• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে সুব্রত বসু (পর্ব – ৫)

আমার নাটক, নাটকের আমি

(৫)

তারপরের কথা বলতে গেলে সাতটা বছরের সংক্ষিপ্তকরণ, একটা উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ককে ঘিরে উপগ্রহের মতন প্রদক্ষিণ করার প্রচেষ্টা। জীবন  একটা বড় সমুদ্র, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিস্মরণের তাপে শুকতে শুকতে ঘোলা ডোবায় পরিনত হয়। আমাদের মতন লোকের আত্মজীবনী মানেই সেই ঘোলা জলে পাঁক ঘেঁটে যা সংগ্রহীত হয়নি সেই মণি মুক্তোর সন্ধান করা। শেষ পর্যন্ত রোমন্থনের আঁচে পাক হতে হতে যা  পড়ে থাকবে তা শুধু   আত্মপ্রচারের গাদ। তাই ভয় হয় নন্দিনী, যে কথা বলতে বসেছি তা কতদূরই বা বলতে পারব, শেষপর্যন্ত আত্মপ্রচার হয়ে উঠবে নাতো।
নট-রঙ্গ মানেই লালুদা। এই ঠগ নাটকের রিহার্স্যাল চলাকালীন কল শো’র কথা আগেই বলেছিলাম, সেখানে লালুদাকে দেখেছিলাম একটী ক্রিমিন্যালের চরিত্রে। পরে উনি ওই চরিত্রটি আর করতেন না।  বলতেন বয়সের সঙ্গে মানানসই হচ্ছে না, ফলে মেকাপ নিতে হচ্ছে বেশী। নাটকটি অমর গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা, নাইটস্‌ ইন দ্য ইনন এর ছায়া অবলম্বনে। পাঁচজন সমাজবিরোধী আসামের কোন এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আদিবাসীদের দেবতার চোখ থেকে হীরে তুলে গিয়ে দুজন আদিবাসীদের হাতে খুন হয়ে যায়। তাদের তাড়া খেয়ে জঙ্গলের মধ্যে পোড়ো বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এখান থেকেই নাটকতে সুত্রপাত। পরে যখন আমরা এই নাটকটি অভিনয় করি লালুদা  বুঝিয়েছিলেন উদ্দেশ্য এক হলেও তিনজন সমাজবিরোধীর চরিত্র কিন্তু পরস্পরের থেকে আলাদা। অভিনয়ের মাধ্যমে সেটা ফুটিয়ে তুলতে গেলে জানতে হবে কে কেমন চরিত্রের। সংলাপ বলার সময় সেটাই কিন্তু মুখ্য। নাটকে সংলাপের  অর্থ অনুযায়ী ভাব দিয়ে বললেই হল না, যে কুশীলবের  মুখে যে  সংলাপ বসানো আছে তার চরিত্র জানা কতখানি আবশ্যিক।
সেই তিন সমাজবিরোধীদের কি হল শেষ পর্যন্ত?
“তাহলে তো তোমায় নাটক দেখতে হবে, এদের যা হয় crime does not pay. লালুদা যখন  ফটিকের  চরিত্রে অভিনয় করতেন, নাটকের দাবী অনুযায়ী  ফটিক ছিল গোঁয়ার, এরোগেন্ট টাইপের, মানুষ খুন তার জল ভাত, সেই ফটিক মৃত্যুর পুর্বমুহুর্তে নিয়তির হাতে নিজেকে  ছেড়ে দিয়েছে, সেই দৃশ্যে লালুদা  অতুলনীয়, মাটিতে পড়ে গিয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিতেন সাহায্যের জন্যে,  যেন এক অমোঘ টানে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন ধীরেধীরে।হাততালি দিতে  ভুলে গিয়ে  দর্শক সাধারণ ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে যেত মনে করত  যেন এবার তাদের পালা।
