• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় দেবব্রত রায়

তিন পুরুষ থেকে

আমার বাবা ।

এই সুখ এবং সুযোগ—- এর কোনোটারই প্রাপ্তিযোগ আমার জীবনে আজও পর্যন্ত ঘটেনি অর্থাৎ , আমার প্রায় পঞ্চাশটি রাঢ়ীয় গ্রীষ্মের আপডেট লাইফ সম্পূর্ণভাবে পিতৃত্বহীন হয়েই কখনো ধীরেধীরে কখনো অতি দ্রুত পার হয়ে গেল ! ….অথচ, অজস্র প্রজাপতি-প্রজাপতি ইচ্ছে মনের ভিতরে উড়ে বেড়ালেও, এই মায়াময় জগৎ-সংসারের অণু-পরমাণুবৎ খণ্ডাংশও আমার জীবনে গোলাপের পাপড়ির মতো আজও কোনোভাবে-ই প্রষ্ফুটিত হতে পারলনা !
আমার বাবার পিতৃদেব অর্থাৎ, আমাদের ঠাকুরদা ছিলেন অসম্ভব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। বর্তমান পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একটি গড়ের তিনি ছিলেন শেষ জমিদার পুত্র। ‘শেষ ‘শব্দটি ব্যবহার করলাম এই কারণে, আমার ঠাকুরদার ছাত্রকালীন অবস্থাতেই তাঁর পিতৃদেব ইংরেজদের কাছে সেই জমিদারি হারিয়েছিলেন। কিন্তু, আমি বা, আমাদের ভাইবোনেরা বড়ো হয়েও ঠাকুরদার অর্থাৎ, আমাদের পরিবারের যে জমিজমা, পুকুর, পালকি, গরুরগাড়ি, গোয়াল….গোমস্তা দেখেছি সেও নেহাত কম নয়। তবে,এসবই আমাদের ঠাকুরদার চাকরির স্থানের কাহিনী। সে জায়গার নাম সবং। আমার ঠাকুরদা একসময় স্কুলমাস্টারি নিয়ে চলে গেছিলেন সবংয়ে।
জমিদারের ছেলে বলেই বোধহয়, তার রক্তের মধ্যে মিশেছিল জমিজমার নেশা। তখন গোটা দেশ জুড়ে উড়ছে কংগ্রেসি পতাকা। দেয়ালে দেয়ালে গাই বাছুর মনের আনন্দে ঘাস খেয়ে চরে বেড়াচ্ছে। আমার ঠাকুরদা ছিলেন স্থানীয় বোর্ডের নেতা। যদিও পলিটিক্সের ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান সবই আমার কাছে তখন ছিল অন্ধের হস্তি দর্শন কারণ, আমি তখন মা,ঠাকুমার কোলে-কাঁখে একেবারে ইজের পরা বেবি।
ও-ই যে বলেছিলাম, আমার ঠাকুরদা ছিলেন অসম্ভব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং অবশ্যই পণ্ডিত মানুষ । আজ থেকে প্রায় ষাট-সত্তর বছর আগেই আমার ঠাকুরদা বোধহয়, নিশ্চিতভাবে বুঝে গিয়েছিলেন , কৃষি আমাদের ভিত্তি এবং চাকরি আমাদের ভবিষ্যৎ আর, তাই তাঁর দুই ছেলে অর্থাৎ, আমার বাবা এবং জ্যেঠুকে পড়াশোনা শেষ করিয়েই আল্টিমেটাম দিলেন, এবার তারা যেন চাকরির চেষ্টা করেন। ছোট ছেলে অর্থাৎ, আমার বাবাকে অফার দিলেন গ্রামে থেকে মাস্টারি করার কিন্তু, সেইসময় বাবা বাঁকুড়ার ওঁদায় লাইভস্টক-ডিপার্টমেন্টে চাকরি পেয়ে যান। জ্যেঠু চলে গেলেন মুম্বাই। ( তখন বোম্বাই ) একটি কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি নিয়ে। ঠাকুরদার দুই ছেলেই গাঁ-ঘর, গোলাভরা ধান , গোয়ালভরা গরু, পুকুর,দিগন্তবিস্তৃত জমিজমা এ-সবকিছুকেই আলবিদা জানিয়ে একে একে শেকড় ছেঁড়া হলেন।মাঝেমধ্যে অবশ্য আমাদের ঠাকুমা তার ছেলেদের জন্যে দুঃখ করে কান্নাকাটি করলে দাদু নাকি, রয়্যালবেঙগল টাইগারের মতো-ই হুঙ্কার ছেড়ে তাঁকে চুপ করিয়ে দিতেন। বলতেন, মানুষ-জাতের আবার শেকড় কী! এই গোটা পৃথিবীটা-ই মানুষের রাজত্ব।
