আলমারি গুছোতে-গুছোতে হঠাৎ একটা হলুদ খাম চোখে পড়ল সুরঞ্জনার, একটুও সময় নষ্ট না করে খাম থেকে বের করে ছোট্ট চিঠিটা এক নজরে পড়ে ফেলল। তাতে লেখা আছে,” তোমার সংগে আর চলতে পারছি না তাই চলে যাচ্ছি, তোমার মেয়ে রইল। আমার খোঁজ কোর না। ইতি, সুমিতা।”
সুরঞ্জনা অমিতের একমাত্র মেয়ে এবার কলেজে লাস্ট ইয়ার। অমিত কখনও বুঝতে দেয় নি ওর মায়ের অভাব। সুরঞ্জনার মনে পড়ে সেই সেদিনের কথা, বর্ষার দিন, যখন তার প্রথম পিরিয়ডস হোল, কোন্ ক্লাস! এইট হবে! খুব ভয় পেয়েছিল, কী হোল,কেন এমন হোল! বুঝে উঠতে পারছিল না,কাকে বলবে, কি করবে,রাধুঁনী মাসী এখনও আসে নি! অমিত কিন্তু আগেই আঁচ করেছিল, মেয়ে বড় হচ্ছে আর বড় হলে তার কি কি প্রয়োজন হবে সব আগে থেকেই ব্যবস্থা করে রাখে। তাই বিভ্রান্ত মেয়েকে কাছে ডেকে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন,”যা ঐ প্যাকেটটা তোর বইয়ের টেবিলে আছে ওটা নিয়ে টয়লেটে যা তারপর প্যকেটের ভেতরে ছবি সহ যেমনটি লেখা আছে তেমনি করে পরবি। আর মাঝেমাঝে বদলে নিবি, কেমন!” সুরঞ্জনার ভয় গেল ভেঙে। তারপর থেকে বাবা হয়ে গেল ওর বন্ধু! মায়ের জন্য মন খারাপ যে করত না তা নয় কিন্তু বাবার স্নেহ আর ভালোবাসা সে অভাব মিটিয়ে দিয়েছিল।
আসলে সেই ছেলেবেলা যখন সুরঞ্জনার বয়স দুই তখনই ওর মা ওকে ফেলে চলে যায় তারপর থেকে কাজের মেয়ের তত্ত্বাবধানে বাড়িতে বড় হয়েছে। আর পার্কে টিউশনে বাজারে সব সময়ই অমিত থাকত ওর পাশে-পাশে। এর জন্য ওকেও কম সাক্রিফাইস করতে হয় নি।বন্ধুদের সংগে আড্ডা,দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া কোন সখই বাস্তবে পূর্ণ হোল না। এমন কি অফিসিয়াল কাজেও কখনও বাইরে রাত্রি নিবাস করেনি,অমিত। তার জন্য অবশ্যি মনে কোন খেদ নেই, সে জানে সুরঞ্জনার বিয়ে বা চাকরীর পর সব ইচ্ছে একদিন না হয় পূরণ করা যাবে!
সুরঞ্জনারও এক মাত্র সাথী বল অবলম্বন বল সে ওর বাবা-ই। তাই বাবাকে সব কিছুই বলতে পারে অবলীলায়। সব বলে, কলেজে কার সংগে কি কথা হোল, কে কেমন ভাবে তাকে তাকিয়েছিল ইত্যাদি- ইত্যাদি।এভাবেই একদিন অকপটে বলে ফেলল অর্কের কথা আর এটাও বলল যে অর্ককে সে ভালোবাসে, বিয়ে যদি কখনও করতে হয়, ওকেই করবে।অমিত ওদের বাধা দেয় না কখন তবে সব সময় নজরে নজরে রাখে যাতে ওরা বিপথগামী না হয়ে পড়ে।
সুরঞ্জনার জীবনে অমিত একাধারে বাবা এবং মা। অফিস যাওয়া,মেয়েকে স্কুলে পৌছে তারপরেই। সারাদিন অফিসের খাটাখাটুনি, স্কুল থেকে মেয়েকে বাড়িতে তারপর টিউশান আবার ঘর এরই মাঝে বাজার দোকান,রান্নার ব্যবস্থা,জামাকাপড় কেনা এই ভাবেই চলে চব্বিশ ঘণ্টা। সুরঞ্জনা স্কুল জীবন পেরিয়ে এখন কলেজ।অমিতের এখন কিছুটা অবসর, ওর মেয়ে এখন নিজের কাজ এমনকি গেরস্থালির কিছু কাজ যা বাবা একা করতেন তার কিছুটা করে রাখে।