তবে কি জানো    নাটকে অভিনয় করার আগে যত ছোটই চরিত্র হোক না কেন  তাকে জানতে হবে, ভাবতে হবে, পরিচালক সবটা করে দেবেন না এটা অভিনেতার দায়িত্ব। এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন লালুদা। পরিচালক বলে দেবেন মঞ্চে সেটা কি রূপ পাবে, এবার যা কিছু করণীয় সেটা  অভিনেতার নিজস্ব।প্রত্যেক অভিনেতারই স্বতন্ত্র  স্টাইল থাকে যার জন্যে একে অপরের থেকে আলাদা।একটা কথা মনে রাখতে হবে  মঞ্চে কিন্তু  সে তখন একা। তাই একই চরিত্রে ভিন্ন ভিন্ন অভিনেতা চরিত্র চিত্রায়ন আলাদা হয়।  সমগ্র নাটকের দায়িত্ব পরিচালক থাকেন ঠিক কথা  কিন্তু অভিনেতাকে আলাদা করে বাহবা দেওয়া হয় কেন  যখন সে ভাল অভিনয় করে। অহীন্দ্র চৌধুরীর নাম নিশ্চয়ই শুনেছ, ডিএল রায়ের সাহাজান নাটকে তাঁর অভিনয় অবিস্মরণীয়। সাহাজানের চরিত্রে অনেকই অভিনয় করেছেন, কিন্তু অহীন্দ্র চৌধুরীর কথা আলাদা করে বলতে হয় কেন। কারণ সাহাজানকে তিনি মঞ্চে উপস্থাপিত করলেন এক পক্ষঘাত গ্রস্থ বৃদ্ধ হিসাবে।মঞ্চে  তার শরীরের একটা দিকে অস্বাভাবিক কম্পন দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলে ছিলেন  অহীন্দ্র চৌধুরী।ভারত সম্রাট সাজাহান স্থবির বৃদ্ধ, ক্ষমতাহীন, এটাই বোঝানো দরকার ছিল অভিনয়ের মাধ্যমে।  একেই বলে improvement upon author. অহীন্দ্র চৌধুরীর সাহাজান মানেই হাউস ফুল”।
“তুমি দেখেছ?”
“না,সে সৌভাগ্য হয় নি।  লালুদার মুখে শোনা। অহীন্দ্র চৌধুরী আর শিশির ভাদুড়ী  তৎকালীন বাংলা নাটকে সমান্তরাল দুটি ধারা। আশ্চর্যের কথা পরর্বতী কালে যাঁরা সাহাজানের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অহীন্দ্র চৌধুরী দেখানো পথই অনুসরণ করে গেছেন অনেকেই।  আমি ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহাজান দেখেছি, উনি একেবারেই অহীন্দ্র চৌধুরী কার্বণ কপি করতেন। তবে সেখানে মহেন্দ্রগুপ্তের আরঙ্গজেবের কথা আলাদা করে বলতেই হয়।
“ এত কথা তোমাদের হত কখন ?”
“যখন রিহার্স্যাল থাকত না , প্রতি রবিবারেই আমাদের একটা আড্ডা বসত, অনেকেই আসত, সব সময় যে শুধু  নাটক নিয়ে কথা হত তা নয়। নানান বিষয়ে, সেই আড্ডা যে কতখানি   আকর্ষণীয় তা বলে বোঝানো যাবে না। মন্ত্রমুগ্ধের মত খালি শুনতাম, লালুদার রসবোধ ছিল অসাধারণ, কোন কিছু বলার সাথে ছোট্ট রসিকতা সেই প্রসঙ্গটিকে আলাদা মাত্রা যোগ করত।
হ্যাঁ যা বলছিলাম , অহীন্দ্র চৌধুরী, আর শিশির ভাদুড়ী দুটি ধারা। দুজনেই মস্ত অভিনেতা। লালুদা শিশির ভাদুড়ীকে গুরু বলে মানতেন।   চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চাণক্যের চরিত্রে অভিনয়ের কথা লোকের মুখে মুখে ফিরত, লালুদা বলতেন যোড়শী নাটকে জীবানন্দের ভুমিকায় অভিনয়ের কথা। একবার বিদেশ থেকে কিছু নাট্য বোদ্ধা এসেছেন শিশির ভাদুড়ীর অভিনয় দেখবেন বলে। তাঁদের সঙ্গে শিশির ভাদুড়ীর  কোন পরিচয় নেই, ছবিও দেখেনি। বাংলা ভাষাও তারা বোঝে না। নাটক শুরু হল শিশির ভাদুড়ী এ্যাপিয়ারেন্স, প্রথম সংলাপ তুমি জীবানন্দ না, এই একটি সংলাপেই তারা বুঝে নিল যে উনিই শিশির ভাদুড়ী, নিজেদের মুগ্ধতাকে ঘিরে  একটা গুঞ্জন তৈরী হয়ে গেল। গোটা নাটক নয় একটা সংলাপেই জাত চিনিয়ে দিতেন এই সব দিকপাল অভিনেতারা।
