রুমার প্রতিজ্ঞা
বড়দি চশমার ভিতর দিয়ে কঠোর চোখে তাকালেন রুমার দিকে। ভয়ে পা কাঁপতে লাগল ঠকঠক করে রুমার।
“আজ সাদা ড্রেস তুমি জানো না? তোমাকে নাকি মহুয়া ম্যাম এর আগেও তিনবার ওয়ার্নিং দিয়েছেন ? কি ব্যাপার ?”
“ম্যা… ম্যাম, সা… সাদা ড্রেস নেই আমার” – চোখে জল চলে আসে প্রায় এটুকু বলতেই।
“নেই ? নেই মানে ? বাবা মাকে বলোনি ?”
“নেই ম্যাম” – ঝরঝর করে এবার কেঁদে ফেলে রুমা।
“আরে একি? সাদা ড্রেস পরা স্কুলের নিয়ম, তোমার বাবা মা সেটা জানেন না ? নেই বলে কাঁদলে হবে ?”
“বা… বাবা মা নেই ম্যাম”, দু’হাতে মুখ ঢেকে ফোঁপাতে থাকে রুমা।
কতক্ষণ জানে না, মাথায় নরম স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখে বড়দি। কিন্তু মুখটা এত অচেনা কেন! এত নরম দৃষ্টি ! ক্লাসে যা – মৃদু স্বরে বললেন বড়দি, গলাটাও যেন চিনতে পারলো না রুমা। বড়দির ঘর থেকে বেরতে বেরতে রুমা শুনতে পেলো বেলের আওয়াজ আর পরক্ষনেই শিবুদা দৌড়ে গেল বড়দির ঘরের দিকে।
স্কুল ছুটির পর এই শিবুদাই মামার নামে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল রুমার হাতে, হেড মিস্ট্রেস অনুভা দত্তের ছাপ দেওয়া। গোল রাবার স্ট্যাম্পের ছাপটা রুমার কাছে অশনি সংকেতের মত মনে হলো। আবার চোখ ফেটে জল এলো রুমার, মামা পিঠের ছাল তুলে নেবে আজ।
মায়ের নাম ছিল রাণী। নামেই রানী, আদপে শুকনো বিবর্ণ আগাছার খসে পড়া পাতার মত খড়খড়ে একটা জীবন বয়েছে বেচারী যতদিন বেঁচে ছিল। তারই উত্তরাধিকার বুঝি দিয়ে গেছে একমাত্র মেয়ে রুমাকে। বাবাকে হারিয়েছে আট বছর বয়েসে। তার আগেও বাবার ভালোবাসা পায়নি অবশ্য এক ছটাকও। যেটুকু স্মৃতি আছে বাবা আর ঠাকুমার, তাতে খালি মেয়ে বলে শাপশাপান্তের বন্যা। রুমার মা রুমার ঠাকুমাকে বিড়বিড় করে গাল পাড়তে পাড়তে কেবলই বলতেন- মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু।
মনে আছে বাবার আকস্মিক মৃত্যুর খবরে মা যখন ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন, রুমা কেমন যেন একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলেছিল। ওই বয়সে বাবা-হীন ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে তা বোঝার ক্ষমতা ছিল না। সেটা বুঝতে বুঝতে আরো পাঁচ বছর পার। বাবা নামক গাছতলার ঠাঁই ছেড়ে ততদিনে মা মেয়ে মামাবাড়ির ফুটো নৌকোতে আশ্রয় নিয়েছে। ভাইএর বাড়িতে ভিখিরির মত জীবন নিয়ে রাণী নামের প্রতি অবিচার বেশি দিন অবশ্য করেননি রুমার মা। গত বছর এক বর্ষার সন্ধ্যেতে তের বছরের রুমাকে নিজের জীবন নিজের মত বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে পরপারে স্বামীর সাথে মোলাকাত করতে চলে গেছেন তিনি।