অমিত সেই ত্রিশ বছর বয়সে ডি আই অফিসে এল-ডি ক্লার্ক হিসেবে চাকরী তে জয়েন করেছিল তারপর থেকে একটানা এত বছর একই অফিসে,মাঝে একটা দুটো প্রমোশন একই অফিসে অন্য চোয়ারে। এখন বড়বাবুর পদে।সারা জীবন মাস্টারমশাইদের সার্ভিস-বুক পেনশন,গ্রাচুইটি,সেলারির কাজ করতে করতে আজ অমিত অবসরে গ্রহণের মুখে। মাস্টারমশাইরা আর সহকর্মীরা ওকে খুব ভালোবাসে ওর দায়িত্ব জ্ঞান মিষ্টি ব্যবহার আর সততার জন্য।
বিবাহিত জীবন অমিতের মাত্র সাত বছরের তারপর আর কোন মহিলাকে যে তার ভালো লাগেনি তা নয়।লেগেছ,তারই এক অবিবাহিত সহকর্মী কে।দু’জনের মধ্যে ভাব ভালোবাসা, দুই বাড়িতে যাতায়াত,ঘনিষ্ঠতা এমন কি বিয়ে করার মতো সিদ্ধান্তের কাছাকাছি পর্যন্তও পৌছে ছিল।কিন্তু বিধাতা বাধ সাধল। হঠাৎ দু’দিনের তীব্র জ্বর, ব্লাড রিপোর্ট আসার আগেই সব শেষ।ব্লাড ক্যানসার! সেদিন সুরঞ্জনার কান্না থামে না ওর বাবা-ই ওকে আশ্বস্ত করে, তিন দিনের জন্য বেড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল সমুদ্রে।
দেখতে দেখতে সুরঞ্জনার কলেজ জীবন শেষ হোল,অর্কও ওদের পরিবারের একজন হয়ে উঠেছে।অমিত দেখে ওদের ভালবাসা আর মনে মনে ভাবে ও নিজে তো জীবনে ভালোবাসা পেল না কোনদিন,ওরা যেন সুখী হয়,সুন্দর জীবন যেন ওদের হয়!
একাধারে ঘরে মায়ের দায়িত্ব আর বাবার দায় দুটো দিক সামলাতে গিয়ে অমিত কোন দিনও অফিসে কাজে গাফিলতি দেয় নি, তার জীবনে যত গুলি ডি,আই সাহেব এসেছেন প্রত্যেকেই অমিতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ঘর অফিস দু’দিক আর সুরঞ্জনাকে দেখতে গিয়ে অমিত কোনদিনই নিজের শরীরের প্রতি তেমন যত্ন নেয় নি।তবে কখনও তার বড় কিছু রোগ জ্বালাও হয়নি কিন্তু আজ অবসরের দিনে একটু যেন আড়ষ্ট,একটু অন্যমনস্ক লাগছে, ওকে! অর্ক ও সুরঞ্জনার সেটা নজর এড়াল না,ভাবল,চাকরীর আজ শেষদিন তো তাই হয়তো মনমরা! অমিত অনেকটা গড়িমসি করেই আজ অফিসে গেল।কলিগরা ফুল-মালা উপহার নিয়ে রেডি।অমিত যথারীতি হাজিরা খাতায় শেষ সই মেরে বসতে যাবে হঠাৎ বুকে তীব্র যন্ত্রণা, বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ল।কলিগরা পড়িমরি করে ছুঁটে এল ওকে ধরতে, ততক্ষণে অমিতের শরীর ঢলে পড়েছে চেয়ারে, মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে! সবাই বুঝতে পারল কী হতে চলেছে!
অফিসের পাসেই একটা নারসিং হোম ছিল ওখান থেকে একজন ডাক্তারকে ডেকে আনা হোল,তিনি অমিতের নাড়ি দেখে আর বুকে স্টেথো লাগিয়েই বললেন, “সিভিয়ার স্ট্রোক অ্যান্ড সাডেন ডেথ!” খবর পেয়েই সুরঞ্জনা এসে আছড়ে পড়ল ওর বাবার শরীরের ওপর।অমিতের এক কাছের সহকর্মী বন্ধু সুরঞ্জনাকে আস্তে-আস্তে টেনে তুলে গভীর আক্ষেপে বলে উঠল,”ইস্ মেয়েটা একেবারে একা হয়ে গেল! অমিতই ছিল ওর বাবা ও মা!”