….অথচ, আমার সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, পণ্ডিত ঠাকুরদা আমার নাম রাখতে গিয়েই পড়ে গেলেন একেবারে জালাপাতে! যেহেতু আমার দাদার নাম সুব্রত তাই, সেই নামের সঙ্গে মিলিয়ে ঠাকুরদা আমার নাম রাখলেন দেবব্রত। আর, সেইমুহূর্ত থেকেই কঁচি বয়সের অসহায় আমি শুধুমাত্র নাম-দোষেই একেবারে যাবজ্জীবন- ফাঁসান ফেঁসে গেলুম ! নামকরণের দিন হটাৎ-ই আকাশে জমে ওঠা কালো মেঘ গুড়গুড় করে এমনই হেঁকেডেকে উঠেছিল যে বৈকুণ্ঠধামে লক্ষ্মী-নারায়নও নড়েচড়ে উঠেছিলেন বোধহয় । দেবতারা পুষ্পবৃষ্টির বদলে বজ্রপাত আর, শিলাবৃষ্টি শুরু করেছিলেন! ঠাকুরদা কেন যে আমার নাম দেবব্রত রাখতে গেলেন !!!! অনেক ভেবেই বোধহয়, বাপমায়েরা মেয়ের নাম সীতা বা ,রাধা রাখে না ! তবু্ও, সব মেয়ে-ই সীতা, সবার প্রতিই রাধের মতো এক অশ্লীল-সন্দেহ তৈরি হয় ! আমিও বোধহ, নাম-মাহাত্মেই আ-জীবন তাই মহাকাব্যের অভিশপ্ত পিতামহ হয়েই রয়ে গেলাম !
যাইহোক, আমি একটু বড়ো হয়েও আমাদের ভাড়া-বাড়ির দেয়ালে ঠাকুরদা-র গাই-বাছুরদের দেখেছি, একেবারেই রোগা-পটকা। সে এক ভয়ংকর সময়।সন্ধ্যার অন্ধকার নামলেই, যতক্ষণ না অফিস থেকে বাবা বাড়িতে ফিরতেন ও-ই ছোটো বয়সেও লক্ষ্য করতাম, মায়ের মুখ থমথমে হয়ে থাকতো । আমার বাবা কিন্ত, আমাদের প্রতি খুব কেয়ারি ছিলেন। নিয়মিত আমাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন। খুব হৈচৈ করে আমাদের জন্মদিন পালন হতো। বাবা ইংরেজি এবং অঙ্কে বিশেষ করে পাটীগণিতে অসম্ভব মেধাবী ছিলেন । তবে, গল্প শোনানোতে তিনি মোটেই পারদর্শী ছিলেননা। বাবার তেল-চুবচুবে কালো চুলে আমরা, অর্থাৎ, আমাদের দুই ভাই এবং দিদি বিলি কাটতে শুরু করলে বাবা দু-লাইন গল্প বলেই ঘুমিয়ে পড়তেন। বাবার মনটা ছিল একেবারেই শিশুসুলভ। সবার সঙ্গে মিশতে ভালোবাসতেন বিশেষ করে ছোটোদের সঙ্গে। কিন্তু, আমাদের সেই সহজ-সরল বাবার ভিতরে যে এতটা-ই জেদ বারুদের মতো ঠাসা ছিল সেটা বুঝেছিলাম হটাৎ একদিন। সে কথায় পরে আসছি ।
ছাত্রাবস্থায় আমার প্রিয় সাবজেক্ট ছিল ইংরেজি এবং বাংলা। বাবা চায়তেন তার তিন ছেলেমেয়ে অঙ্কতে তার মতোই মেধাবী হোক কিন্তু, আমার দাদা বাদে আমরা দু-ভাইবোনই( দিদি ) অঙ্কে ছিলাম মাঝারি বুদ্ধির । অন্যান্য সাবজেক্টে আমার দিদিও ছিল অসম্ভব ভালো। আমি সেই ছোটবেলার ( ক্লাস-ফাইভ ) থেকেই ছড়া, পদ্য লিখতাম আর, বানিয়ে বানিয়ে বন্ধুদের গল্প বলতাম। এজন্য স্কুলে আমার খুব খাতির ছিল । আমার বাড়ির সবাই ব্যাপারটা জানতেন কিন্তু, কোনোদিনই বিষয়টা নিয়ে কাউকেই গুরুত্ব দিতে দেখিনি। এতে অবশ্য আমার ভালো-খারাপ কিছুই মনে হতো না। কিন্তু, আমার সেই ভাবনাটা যে সম্পূর্ণ ভুল ছিল হটাৎ-ই একদিন বুঝতে পারলাম। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি । পোস্টঅফিস মারফত কলকাতার থেকে একটি পত্রিকা আমার নামে এসে হাজির! আহা! সে কী উত্তেজনা। সম্পাদক মহাশয়, সৌজন্যসংখ্যা পাঠিয়ে আবেদন জানিয়েছেন মাত্র ত্রিশটি টাকা পাঠিয়ে বাৎসরিক গ্রাহক হওয়ার এবং আবারো লেখা পাঠানোর জন্য । ত্রিশটাকা মানে আমার কাছ তো বটেই, আমাদের পরিবারের কাছেও তখন অনেকগুলো টাকা। সরকারি কর্মচারীদের বেতন সেই সবে একটু একটু করে বাড়ছে। বাবা অফিস থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া করার পর মা চিঠিটি বাবাকে পড়তে দিল। বাবা ভালো করে চিঠিখানি পড়ে আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, টাকা পাঠাবেন কী না। আমি না বলেছিলাম কিন্তু, মাস তিনেক পরেই বুঝলাম বাবা টাকাটা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করতেই বাবা বললেন, গ্রাহক না-হলে ওরা পত্রিকা ছাপানোর খরচ পাবে কোথার থেকে ! আমার বাবা গল্পের বই পড়তেন না,গল্প-ও বলতে পারতেন না তবুও পত্রপত্রিকার প্রতি তাঁর এইধরনের গভীর চিন্তাভাবনা সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। আমার বাবা গল্পের বই পড়তেননা ঠিকই কিন্তু, আমাদের মায়ের জন্যে প্রতি মাসে পাঁচ-ছটা বই- পত্রিকা আমাদের বাড়িতে আসত। ডেইলি নিউজপেপারও আসতো। আমরাও সেইসব অমৃতে ভাগ বসাতাম !
আমাদের বাসা-বাড়িটি ছিল দেড়খানা রুমের কোঠাবাড়ি । ছোটোটিতে মা রান্না করতো। আমাদের শোবার ঘর, পড়ার এবং খাবার ঘরও ছিল একটি-ই । একদিন দুপুরবেলা হটাৎ-ই ঠাকুরদা সেই বাসা বাড়িতে এসে হাজির হলেন। বোধহয়, সেদিন স্কুল ছুটি ছিল। আমরা তিন ভাইবোন খেয়েদেয়ে বিছানায় সবে শুয়েছি। দাদুর সঙ্গে বাবাও এসে ঘরে ঢুকলেন সঙ্গে আরেকটি লোক। ( পরে জেনেছিলাম, লোকটি দাদুর গাড়ির ড্রাইভার) দাদুকে দেখে কেন জানি না আমার মনে হল দাদুর খুব শরীর খারাপ। কথা বলতেও যেন তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। আমরা তিন ভাইবোন উঠে দাদুকে প্রণাম করলাম। তারপর, আবার বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে যেতে যেতে শুনলাম, দাদু খেতে বসে বাবাকে বলছেন , আমাদের সব জমিজমা সরকার নিয়ে নেবে ( কথাগুলো শিশু-বয়সে হয়তো এইভাবে-ই আমি শুনেছিলাম ! ) তারপর, ঠাকুরদা আর, বাবার মধ্যে কী কথাবার্তা হয়েছিল জানি না শুধু, শুনেছিলাম, বাবা ঠাকুরদাকে বলেছিলেন, ও-ই জমিজমা আমি নিতে পারব না! । আপনি বরং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চাষিদের হাতে ওদের প্রাপ্য-জমি তুলে দিন। তাতে আপনার-ই ভালো হবে।
দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে কেউ না-কি, কথা বলার সাহস পেতন না। সবাই আঁজ্ঞে আঁজ্ঞে করতো কিন্তু, বাবা যে কী করে সেদিন দাদুর সামনে বসে প্রত্যেকটি কথার অবাধ্য হয়েছিলেন সে-সব ভাবলে আজও অবাক হয়ে যাই । সেদিন বাবার কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল বাবা যেন আমার গল্পের হি-ম্যান।…কিন্তু, দাদুর জন্যেও খুব দুঃখ হচ্ছিল। কেন বাবা দাদুকে এইভাবে কথা বলছেন, এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হটাৎ, মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল।মা বললো, ওঠ, দাদু চলে যাচ্ছেন। আমাকে আদর করে দাদু সিঁড়ি দিয়ে খুব ধীরেধীরে নীচে নেমে গেলেন।দাদুর আগে আগে বাবা নামছিলেন।দূর থেকেও দাদুর মুখটা খুব শুকনো লাগছিল। কেন জানি না, আমার মনে হলো দাদু একটু পরেই মারা যাবেন। আমার কান্না পাচ্ছিল কিন্তু, তবুও আমি আমার বাবার উপর রাগ করতে পারলাম না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।