীকে এভাবে সম্মানের আসন টিপিক্যাল সনাতনী ধর্মব্যবসায়ীরা দেন বলে শুনি নি। নারীজন্মের প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা ছিল, তা অভ্যস্ত হিন্দুয়ানির বিপ্রতীপে। রামকৃষ্ণ স্ত্রীকে বলতেন, আমি চলে যাবার পরেও তুমি নিজেকে বিধবা ভেবো না।
তোতাপুরী ছিলেন তাঁর গুরু। কিন্তু চালু অর্থে সংসার ছাড়েননি শ্রীরামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণের জীবন দেখলে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশা আলাপ পরিচয়ের আগ্রহ দেখলে ও নিজের ছবি তোলানোর আগ্রহ দেখলে, অন্ন গ্রহণের আগ্রহ দেখলে, বলতে ইচ্ছে করে, “বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়, অসংখ্য বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ”।
শিক্ষার প্রতি একটি গভীর ও গূঢ় আগ্রহ ছিল রামকৃষ্ণের। এবং তা পুঁথি পড়ার শিক্ষা নয়, লোকশিক্ষায় তাঁর আগ্রহ টের পাই, যখন দেখি, তিনি বাংলা নাট্য আন্দোলনের প্রচেষ্টাকে গৌরবান্বিত করছেন। বলছেন, ওতে লোকশিক্ষে হয়। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমে রাশিয়ার চিঠি পড়তে গিয়ে দেখেছি, রাশিয়ার সোভিয়েত বিপ্লবীরা চাষি জোলার মধ্যে নাটকের চর্চা ও প্রসারে মন দিয়েছিলেন বলে কবি তাঁদের প্রাণভরে সুখ্যাতি করেছেন। তখনকার বাংলাভূমিতে মঞ্চের অভিনেত্রীরা লোকসমাজে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। ভদ্রলোকের সমাজে তাঁদের মান্যতা ছিল না। তাঁরা সকলেই আসতেন যৌনপল্লী থেকে। নটী বিনোদিনীও ব্যতিক্রম ছিলেন না। চৈতন্যলীলায় বিনোদিনীর অভিনয় দেখে রামকৃষ্ণ তাঁর মাথায় হাত দিয়ে আশির্বাদ করেছিলেন। এহেন আচরণ গড়পড়তা গুরুর পক্ষে অভাবনীয়।
বাস্তব জীবন সম্পর্কে গভীর ভালবাসা ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের। সন্তানসংখ্যা সীমাবদ্ধ রাখার কথা নিজের মতো করে ভেবে তিনি যখন বলেন, একটি দুটি সন্তান হলে স্বামী স্ত্রীতে ভাইবোনের মতো থাকবি, সে কথার গভীর ব্যঞ্জনা আমাকে আপ্লুত করে। অজস্র সীমাবদ্ধতায় ঘেরা ঘরোয়া মানুষের জীবন। আর গৃহীর বন্ধু শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, সংসারে থাকতে হলে পাঁকাল মাছের মতো থাকবে। বলেন, ঢেঁকিতে চাল কুটছে, সেই অবস্থায় বৌরা ছেলেকে মাই খাওয়াচ্ছে, কিন্তু মন রয়েছে ঢেঁকির মুষলের দিকে। নইলে, আঙুল ছেঁচে যাবে। সাংসারিক দৈনন্দিনতার মধ্যে কিভাবে উচ্চচিন্তার দিকে ব্যক্তি মানুষ নিজেকে পরিচালিত করবে, সে ব্যাপারে মোক্ষম শিক্ষা এটি।
শ্রীরামকৃষ্ণ অতি সহজ ভাষায়, গল্পের আদলে মহাজীবনের কথা বলতেন। শোনা যায়, গৌতম বুদ্ধ ও যিশুও নাকি ওভাবেই লোকসাধারণের বোধগম্য ভাষায় বলতেন। আর নিজেকে চিনতেন তিনি। নিজের রক্ত মাংসের শরীরের ছবি তোলানোয় রামকৃষ্ণের আগ্রহ ছিল খুব। একটি ছবি তুলিয়েছিলেন কলকাতার রাধাবাজারে বড় পেশাদারি স্টুডিওতে। ইংরেজি ১৮৮১ সালের ১০ ডিসেম্বরে দি বেঙ্গল ফোটোগ্রাফার্সে সেটি তোলা। তাঁর জীবনাবসানের সাড়ে চার বছর আগে তোলা এই ছবিটি খুবই লোকপ্রিয়। তাঁর পুণ্য জীবনকথা শ্রীম, মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, মাষ্টার মহাশয়, লিখে গিয়েছেন। ওই “কথামৃত” বাংলাভাষার সব সেরা গ্রন্থগুলির একটি। নিজের ভিতরকথা তিনি উৎসাহ যুগিয়ে শ্রীমকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছেন। লোকজীবনকে অগাধ না ভালবাসলে এ কি হয়?
গলায় দুরারোগ্য কর্কটরোগের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে ১৮৮৬ সালের ষোল অক্টোবর তারিখে, মোটে একান্ন বৎসর বয়সে মারা গিয়েছেন তিনি। গলার কষ্টে খেতে পারতেন না, অথচ খেতে ইচ্ছে করত খুব। গেঁড়ি গুগলির ঝোল খেলে যদি একটু পুষ্টি পান, তাই রাঁধতে স্ত্রীকে মিনতি করতেন। দৈবী ক্ষমতায় বিশ্বাস করতেন না শ্রীরামকৃষ্ণ। সিদ্ধাই ও তুকতাক এর ক্ষমতাকে প্রকাশ্যভাবে নিন্দা করতেন। জলের উপর দিয়ে জনৈক সাধুর হেঁটে হেঁটে চলে যাবার গল্প পেড়ে বলতেন, মাঝিকে যৎসামান্য মজুরি দিয়ে যখন নদী পার হওয়া যায়, তখন ওই সিদ্ধাইয়ের দাম কিসের? বাস্তব জীবনে যুক্তিকে, কার্য কারণ বোধকে গুরুত্ব দিতে পারা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস নারী শিক্ষার অগ্রপথিক, বিধবাবিবাহ আন্দোলনের যাজ্ঞিক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে চিনেছিলেন অমৃতের সাগর হিসেবে। ভিতরে অমৃত না থাকলে কেউ অমৃত সাগরের সন্ধান পায়?