“আচ্ছা অহীন্দ্র চৌধুরী শিশির ভাদুড়ী একসঙ্গে কোন অভিনয় করেননি”।
“ এও আমার লালুদার মুখ থেকে শোনা, মাঝে মাঝে তখন কম্বিনেশন নাইট হত, বড় বড় অভিনেতারা কোন একটি বিখ্যাত নাটক বেছে নিয়ে তার বিভিন্ন চরিত্রে এক একজন অভিনয় করতেন। সেইরকম প্রফুল্ল নাটকে শিশির ভাদুড়ী অহীন্দ্র চৌধুরী একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন রমেশ ও যোগেশের চরিত্রে। নাটকের শেষে রমেশের মুখে সেই বিখ্যাত সংলাপ আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল। এখনকার কোন কোন নাটকে নিশ্চয়ই দেখেছ দর্শকের সঙ্গে মঞ্চের যোগাযোগ, দর্শক আসন থেকে কোন অভিনেতা মঞ্চে উঠে গেলেন, সেখান থেকেই সংলাপ বলা বা গান শুরু হল। নাটকের এই আধুনিক ভাবনার পথ প্রদর্শক কিন্তু শিশির ভাদুড়ী, রবীন্দ্রনাথের শেষরক্ষা নাটকে তার সফল প্রয়োগ, বিনোদের বিয়েতে বরযাত্রী রূপী অভিনেতারা দর্শক আসনের  মধ্যে  দিয়ে হেঁটে মঞ্চে উঠলেন। শেষে চন্দ্রবাবুর ভূমিকায় শিশির ভাদুড়ী নিজেই বিলি করলেন গদাই’এর  বিয়ের পদ্য দর্শকদের মধ্যে। দর্শককে নাটকের সঙ্গে একাত্ম করে নেবার আধুনিক ভাবনা বিদেশী নাটকে ছিল। বাংলা নাটকে শিশির ভাদুড়ীই এর পথিকৃৎ।
“তোমার কথা শুনতে শুনতে কিন্তু লোভ হয়, এমন মানুষটির সান্নিধ্য যদি পাওয়া যেত”।
“সত্যিই নন্দিনী আমি ভাগ্যবান, লালুদার দেখা এই সমস্ত নাটক, তাই যেটা বলতেন বিশ্বাস থেকে বলতেন। ব্ল্যাঙ্ক ভার্স শিশির ভাদুড়ী একদমে উনিশ লাইন বলতে পারতেন, তাতেও তাঁর আক্ষেপ ছিল গিরীশ ঘোষ পারতেন আরো বেশী। নাটকে সংলাপ ঠিক মত বলার ওপর ভীষণ জোর দিতেন, শেষ সারির দর্শকও যেন প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট শুনতে পায়। নির্দেশনার সময় শিশির ভাদুড়ী সহ অভিনেতাদের একটা কথা প্রায়ই বলতেন ওরে তেড়ে গিয়ে হেঁকে বল। নাটক যারা দেখতে এসেছে তারা যেন শুনতে পায়। এর জন্যে গলার স্বরের অনুশীলনের শিক্ষা লালুদার কাছ থেকেই পাওয়া। রবীন্দ্রনাথের দুঃসময় কবিতার শেষ স্তবক উচ্চস্বরে আবৃত্তি করতে বলতেন। যেমন ধরো “ওরে ভয় নাই নাই স্নেহ মোহ বন্ধন”, একটা পিচে বলা হল, পরের লাইন ওরে আশা নাই আশা শুধু মিছে ছলনা, পিচ একধাপ বেড়ে গেল। ঠিক যেভাবে সা থেকে নি পর্যন্ত যেতে গলার স্বরকে ধীরে ধীরে যেভাবে উঁচুতে তুলতে হয়, এক্ষেত্রেও ঠিক তাই, গলার স্বরকে একেবারে উঁচুতে তুলে “ওরে বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা “।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।