দাদার অফিসের এক বন্ধু প্রদীপ মুখোপাধ্যায় এই নাটকটি দেখেছিলেন আটাত্তর কিংবা উনআশি সালে, ওনার সঙ্গে তারপর দেখা ২০১৭ সালে অর্থাৎ ৩৭ বছর পর। আমাকে দেখার পর তাঁর প্রথম প্রশ্ন আচ্ছা সেই ভদ্রলোকে খবর কি যিনি নিমচাঁদের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন? আমি জানাই তিনি শয্যাগত বার্ধক্য জনিত অসুখে। পরক্ষণেই তিনি বললেন আহা কি অভিনয় করেছিলেন ভাবা যায় না অভিনয় রক্তে না থাকলে ওই চরিত্রে অভিনয় করা সম্ভব নয়, ওই রকম ইংরিজি ডায়লগ স্বতঃস্ফুর্ত উচ্চারণ “ I drink till the bottom of the bottle is parallel to the roof. আর ওই বিশাল নাটক’কে আগাগোড়া ধরে রাখা একী চাট্টিখানি কথা, একবার মনে হয়েছিল চেষ্টা করে দেখি, কিন্তু অসম্ভব।
কতখানি অভিভূত হলে এত বছর পরও সংলাপ সহ মনে পড়ছে সেই অচেনা অভিনেতাকে। এই অভিনয় ঘসে মেজে হয় না নন্দিনী,। একজন দর্শক স্মরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন, ভাবতে পারো।
“যত শুনছি তত আশ্চর্য হচ্ছি, তবু সেই অর্থে কোন খ্যাতি পেলেন না”।
এই খ্যাতি না পাওয়া জন্যে কখনো কোনদিন বহিঃপ্রকাশ দেখিনি। নাটকের প্রতি অসম্ভব অনুরাগ না পাওয়ার বেদনা ভুলিয়ে রেখেছিল।
“নাটক যাঁদের রক্তে ঢুকে গেছে তাঁরা তো নাটক করেন মনে তাগিদে, বিখ্যাত হলেন কিনা সেদিকে কোন দৃষ্টি থাকে না”।
“ঠিকই বলেছ নন্দিনী একবারে মনের কথা বলেছে। সধবার একাদশী নাটকের কথা কোথাও আলোচিত হলে বুকের ভেতরটা চিনচিন করে ওঠে। সম্ভবতঃ ১৯৭৭ সাল সধবার একাদশীর অভিনয় তো চলছে, নতুন নাটকের কথা ভাবা শুরু হয়ে গেছে। খোঁজ পাওয়া গেছে কয়েকটার কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না, আমাদের আর্থিক সামর্থ্যের কথা ভেবে। সেই বছরই বোধহয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পুজো সংখ্যা দেশ’এ লিখলেন’ফজল আলি আসছে’ । অসম্ভব ভাল লেগেছিল পড়ার পর। তখনই মনে হয়েছিল এটাকে কি নাট্যরূপ দেওয়া যায়। কিন্তু কে’ই বা দেবেন। একদিন মনে ইচ্ছেটা লালুদার কাছে ব্যক্ত করে ফেললাম। উনি তো শুধু নাট্য পরিচালকই নন, আমার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল ওনার দিক নির্দেশিকতায়। তখনও তিনি উপন্যাসটা পড়েননি । পড়ার পর আর কোন দ্বিধা থাকল না। কিন্তু নাট্যরূপ কে দেবেন, তখনই ঠিক হয় ওনার অভিন্নহৃদয় বন্ধু অমর গঙ্গোপাধ্যায়।
“বহুরূপীর অমর গঙ্গোপাধ্যায়, টিভিতে অভিনয় করতে দেখেছি”।