ওখানকার হিসেব নিকেশ তিনি কতটা কি বুঝে নিতে পারলেন জানা যায়নি, তবে রুমার জীবন বেহিসাবি রকমের এলোমেলো হয়ে গেল। নেহাত লোকলজ্জার ভয়ে ওকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারেনি মামা। স্কুলও ছাড়াতে পারেনি। তবে, না বইপত্র, না স্কুলের ইউনিফর্ম – কিছুই আর কিনে দেননি। যা ছিল তাই দিয়ে এক বছর চলেছে। এখনও নীল ড্রেসটা আছে। সাদাটা আর পরার মত নেই। মামা দেবে তো নাই-ই, তার উপর এই চিঠি।
রুমা তারপর দু’দিন আর স্কুলে যায়নি।
তিনদিনের দিন শিবুদা এসে মামাকে ডেকে নিয়ে যায় স্কুলে। রুমার দিকে বিষদৃষ্টি হেনে শিবুদার সাথে মামা গিয়েছিল, ফিরেছিল কিন্তু হাসি মুখেই। কি হয়েছিল সঠিক জানে না রুমা। শুধু পর দিন থেকে তাকে আবার ঠাঁই বদলে চলে যেতে হয় বাঁকুড়ার এক আবাসিক বিদ্যালয়ে। সেখানেই টুয়েলভ্ পর্যন্ত। পড়াশোনাটা মন দিয়েই করত রুমা। দুবেলা পেট ভরে ভাত, পরনের জামাকাপড়, বইপত্র, দরকারে ওষুধ, সবই পেত। সেখান থেকেই নার্সিং পড়ার সু্যোগ। সেটাও আবাসিক। স্কলারশিপ পেয়েছিল, তবু জামা কাপড় আর আনুসঙ্গিক খরচ তো আছে। কিন্তু কোন কিছুরই অভাব হয়নি আর। যেমন হয়নি বাঁকুড়াতেও। রুমা জানত, আন্দাজ করেছিল কোথা থেকে আসছে সেই সব খরচ। তাই নার্সিং পাস করে সরকারী চাকরিটা পেতেই সোজা চলে গিয়েছিল অনুভা দত্তের বাড়ি। তখন তিনি রিটায়ার্ড্ কিন্তু মেরুদন্ড সেই রকমই সোজা। কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা তার যোগায় নি। পায়ের কাছে বসে কেবল অঝোরে কেঁদে ছিল। সেখান থেকে তুলে মাথায় হাত রেখেছিলেন ভগবানের মত মানুষটা। বড়দির কাছে শেষ বারের মত একটা অনুগ্রহ চেয়ে নিয়েছিল রুমা।
চারটে মেয়েই এবার নব্বই শতাংশের উপর নম্বর পেয়েছে উচ্চমাধ্যমিকে। রুমার আনন্দ আর ধরে না। বড়দিও খুব খুশি। এখন আর বাড়ির বাইরে বেরোন না তিনি। ওরাই বড়দির বাড়ি গিয়ে প্রণাম করে এসেছে। বড়দি সবার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেছেন। আর মনে করিয়ে দিয়েছেন ওদের প্রতিজ্ঞা। বড়দির সহায়তায় রুমা এই চারটি অনাথ নিঃসম্বল মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছে। ওরা পড়ছে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে একদিন। দাঁড়াবেই – সেই অঙ্গীকার রুমার। আর ওদের প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই প্রত্যেকে আরো চারটি এই রকম মেয়ের জীবন গড়ে দেবে। তারাও একই প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগোবে। নিজের জীবন রুমাকে শিখিয়েছে – মেয়েরা মেয়েদের শত্রু নয়, মেয়েরাই পারে মেয়েদের জিতিয়ে দিতে। সেই অঙ্গীকার নিয়েই সে বাকি জীবন লড়ে যাবে। লড়াই এর সাহস জুগিয়ে যাবে।