বাবা শুধু একজন মানুষ বা স্রেফ একটা সম্পর্কের নাম নয়। বাবার মধ্যে জড়িয়ে আছে বিশালত্বের এক অদ্ভুত মায়াবী প্রকাশ। সংসারে বাবা শব্দের অর্থ, দায়িত্বের গুরুভার মাথায় নিয়ে চলা এক নিঃসঙ্গ সারথী। বাবা হল সেই ব্যক্তি, যার কাছে সুখ বলতে বোঝায়, পরিবারের বাকি সদস্যদের মুখে লেগে থাকা স্বস্তির হাসি। সন্তানকে নানা বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে, তাকে নিরাপদে জীবনের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়াই হল একজন বাবার প্রধান কর্তব্য।
ছোটবেলা থেকেই গ্রামের অনেকের মুখে শুনে এসেছি যে আমার বাবা দারুণ মেধাবী কিন্তু অতি সাধারণ একজন ভালো মানুষ ছিলেন এবং জীবনের পরবর্তী সময় ভিন রাজ্যে থেকে চাকরির সুযোগ পেয়েও, সেই চাকরি তিনি করেননি। তার অজুহাত ছিল, মা মরা ছেলেকে রেখে দূরে গেলে ওকে দেখবে কে?
ফলে, পঞ্চায়তের সামান্য কাজকর্ম এবং সেইসঙ্গে বাকি গ্রামবাসীদের মতো বাবাকেও তখন চাষবাস করে আমাদের জীবিকা-নির্বাহ করতে হয়েছিল। ছোটবেলায় তাই এইসব কথা শোনার পর আমি হামেশাই একটা কথা ভাবতাম- বাবা কি খুব বোকা ছিল! তবে, কালের নিয়মে যখন নিজেও এখন দুই সন্তানের বাবা হয়েছি, তখন এটা বেশ উপলব্ধি করতে পারি যে বাবা তার ছেলের স্বার্থে, সেই মুহূর্তে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটুকুও ভাবেনি।
আজ প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো বাবা না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে। এখন আমি কেবল জীবনের বাস্তবতায় ভালো থাকার ভান করে ঘুরে বেড়াই কিন্তু বাবা-মা’হীন একটা পৃথিবীতে সত্যি কী ভালো থাকা যায়? দিনের শেষে যখন নিজের মুখোমুখি হই, তখন ওনাদের এই অভাবটা বরাবর টের পাই। বুকের ভিতর দগদগে ক্ষতগুলো কেবলই জ্বলতে থাকে৷
এখনো সেই ঘটনাটা মনে পড়লে, গায়ে শিহরণ জাগে। হ্যাঁ! বছর আটেক আগের কথা। ওই বছর গ্রামে কারোরই সেই অর্থে ভালো ফসল হয়নি, বাকি আর পাঁচজন গ্রামবাসীর মতো আমাদেরও জমানো টাকা তুলেই মহাজনদের সব ধার দেনা শোধ করতে হয়েছিল। যদিও বা তার অনেকদিন আগেই আমি স্টেশন-মাস্টারের হাতে-পায়ে ধরে একটা স্টেশন চত্বরেই নিজের জন্য কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলাম। অল্প মাইনে পেলেও, আমাদের সংসারটা কোনও মতে টেনেটুনে চলে যাচ্ছিল।
তবে, ওই মাসে চিন্তাটা আরেকটু বেড়ে গিয়েছিল। কারণ পরের মাসের প্রথমদিকেই ছিল বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব অর্থাৎ দুর্গাপূজো। নিজের জন্য কিছু না কিনলেও, বাড়ির বাকি সদস্যদের জন্য কিছু না কিছু কিনতেই হত। ফলে, সেদিন যখন কাজ শেষে মাসিক মাইনেটা নিতে বড়বাবুর ঘরে ঢুকলাম, তখন মাইনের সঙ্গে ওনাকে কিছু টাকা বেশি দিতে দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। সেই বিষয় ওনাকে প্রশ্ন করতেই, উত্তরে বড়বাবুকে বলতে শুনলাম,
– স্বপন, দুর্গাপূজো উপলক্ষে তোদের এটা বাড়তি দেওয়া হচ্ছে।
ওনার কথা শেষ হতেই, টাকাটা হাতে নেওয়ার পর যেন আমার চিন্তার অবসান ঘটল। পূজোর আগেই বাড়ির সকলের জন্য কিছু একটা অন্তত নিয়ে যেতে পারব ভেবে, আমার মনের মধ্যে খুব আনন্দ হচ্ছিল।
