• Uncategorized
  • 0

“নারী-দি-বস” উদযাপনে রিমি মুৎসুদ্দি

দ্রৌপদী না দুঃশাসনঃ  রাস্তা তাহলে কার?

In what language does rain fall
over tormented cities?- Pablo Neruda
পথ যেমনই হোক, একটা ঝকঝকে রাস্তা হয়ত মোরাম বিছানো, হয়ত বা পলাশের বেগুনি ঝিলিক হয়ত বা শুধুই পিচগলা। উঠতি পড়তি ঝড়তি নানাবিধ স্মৃতির ম্যাপে একটা রাস্তাও ঠিক এঁটে চেপে অনেক আগেই বসে থাকে। আমরা টেরও পাই না। আবার যাদের স্মৃতিতে রাস্তা বলতে শুধুই মুহূর্তের মনপাখি নয় বরং একটা অকারণ আতঙ্ক অথবা অনেকটা ক্ষত জুড়ে রয়েছে তাদের সেইসব ক্ষতস্থানে প্রলেপ কি আদৌ পড়েছে? খোদ রাজধানীতেই রাস্তার ছবিতে এখন আর আগুনের কুচি নয় দাউদাউ আগুনই জ্বলে চলেছে অনবরত। কোথাও আবার পিচ গলা রাস্তায় রক্তের ছিঁটে। রাস্তা যদি নিজেই নিজেকে লিখতে পারত তাহলে হয়ত একদিন ঠিক লিখে ফেলত, লেখো অশ্রু লেখো বিষাদ লেখো মৃত্যু…অথচ আয়ু লিখবে ভেবেই রাস্তা একদিন বৃষ্টি রেখার চিহ্ন জমা রেখেছিল। 
একদিন নারীর কাছে অর্ধেক বা পুরো আকাশের কল্পনাও ছিল না। তারপর অন্ধকার ছেনে উনিশ শতক থেকে ফিল্টারড ‘আলো ক্রমে আসিতে লাগিল’। এরপর আকাশটা যেন কখন টুক করে তার ঘরদোর উঠোন সবকিছুর মধ্যে ঢুকে পড়তে লাগল। আর এই একুশ শতকে আজকের নারী আকাশটাকেই নিজের সঙ্গী করে পারি দিয়েছে দূর থেকে দূরান্তরে। কিন্তু আকাশ তো চিরকালই ছায়াসঙ্গী। ঠিক যেন এই ভার্চুয়াল জগতের মতো। আছি আছি অথচ নেই। 
তাহলে কী রয়ে গেল? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে নিশ্ছিদ্র প্রহরা অথবা খুব বেশী সাবধানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে কি? বরং একটু ঘুরে ফিরে দেখাই যাক। না না, কোনও অন্দর অলি গলি দিয়ে নয়। বরং একটা বড় রাস্তা ধরেই শুরু হোক যাত্রা।  
“অমৃত পানেতে যেন ভরিল উদর
ঘৃত মধু শর্করাতে নাহি পরিতোষ
মায়ের দুগ্ধেতে যত না হয় সন্তোষ।।
ততধিক তৃপ্তি ইথে ঘুচে অবসাদ
কী মধুর দুঃশসাসন রুধির আস্বাদ।।”
‘দুর্যোধন কর্ণবীর দেখে বিদ্যমান
ভীমসেন করে দুঃশাসন রক্ত পান।।’
-কাশীরাম দাস, মহাভারত, অষ্টাদশ পর্ব 
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুঃশাসন সদ্য নিহত। ভীম পান করেছে তার বুকের রক্ত। এরপর ভীমের উক্তি-
“ঘি মধু মিষ্টান্নতেও যে তৃপ্তি নেই। এমনকি মাতৃদুগ্ধও যে সন্তোষ দিতে পারেনি অমৃতসমান দুঃশাসনের রক্ত সব অবসাদ ঘুচিয়ে দিল। এমন মিষ্ট এমন স্বাদু আর কখনও খাইনি।”
মহাভারতে পাপপুণ্যের বিভিন্ন সংজ্ঞা ও পূণ্যের ফললাভ, পাপের শাস্তি বিভিন্ন ঘটনায় কাহিনীতে বর্ণিত। কিন্তু বুক চিরে রক্ত পানের মত শাস্তির চরমতম রূপ দেখেছি দুঃশাসনের ক্ষেত্রে। আর সেই শাস্তি দেওয়ার কাজটা করেছে ভীম। এখান থেকেই বোঝা যায় নারীর সম্মান কতটা গুরুত্ব পেয়েছিল প্রাচীন ভারতবর্ষে। প্রায় পাঁচহাজার কি তারও আগে আনুমানিক কোনও সময় মহাকবি বেদব্যাসের কলম নারীর সম্মানকে গুরুত্ব দিয়ে সমগ্র বিশ্বের দরবারে ভারতের এক অনন্য রূপ ও বৈশিষ্ট্য স্থাপন করেছে। কিন্তু আজকের ভারতবর্ষ সম্পূর্ণরূপে বদলে গেছে। আজকের নির্ভয়াকে শরীরের ভেতরে রড ঢুকিয়ে খুন করা ক্রিমিনালদের একজন নাবালকত্বের দোহাই দিয়ে নিজের নাম পালটে আরামের জীবন যাপন করতে পারে ভারতের অন্যত্র। প্রশ্ন জাগে, একটি মেয়ের শরীরে লোহার রড ভরে দিয়ে যে আনন্দ উপভোগ করতে পারে সে নাবলক কোন যুক্তিতে? 
