• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুব্রত বসু (পর্ব – ১০)

আমার নাটক, নাটকের আমি

শেষ পর্ব

অনেক কথাই তো বলা হল নাতুলসী লাহিড়ির  ভিত্তি নাটকে মূল চরিত্রে লালুদার অভিনয় কোন স্তরে উঠেছিল।ভীষণ শক্ত  নেগেটিভ চরিত্র।  বলা হল না একান্ত আড্ডায় তাঁর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম  রসিকতার কথা।   মনোজ চট্টোপাধ্যায়ের লোকটা নাটকে অভিনয়ের কথা, ওহেনরীর কপ এ্যান্ড দ্য এনথেম কাহিনী অবলম্বনে লোকটা। একটি ভবঘুরে লোককে রিপ্রেজেন্ট  চ্যাপলীনের ভঙ্গিতে। মুব্বাই এবং এলাহাবাদের প্রতিযোগিতায় অনেকগুলি পুরস্কার পেয়েছিলাম আমরা।  শ্যামল ঘোষের নাটোৎসবে  পরপর আটদিনে চোদ্দ নাটকে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে  অভিনয়ের কথা। বুবুর গান ও ধনঞ্জয় বৈরাগীর ভূমিকায় অভিনয়ের কথাআমি চলে গেলাম পুলিশের চাকরী নিয়ে নদীয়া জেলায়। মনোজ চট্টোপাধ্যায়  দল ছেড়ে দিলমনোজদা(মনোজ গুপ্ত)খুন হল অজ্ঞাত কারণে । নট-রঙ্গএর ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ল। লালুদা সুমনদার( চৌধুরী) দের পঞ্চম সওয়ারে কিছুদিন অভিনয় করেছিলেন। সুমনদা বারে বারেই বলেন শিখন্ডী নাটকে প্রেতের ভূমিকায় তাঁর দুধর্ষ  অভিনয়ের কথা।সে নাটক আমার দেখা হয়নি, নাট্যকার রমেন লাহিড়ীর সাথে একান্ত আলাপচারিতার সাক্ষী থাকার কথা বলেন।  জানিনা তিনি কোথাও এটা লিপিবদ্ধ করবেন কিনা। দেখা হয়নি হদিশভূত অদ্ভূতদিবানিশি।
আজ নটরঙ্গ তাঁর উপযুক্ত ছেলে সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের  হাতে,লালুদার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে চলেছে সোহনের হাত ধরে,   সে নিজে নাটক লিখছে,  তার পরিচালনায় নতুন করে সধবার একাদশী নাটক অভিনীত হচ্ছেনাটকটি বিনির্মান করে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।  সোহন নিজে অভিনয় করছে নিমচাঁদের চরিত্রেবলতে দ্বিধা নেই এটি তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়। বর্তমানে নট-রঙ্গ কলকাতার বুকে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। 
অনেক কথাই বলার মত নয় নন্দিনীশেষ জীবনে লালুদার  একলা হয়ে যাওয়া। যখনই হাওড়া গেছিওনার সঙ্গে দেখা না করলে একটা অপরাধবোধ কাজ করতযখনই দেখা করতে গেছিবারে বারেই বলতেন আর কেউ দেখা করতে আসেনা। বুঝতে পারতাম একাকীত্বে ভুগছেন।  মোটামুটি ভাবে যখন সুস্থ ছিলেননাটক থেকে সরে আসতে চাইছিলেনশারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে নাটক করতে চাইছিলেন না। চোখের দৃষ্টি কমে আসছিল গ্লুকোমায়। বইপত্র পড়া বা টিভিতে কোন অনুষ্ঠান দেখা কোনটাই সম্ভব হত না। ওইরকম একটি প্রাণ চঞ্চল মানুষ ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন।
উপরোক্ত অধ্যায় একটি জীবনের খণ্ড চিত্র মাত্র।যাঁরা তাকে দেখেননি তাঁর সান্নিধ্য আসেননি আমার এই অন্ধের হস্তী দর্শণের মত খাপছাড়া বর্ণনায় সেই মানুষটিকে কতখানি অনুধাবন করতে পারবেন জানিনাযদি কোন আভাস দিয়ে থাকতে পারি তবে জানব আমার এই প্রচেষ্টা সার্থক। 