ওইদিন বাড়ি ফেরার আগে তাই সোজা হাটে চলে গেলাম এবং হাটের বিভিন্ন দোকান ঘুরতে ঘুরতে শেষে একটা ছোট দোকান থেকে নিজের মেয়ের জন্য একটা ফ্রক, ছেলের জন্য জামাপ্যান্ট, স্ত্রীর জন্য লাল পাড় দেওয়া একখান ছাপার শাড়ি আর বৃদ্ধ বাবার জন্য সাদা ধুতি কিনে যখন নিজের ওষুধ কেনার জন্য ওষুধের দোকানে ঢুকলাম, তখন পকেট হাতড়ে দিয়ে দেখি যে টাকাটা আছে, তা গোটা মাস সংসার চালাতেই খরচ হয়ে যাবে। এদিকে, ওষুধ না কিনলেই নয় কারণ আমার আবার হার্টের সমস্যা রয়েছে। ঠিকমতো ওষুধ না খেলে, মাঝে মধ্যে বুকের যন্ত্রণাটা প্রচণ্ড বেড়ে যায়। সুতরাং এক কঠিন সমস্যায় পরে গেলাম। কী করব ভেবে উঠতে পারছিলাম না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর, শেষে সংসারের কথা ভেবেই তাই আর ওষুধ না কিনে বাড়ি ফিরে গেলাম।
বাড়ি ফিরেই ছেলেমেয়ে দুটো দৌড়ে এসে আমার হাতে থাকা প্যাকেটগুলোর ভিতর কী আছে তা দেখার জন্য লাফালাফি আরম্ভ করল। ওদের দুজনকে কোলে নিয়ে বললাম,
– তোদের জন্য পূজোর নতুন জামাকাপড় এনেছি।
– (ছেলে বলল) তোমার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে মা তাহলে ঠিকই বলেছিল যে তোদের বাবা নিশ্চয়ই আজকে মাইনে পেয়ে তোদের জন্য পূজোর জামাকাপড় কিনতে গিয়েছে।
– (কোল থেকে দুজনকে নামাতে নামাতে বললাম) শুধু তোদের জন্যই নয়। তোদের মা, দাদু সবার জন্য কিনেছি।
তারপর ছেলে আর মেয়ের হাতে ওদের জন্য আনা নতুন জামাকাপড় দুটো বের করে দিলাম। দুজনেই সমান খুশি হল ঠিকই কিন্তু ছেলেকে লক্ষ্য করলাম জামাপ্যান্টটা ভালো করে দেখার পর সে বলল,
– একটাই জামা এনেছ, বাবা? কিন্তু পূজো তো তিন দিন।
– (পাশে ফ্রক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ছোট্ট মেয়েটা বলে উঠল) দাদা, এবার পূজোয় তুমি একটা জামা পড়ে কাটিয়ে দাও। পরের বার দেখবে, বাবা ঠিক আমাদের জন্য তিনটে করে জামা এনে দিয়েছে।
ছেলের মন খারাপের মধ্যেও মেয়ের এই অল্প বয়সে এতটা পরিপক্বতা দেখে আমার অন্তরটা খুশিতে ভরে গেল। এদিকে, আমার গলা শুনে রান্নাঘর থেকে আমার স্ত্রী বেরিয়ে এল এবং ওকে দেখা মাত্রই আমি ওর জন্য আনা শাড়িটা প্যাকেট থেকে বের করে ওর হাতে তুলে দিয়ে বললাম,
– দেখো তো গিন্নি, শাড়িটা তোমার পছন্দ হয় কিনা।
– (শাড়িটা হাতে নেওয়া মাত্রই একগাল হেসে সে বলল) দূর, আমার আবার পছন্দ অপছন্দ! রঙটা বেশ ভালো হয়েছে। এইরকম হালকা শাড়ি আমার খুব পছন্দ। তবে, খামকা এত খরচ করতে গেলে কেন? এই পরিস্থিতিতে কোনও রকমে দু-মুঠো খেতে পারছি এই ঢের।
– কী যে বলো, গিন্নি। সারাবছর যাই হোক, পূজোর সময় যদি তোমাদের সবার জন্য নতুন কিছু না আনতে পারি, তাহলে কীসের দায়িত্ব পালন করছি বলতে পারো?
– ও গো! বাবার জন্য আর নিজের জন্য কিছু এনেছ তো?
– হ্যাঁ, গো! সে আর বলতে। বাবার জন্য এই সাদা ধুতিটা এনেছি। দাঁড়াও বাবার ঘরে গিয়ে তাকে দিয়ে আসি।
কথা শেষ করেই বাবার জন্য আনা ধুতিটা হাতে নিয়ে বাবার ঘরের দিকে এগলাম এবং তার ঘরে গিয়ে ধুতিটা তার হাতে দিয়ে বললাম,
– বাবা! এবার পূজোতে এই নতুন ধুতিটা পড়ে অষ্টমীর অঞ্জলি দিও।
হাতে ধুতিটা নিয়ে বাবা আমার দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেখে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– কী হল বাবা! ধুতিটা তোমার পছন্দ হয়নি?