আর এভাবেই কি ধর্মের সঙ্গে ধর্মের লড়াইয়ে, ভাষার সাথে ভাষার লড়াইয়ে বারবার মেয়েদের হাড়িকাঠে তোলা হচ্ছে? বোড়ে করা হচ্ছে মেয়েদের? আর তার প্রতিবাদে এগিয়ে আসা দূরস্থান, জাতি ধর্মের দোহাই দিয়ে এই অপরাধগুলোই প্রশ্রয় পেয়ে আসছে? 
বর্ধমান হাসপাতালে একবার ডাক্তারদের ওপর নিগ্রহ নিয়ে সংবাদপত্র মিডিয়ায় হইচই হল। কিন্তু বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের তরুণী জুনিয়ার ডাক্তারদের যেভাবে পুরুষাঙ্গ দেখিয়ে ভয় দেখানো হল, এসিড ব্লাব মারবে বলে ভয় দেখানো হল তার নিন্দা হাজার অক্ষরেও করলেও কি যথাযথ শাস্তি হল সেই দুষ্কৃতীদের?
মডেল ঊষসী সেনগুপ্ত এই সেদিন বাড়ি ফিরছিলেন কাজ সেরে। যে কাজ শেষে কাল আমি ফিরতে পারি। আপনি ফিরতে পারেন। আমার আপনার বাড়ির যেকোনো মেয়ে ফিরতে পারে। যারা সেলিব্রেটি নয় নেহাতই সাধারণ মানুষ। সে হয়ত কাজ করে কোনও মিডিয়াতে, সে হয়ত চাকরি করে কোনও বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে। রাত্রে কাজের শেষে একটু গরম ভাত, আলুসেদ্ধ ঘি আর বাড়ির বিছানাটার দিকে এগিয়ে যেতে চেয়ে সে হয়ত কোনও ভাড়ার ট্যাক্সি করে ফিরছে। আর উন্মত্তবেগে সেই ট্যাক্সিকে ঘিরে ধরল মাথায় হেলমেট না পরা সাত আট বারো চোদ্দ ছয় পনেরোজন উন্মাদ কিশোর যারা পৃথিবীর সব আইনকে পায়ে দলে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। 
ঊষসীর কথা সংবাদপত্রে পড়ে প্রতিটা মেয়ের হাড় হিম হয়ে আসেনি? আমরা যারা প্রবাসে থাকি আর বাংলা সাহিত্যে নিঃশ্বাস নিই। যারা প্রতিদিন অন্তত দশবার করে ভাবি কলকাতায় ফিরে যাব, কফিহাউসে কালো কফিতে চুমুক দিয়ে মেতে উঠব কামু কাফকা কিংবা সন্দীপন মানিকের কোনও ডিসকোর্সে তাহলেও রীতিমতো আতঙ্ক হয় এটা জেনে যে ঊষসী ওই আক্রান্ত অবস্থায় তিন তিনটে থানায় পুলিশের কাছে ছুটে গেছেন এবং ওই তিনটে থানাই তাকে রিফিউস করেছে। এক্ষেত্রে মনে পড়ে যায় সেক্সপিয়ারের সেই অনবদ্য লাইন। জুলিয়াস সিজার-এ কাসকা ক্যাসিয়াস, ব্রুটাস এবং রোমের সমস্ত সেনেটারদের সিজার সম্পর্কে বলছেন, “Thrice he was offered the crown and thrice he refused”। জুলিয়াস সিজার তিনবার রাজামুকুট প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু আমাদের ভেবে বিস্ময় ও অবসাদ দুটোই জাগে। কারণ, আজকের শাসক রাজারমুকুট অস্বীকার করছেন না। কিন্তু রাজদণ্ডটাকে হাতে তুলে নিতে অস্বীকার করছেন। রাজার দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করছেন। একটি মেয়ে যে অসহায় ও একই সাথে আক্রান্ত এবং সে যখন ছুটে যাচ্ছে পুলিশের কাছে সাহায্যের জন্য অথচ পুলিশ তাকে সাহায্য করতে অস্বীকার করছে? জুরিসডিকশনের দোহাই দিয়ে? 
