সোনা ধানের সিঁড়ি
৩০
তারকেশ্বর লাইন। মালিয়া স্টেশন। ট্রেন থেকে নেমেই মনটা ভরে গেল। চারপাশ সবুজ। খোলা মাঠ। যেদিকেই তাকাই চোখ জুড়িয়ে যায়। যখন নামলাম তখন ঘড়িতে চারটে বেজে পনের। বেশ খানিকটা সময় বসে রইলাম চুপচাপ। কখনও স্টেশনটা দেখছি। কখনও দেখছি স্টেশনের চারদিক। এইসব জায়গায় এলেই একমাত্র মনে হয় সব কথা যেন বলা হয়ে গেছে। মনে হয় বোকারাই যেন কথা বলে। প্রকৃতির মতো মিতভাষী আর কে আছে ! নিঃশব্দে যেন সে কাজ করে যাচ্ছে । কথা বলতে গেলে তো ফাঁকি হয়ে যায়। আর তাছাড়া কিসের এতো কথা বলা। আমি তো নতুন কিছু বলতে পারব না। যা বলব তা যেন প্রকৃতি আগেই ছড়িয়ে রেখে দিয়েছে।
মাঠের আল ধরে হেঁটে গেলাম। মুরগি, হাঁস, গরুর পাশ কাটিয়ে গিয়ে উঠলাম একটা প্রাইমারি স্কুলে। খুবই আন্তরিক ওখানকার মানুষজন। কবিতা পাঠ হল। অনুষ্টানের শেষে মুড়ি আর ফুলুরি। কী দারুণ তৃপ্তি করে খেলাম। এই খাওয়াটাই যদি আমার শহরে হতো তাহলে মোটেই এই আনন্দ পেতাম না।
অনুষ্টান শেষ করে যখন স্টেশনে এসে পোঁছলাম তখন চারপাশে অন্ধকার নামছে। দূরে একটা মাঠে কিছু ছেলে দলবেঁধে ফুটবল খেলছে। ওই দলের মধ্যে আমি যেন আমাকেও দেখতে পেলাম। একটু পরেই বাড়ি ফিরব। বাড়িতে ঢোকার আগে পুকুরে নেমে হাত পা ধোব। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই দেখব, বাবা দুয়ারে বসে পুঁথি লিখছে আর মা রান্নাচালায় বসে সন্ধের চা তৈরি করছে। সম্বিত ফিরলে দেখলাম চোখের কোলটা কখন যেন ভিজে গেছে।
৩১
আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা শীতকালের পুরোটাই ঘুড়ি উড়িয়ে কাটাতাম। নভেম্বরের শেষ অথবা ডিসেম্বরের শুরুতে আমাদের বাৎসরিক পরীক্ষা হয়ে যেত। এরপর দুপুর বিকেল জুড়ে চলত আমাদের ঘুড়ি ওড়ানো। একসঙ্গে অনেকজন মিলে নয়। দুজন কি চারজনে আমরা কিছু খেয়েই বারোটা নাগাদ ধান কাটা মাঠে নেমে পড়তাম। একটু দূরে দূরে আমরা বসে পড়তাম যে যার নিজের নিজের ঘুড়ি নিয়ে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিশ্বাসই করতে চাইবে না যে, আমরা ঘুড়ি ওড়াতাম অথচ কাটাকাটি খেলতাম না। এইভাবেই আমাদের মনে ছোটবেলা থেকেই কেটে দেওয়া, ছিঁড়ে দেওয়া প্রভৃতি বিষয়গুলো স্থান পায় নি।
ক্রমশ…