(৩)
 সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের (লালুদা) মত একজন ছিলেন বলেই আমাদের যৌবনকাল হয়ে উঠেছিল অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় একেবারেই আলাদা। সেই স্মৃতি রোমন্থনের স্বাদ হার মানাবে যে কোন দামী মদের নেশাকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় স্বর্ণ পদকের অধিকারী হয়েও সেই কৃতিত্বকে অবহেলায় দূরে সরিয়ে রেখে নাটক থিয়েটার আর আমাদের মতন অর্বাচীনদের ঋদ্ধ করার আনন্দে মেতে রইলেন সারাজীবন। আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে জানিনা কোন এক মাহেন্দ্রক্ষণে যে আলোক স্পর্শ পেয়েছিলাম সেই মূলধন সম্বল করে এক অজানা উপগ্রহের মত আবর্তিত হচ্ছি জীবনের কক্ষপথে আজও। কাউকে বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না কত সকাল কত সন্ধ্যা কেটে গেছে তাঁর অমূল্য সাহচর্ষে। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়সম্মানিত বোধ করি যে এই স্তরের একজন অভিনেতার সঙ্গে মঞ্চ শেয়ার করেছিতাঁর নির্দেশিত একাধিক নাটকে অভিনয় করেছি। সে বড় সুখের সময় ছিল এই অকিঞ্চিৎকর জীবনে প্রায় বত্রিশ বছর পুলিশে চাকরী করার পরও যদি সামান্য মানসিক উন্নতি ঘটে থাকে তা সম্ভব হয়েছিল তাঁর প্রভাবে। কারণ তিনি তো শুধু আমার নাট্যশিক্ষাগুরু ননএকাধারে দায়িত্বশীল অভিভাবকঅন্যদিকে পরম বন্ধু।অনেক কথাই তো বলা হল না এই স্বল্প পরিসরেহিমশৈলের চূড়াটুকুর ছবিও যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে পারলাম না।বারে বারেই আবেগে গলা ধরে আসছে,স্মৃতি ভারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে মনফলে ব্যহত হচ্ছে চিন্তা। ক্ষমা করবেন আমাকে। অনেক ঋণ তো শোধ করা যায় নাপ্রাণভোরে স্বীকার করে নিতে হত। লালুদার কাছে আমার সেই ঋণ।
২০১৮ সাল থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু মানুষের না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার যে মহা মিছিল চলছিল,এই ২০১৯ এর মার্চ মাসের ১৮ তারিখে তিনিও যোগ দিলেন।বৌদি আগেই চলে গেছেন ।আমার আর কোন তাগিদ নেই । ভারাক্রান্ত হৃদয়ে এই বিচ্ছেদ মেনে নেওয়ার সাথে সাথে একটা কথাই মনে হচ্ছে যে আত্মিক টানে তিনি আবদ্ধ করে রেখেছিলেন তা তো ছিন্ন হবার নয়দেখা আমাদের নিশ্চয়ই হবেপ্রতীক্ষায় থাকব সেই অতীতের সেই সোনালী দিন গুলি ফিরে পাবার আশায়। আবার সস্নেহে মাথায় হাত রাখবেনপরশমণির পরশে ধন্য হব।স্মৃতি রোমন্থনেই কাটিয়ে যাব জীবনের বাদবাকী দিনগুলি। ভাল থাকবেন লালুদা যেখানেই থাকুনআমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নেবেন।

অধ্যপক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, জন্ম. ৬ই অগাস্ট ১৯৩৬ প্রয়ান ১৮ ই মার্চ ২০১৯

 

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।