ওই লুম্পেনগুলো সেদিন ঊষসীকে অনুসরণ করে তার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল। দেখে রাখতে। এই ঊষসী যদি সেলিব্রেটি না হতেন, আমার আপনার মত নেহাতই সাধারণ কোনও মেয়ে হতেন তাহলে পরদিন খবরের কাগজে এই খবরগুলো থাকত না হয়ত। ওই ছেলেগুলো আবার ফিরে যেতো ওর বাড়ির কাছে। লোহার রড অথবা এসিড ব্লাব হাতে। এবং সেক্ষেত্রে সংবাদপত্রের পাতায় আমরা শুধু একটি মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর অথবা আক্রান্ত হওয়ার খবরটুকুই পড়তাম? 
আমরা যারা ঊষসী নই কিংবা হয়ত ঊষসী। আমরা যারা মেয়ে আমরা যারা নিরাপত্তা চাই বা যারা বাংলা ভাষাকে ভালবাসে কিংবা বাংলা সংস্কৃতিকে ভালবাসে নিঃশ্বাস নিতে চাই বাংলার পরিসরে তারা নির্বাক দর্শক হয়ে টিভির পর্দায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় অথবা সংবাদপত্রের পাতায় এই খবরগুলো দেখতে থাকি আর ঊষসী সেনগুপ্তকে নিগ্রহ করা, তার ড্রাইভারকে হেনস্থা করা সেই ক্রিমিনালগুলোর জামিনপ্রাপ্তি ও তাদের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য ধারায় নরম করে মামলা সাজানোকে চরম ধিক্কার জানানো ছাড়া অন্য উপায় খুঁজে পাই না। রাস্তা কি আমাদের জন্য শুধু আতঙ্কই রেখে গেল শেষমেশে? 
নির্ভয়া থেকে আসিফা প্রতিটা জীবন অকালে ঝরে পড়ার পরও অপরাধীদের জামিন আসলে অনেকগুলো রাস্তা বন্ধ করে দেয়। ভাইফোঁটার সময় মেয়েরা বলে, “ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ যম দুয়ারে পড়ুক লোহার কাঁটা।” এই জামিন সমস্ত মেয়েদের সে ব্যাঙ্গাগালোর হোক, দিল্লি হোক, মুম্বাই হোক, অ্যামেরিকা হোক তাদের সকলেরই বাড়ি ফেরার পথে একটা লোহার কাঁটা বিছিয়ে রাখল। তারা জানল যে, যেকোনও প্রয়োজনেই রাত্রি এগারোটার সময় বাড়ি ফিরলে যে কোনোদিন সাতটা লুম্পেন, সাতটা বাইক আর কতগুলো হেলমেটহীন মাথা তাদের তাড়া করতে পারে। এই তেড়ে আসা ভয়ের শহরই আমাদের ফিরে আসার স্বপ্নে এখন তাড়া করবে। এই স্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি চাই। যে শহরে কঠোরতম শাস্তি এই লোকগুলোর জন্য অপেক্ষা করছে, যারা একটা গরীব ড্রাইভারকে নির্মমভাবে প্রহার করে হয়ত আগামীদিনে উবের চালানোর মতো একটা পেশা থেকেই দূর করে দিতে পারে। সেই দুর্বৃত্তদের জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা শুধু নয় কঠোর শাস্তির অপেক্ষায় আজ সারা ভারতবর্ষের এবং বিশ্বের প্রত্যেকটি মেয়ে তাকিয়ে ছিল একদিন। 
মেয়েদের ওপর যারা এইরকম আক্রমণ করে সেইসব লুম্পেনদের ছেড়ে দেওয়া মানে ঝুড়ির ভেতর থেকে সাপটাকে বাইরে ছেড়ে দেওয়া। হয়ত প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যাবে, “ভয় পাচ্ছ কেন? ওরা তো নাচ দেখাবে, ওরা তো গান শোনাবে। মন ডোলে তেরা তন ডোলে।” কিন্তু আমরা জানি সাপ ঝুড়ির মধ্যে থাকলে নাচ দেখাতে পারে। ঝুড়ির বাইরে বেড়িয়ে এলে সে কেবলমাত্র ছোবলই দেয়। সেই ছোবলের হাত থেকে মুক্তির জন্য সেই বিষের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য আমরা ওই সাতটা দুর্বৃত্তকে এবং ওই সাত গুণ সাতশো আরও দুবৃত্ত যারা সারা কলকাতা শহর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের গ্রেপ্তার এবং কঠোর আইনে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার দাবী জানানো ছাড়া আর অন্য উপায় কিন্তু ছিল না। ওদের রাস্তায় ছেড়ে দিলে আসলে সমস্ত মেয়েদেরই বাড়ি ফেরার রাস্তাটুকুও বন্ধ করেই দেওয়া হয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।