– (কাঁপা গলায় বাবা বলল) কে বলেছে? খুব সুন্দর হয়েছে। তবে, আমার জন্য আনার আবার কি দরকার ছিল? এই বুড়ো বয়সে নতুন পোশাক আর লাগে না রে। সন্তান, নাতি-নাতনিদের নতুন পড়তে দেখলে নিজেরও যে দিব্বি পড়া হয়ে যায়।
– না! বাবা। এতটুকু তো ছেলে হিসাবে আমি করতেই পারি। আমারও তো মন চায় তোমার জন্য কিছু করতে। সেই ছোট থেকে দেখে আসছি, তুমি কি না করোনি আমার জন্য।
– আবার পুরনো কথা তুলে কী লাভ? তা নিজের জন্য কিছু কিনেছিস নাকি সবার জন্য কিনতে গিয়ে নিজের জন্যই আর কিছু কেনা হয়নি।
– আমি আর নতুন কিনে কী করব বাবা? দিনের অর্ধেকটা সময়ই তো কেটে যায়, নয় স্টেশন চত্বর, নয়ত চাষের জমিতে। তাই খামকা নতুন জামাকাপড় কিনে ঘরের জায়গা নাই বা নষ্ট করলাম।
বাবাকে লক্ষ্য করলাম আমার কথা শেষ হতেই সে মাথা নাড়তে নাড়তে নিজের কাঠের দেওয়াল আলমারিটা খুলে একটা নতুন জামা আর আমার সেই প্রয়োজনীয়ও ওষুধের প্যাকেট আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
– আমার ছেলে যে একেবারে নিজের বাপের মতোই হয়েছে, সেটা আমি বুঝতেই পেরেছি। আর তাই কিছুটা আন্দাজ করেই তোর জন্য এগুলো সকালেই আনিয়ে রেখেছিলাম।
– (জামা আর ওষুধদের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বাবাকে প্রশ্ন করলাম) কিন্তু তুমি এতগুলো টাকা পেলে কোথায়? আর কেই বা হাট থেকে তোমায় এগুলো এনে দিল?
– (বিছানায় উঠে বসে বাবার উত্তর) অনেক কাল আগে রাজেনের বাবাকে আমি কিছু টাকা ধার দিয়েছিলাম এবং তখন ফেরত না দিতে পারলেও, গতকাল রাতে রাজেন ওর বাবার হয়ে আমাকে ওই টাকা ফেরত দিতে এসেছিল আর তখনই আমি ওকে বললাম হাট থেকে ওই টাকা দিয়ে তোর জন্য একটা ভালো জামা আর এই ওষুধগুলো কিনে আনতে। তাই আজ দুপুরে চণ্ডীমণ্ডপ থেকে ফেরার সময় রাজেন এগুলো আমার হাতে দিয়ে গেল।
ওই মুহূর্তে কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চোখ দিয়ে তখন এক নাগাড়ে জল পড়ছে, বাবার চোখ দুটোও ছলছল করছিল। আমাকে নিজের পাশে বসিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে সে বলল,
– তুই কি ভেবেছিলিস বুড়ো হয়ে গেছি বলে কিছু টের পাব না? ওরে, আমিও যে তোর বাবা। আমিও জানি, আমাদের মতো গরীব বাবাদের কত ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করতে হয় শুধুমাত্র নিজের সন্তান আর পরিবারের কথা ভেবে। অতএব যতদিন আমি বেঁচে আছি, ততদিন আমার ছেলেও পূজোতে নতুনের গন্ধ গায়ে মাখবে।
আমি আর কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। বাবার বুকে মাথা রেখে ছোটবেলার মতো কেঁদে ফেললাম। যা দেখে বাবাও ঠিক ছোটবেলার মতো করেই আমার কান্না ভোলাতে, মুচকি হেসে আমার কানে কানে বলল,
– তোর দেওয়া নতুন ধুতি পড়ে আমি যেমন অঞ্জলি দিতে যাব। তুইও পূজোর একটা দিন আমার দেওয়া এই নতুন জামাটা পড়ে, বউমা আর নাতি-নাতনি দুটোকে নিয়ে শহর থেকে ঠাকুর দেখে আসিস, কেমন?
কথাটা কানে আসতেই আমি বাবাকে দু-হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম এবং ছোটবেলা থেকে সেই না বলা কথাটা ওই মুহূর্তে বলেই ফেললাম,
– হ্যাঁ! বাবা, আমি তোমাকে বড্ড ভালোবাসি।