“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় ইয়ার ইগনিয়াস

মৃতের জাগরণ
বাবা জেগে আছে। দশবছর হলো তাকে কেউ আর ঘুমাতে বলে না। শেষ ক’বছর ভুগেছে অনিদ্রা রোগে; দীর্ঘনিশি নির্ঘুম কাটতো তার। বুড়ো হলে ক্রমে মানুষ শিশুর মতো আচরণ করে; আম্মার ঘুমপাড়ানি গান না শুনলে তার ঘুম হতো না; আম্মাও বিনা অনুযোগে প্রতিদিন গণনাহীন ঘুম পাড়ানি গান শুনাতো তাকে। কোনো কোনোদিন গান শুনে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ত বাবা, আবার কোনো কোনো দিন ঘুমাতো না, ঘুমাতে পারত না; অবাধ্য ছেলের মতো বাইরে বাইরে থাকতো রাজ্যের ঘুম, দুই চোখের নীড়ে কখনো আসতে চাইত না; শেষে আম্মা ব্যর্থ হয়ে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে আরও রাত নামাতে চেষ্টা করতো, তবুও তার ইনসমনিয়া ঘোর কাটত না।
কতো কতো বডি রিল্যাক্সেশন ম্যাসেজ! কতো কতো ইনজেকশন দিয়ে বাবাকে ঘুমিয়ে রাখা হতো! অথচ বাবা একদিন কোনো প্রভাবক ব্যতিরেকে সত্যিকার অর্থেই ঘুমিয়ে গেল। তখন, সবাই তার ঘুম ভাঙাতে ব্যতিব্যস্ত। চারদিকে কান্নার শোর। একপাশে কুরআন তিলাওয়াতের সুমিষ্ট স্বর। না, কিছুতেই ভাঙবার নয় তার ঘুম। যেন চোখের পাঁপড়ি উপর প্রভু তুলে দিয়েছেন অন্য এক হিমালয়।
পরে খড়জ্বালানো গরম পানিতে তার অন্তিম স্নান, তবুও তার ফেরেনি সম্বিৎ। মৃত্যুশকটে করে তাকে চড়ানো হয় দীর্ঘপথ; পথজুড়ে দোয়া ও দরুদ শুনানোর ব্যর্থ কায়দা শেষে
তাকে রেখে আসি গোরস্তানের সবুজে ।
সেদিন কবরে তুমুল তিমিরের তীক্ষ্ণ তীরে বাবা জেগে ওঠেন। আজতক ঘুমাননি।
ক’নটিক্যাল দূরত্বে তার রেখে যাওয়া পরম্পরা। কোনো এক অজানা অভিমানে তার আর ফেরা হয় না ঘরে। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় বুকে নিয়ে বাবা নিজেই এক মহৎ মৃত্তিকা। রাত হলে অন্ধকারের শরীরে সর্পিল পেঁচিয়ে থাকে। দিনে আলোর রশ্মিতে বাঁদুড় ঝুলে পৃথিবীর দিকে ঘৃণা ভরে তাকায়। এখন পৃথিবীতে মসজিদে, চার্চে, প্যাগোডায় হামলা হয় আমি আতঙ্কে থাকি কখন আবার কবরে শ্মশানে গ্রেভইয়ার্ডে হামলা করে বসে! কখন যেন, পরকালের শাস্তি দিতে আসে ধর্মান্ধের দল!
বাবা সাবধানে থেকো।
আমাদের গোরস্তানের পাশেই একটা ছোট নদী বয়ে গেছে, কতকাল ধরে। পৃথিবীর সব গোরস্তান, শ্মশান বা গ্রেইভইয়ার্ডের পাশে এমন একটা নদী সুশোভন। যেন স্বজনের কান্না মিশে যেতে পারে সেই নদীর জলে। তারপর সাগরে মিশে গর্জে ওঠবে, আর্দ্র করে দেবে আরশের আবহাওয়া। আর কিছু জল মৃতদের তৃষা মেটাবে। বাবা যখন তুমুল তৃষিত হন, স্বপ্ন এসে ডমরু বাজিয়ে যায়; আমরা তার কবরে গিয়ে কেঁদে আসি। আমাদের অশ্রু পান করে বাবা বেঁচে থাকে, জেগে থাকে…