“ না ইনি নাট্যকার অমর গঙ্গোপাধ্যায়, ওনার লেখা জীবন যৌবন, দ্বান্দ্বিক, একসময় বাংলা নাট্য জগতে সাড়া ফেলেছিল। হলে হবে কি, নাটকের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক তিনি চুকিয়ে ফেলেছেন অনেকদিন সম্ভবতঃ হতাশায়, যেন এক নেশাচ্ছন্ন জীবন যাপন করছেন পাহাড়প্রমাণ এক ব্যর্থতাকেই সঙ্গী করে। রোজ সন্ধ্যেবেলা ফেভারিট কেবিনে এসে বসে থাকেন একলা, ঝাপসা দৃষ্টি সম্বল করে। সেই মৃতপ্রায় মানুষটিকে এক আসুরিক চিকিৎসায় প্রাণ ফেরালেন লালুদা। রাজি হলেন নাট্যরূপ দিতে ফজল আলি আসছে উপন্যাসটি পড়ার পর। এরপর আমার ওপর ভার পড়ল ওনার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নাট্য রচনার অগ্রগতি সম্পর্কে লালুদাকে ওয়াকিবহাল করা। মাঝে মাঝে লালুদাও কলেজ ফেরত এসে দেখে যাবেন। প্রথম দর্শনে মোটেই ভাল লাগার কথা নয়।“
“কেন? খুব গম্ভীর ছিলেন বুঝি”।
ভীষণ। চোখে মোটা কাঁচের হাই পাওয়ারের চশমা, গালে না কামানো কাঁচা পাকা দাড়ি, জামা কাপড়ের কোন ছিরিছাঁদ নেই। পারতপক্ষে কথা বলতেই চান না। এরকম মানুষকে কি প্রথম দর্শণে কারো ভাল লাগে। কিছু দিন যাবার পরেই কেমন যেন নেশা লাগতে লাগল, ওনার অভ্যন্তরে সতত প্রবাহমান রসের ফল্গুধারা সামান্য ছোঁয়ায়। ততদিনে তিনি আমার একান্ত আপন অমরদা। একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বাড়ী ছিল ডাঃ জগবন্ধু লেনে। সে এক গোলকধাঁধার রাস্তা, একদিন ফেভারিট কেবিনে না পেয়ে সন্ধ্যে হয় হয় রওনা দিয়েছি ওনার বাড়ীর উদ্দেশ্যে। সাবেকী আমলের সংস্কারহীন দোতলা বাড়ী, ধূলি ধূসরিত চতুর্দিক। লোডশেডিং সেই সময়, দিনের আলো আর অবশিষ্ট নেই। অন্ধকার, খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে বার দুয়েক ডাক দিলাম। কোন সাড়া শব্দ নেই, অপেক্ষা করছি। দাঁড়িয়ে আছি দেখে এক মাঝবয়সী মহিলা নিচ তলায় কিছু করছিলেন মনে হয়। আমাকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে যেতে বললেন। বেশ বড় কড়ি বরগা দেওয়া ঘর। মেঝেতে মোটা বিছানা পাতা তার ওপর অমরদা ফুলপ্যান্ট পরে ঘুমিয়ে আছেন। তিন চার বার ডাকার পর ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লেন। পরিচয় দিতে বললেন এই অসময়ে তুমি, আমাকে তো ইস্কুলে যেতে হবে। মনে মনে ভাবছি একে রবিবার তায় সন্ধ্যেবেলা, এখন আবার কিসের ইস্কুল। তবু জিজ্ঞাসা করি কোন অনুষ্ঠান আছে নাকি। না না অনুষ্ঠান থাকবে কেন যেমন ইস্কুল যাই আর কি। তখনই বুঝেছি নিশ্চয়ই কোন গন্ডগোল হয়েছে, তাহলে সন্ধ্যেবেলা ইস্কুলে যাবেন কেন? আকাশ থেকে পড়লেন এখন সন্ধ্যেবেলা আমি তো ভেবেছি সকাল হচ্ছে। এবার আমি হেসেই ফেলি। আমার হাসি দেখে ওনার স্তম্ভিত ফেরে, “ চলো চলো, ওই অবস্থায় গায়ে একটা হাওয়াই শার্ট চড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। অন্ধকার রাস্তা ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ একটি লোক প্রায় আমাদের গায়ের ওপর এসে পড়ল – “অমরদা” ভয় পেয়ে গেছি আমি। “ হ্যাঁ কি ব্যাপার?” “ কামাল করে দিয়েছেন”! কিসের কি কামাল কিছুই বুঝতে পারলাম না “ তাই কই দেখি”। লোকটি হাতে একটা কাগজ গুঁজে দিল। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।কাগজে কি লেখা আছে সেই কৌতুহলে অমরদা ব্যস্ততা তখন চুড়ান্ত। সেই সময় নজরে পড়ল রাস্তার ধারে একটি হাত রিকশা দাঁড়িয়ে আছে আর তার পিছনের দিকে নীচে একটী কেরোসিন ল্যাম্পের ক্ষীণ আলো জ্বলছে। অমরদা সেই কাগজ নিয়ে প্রায় সেই রিকশার তলায় ঢুকে গেলেন। কিছুক্ষণ পরেই আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন। রিকশার তলা থেকে বেরিয়ে আসতেই জিজ্ঞাসা করি “ কি হয়েছে কি?” “ বিরাট এক দাঁও মেরে দিয়েছি”। আমার মগজে তখন লোডশেডিং’ এর অন্ধকার ঢুকে গেছে। জিজ্ঞাসা করি “ কিসে”। “রেসে” দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সারা সন্ধ্যে চলল ঘোড়া রেস তাদের দৌড় বৃন্তান্ত। রেস খেলা যে মোটেই ভাগ্যের ব্যাপার নয় পুরোপুরি বিজ্ঞান, কিভাবে ঘোড়া নির্বাচন করতে হয়, ঘোড়ার মা বাবা চোদ্দ গুষ্টি সম্বন্ধে কতখানি ওয়াকিবহাল থাকা কতখানি জরুরী। সেই আলোচনাতেই গোটা সন্ধ্যে কেটে গেল। আবার এই মানুষ যখন নাটক লেখেন একেবারে অন্য মানুষ। কি অসাধারণ নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ফজল আলি আসছে, এর পর সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ছোট গল্প খড্ডা’রও নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। দুটি নাটকের জন্যে কি অপূর্ব সব গান লিখেছিলেন।
“মনে আছে সেই সব গান?’
“ সব কি আর মনে? কয়েকটা লাইন মনে আছে। “ সূর্য সত্য বজ্র সত্য সত্য পকেট খালি তাহার অধিক সত্য এবার আসছে ফজল আলি।
“আর খড্ডা’র গান”।
“ একটা গানে তো অবিস্মরণীয় লাইন- সাপের মাথায় মণি দিয়ে বিষ দিলে তার দাঁতে / মাকালের বাহার দিলে স্বাদ দিলে না তাতে”।
“ সত্যিই অপূর্ব, কি অসাধারণ ছন্দমিল”।
“আপন মনে মাঝে মাঝে গাই ওই সমস্ত গানগুলি। ফিল্ম হলে খড্ডা একটি অসাধারণ ছবি হত। দুই লেখকই সাধুবাদ জানিয়েছিলেন তাঁকে। প্রচারের আলোর বৃত্ত থেকে অনেক দূরে রয়ে গেলেন লালুদারই মতন। কেউ জানলো না চিনল না এই প্রতিভাধর মানুষটিকে।
“ খড্ডা মানে কি”?
কোন আক্ষরিক মানে নেই। গল্পটি অনেকটা এই রকম, একটি প্রত্যন্ত মুসলিম গ্রামে ডাকপিয়ন একটি চিঠি নিয়ে এসেছে, চিঠিটি লিখেছে মামোদ আলি খড্ডা থেকে। কিন্তু কে’এই মামোদ আলি, কেউ তো তাকে চেনে না। গ্রামের এক অশীতিপর বৃদ্ধা সামান্যই মনে করতে পারল মামোদ আলি আর আমোদ আলি দুই ভাই, সেই সময় রাজার হাতী আসত গ্রামে, তারই মাহুত খড্ডার গল্প করত। একদিন মামোদ আলি সেই রাজার হাতীর সঙ্গে চলে যায় খড্ডা’য়। আর ফেরেনি। সে বড় সুখের জায়গা।তাই সবাই বেরিয়ে পড়ল খড্ডার সন্ধানে। কিন্তু কোথায় খড্ডা?”