সেইসময় নট-রঙ্গ এর রিহার্স্যাল হত উঠে যাওয়া একটি মুরগীর পোলট্রিতে। লালুদার পরিচিত ব্যবসায়ীর অনুমতিক্রমে নট-রঙ্গ ব্যবহার করত সেই পোলট্রির চাতাল। শতরঞ্জি পেতে মাটিতেই বসা হত। এর আগে লালুদাক দূর থেকে দেখেছি, বেশিরভাগ সময় ধুতি পাঞ্জাবী পরতেন। সেইখানেই যেদিন পরিচিত হলাম সেদিনও ওই পোষাকে বসে ছিলেন। পরিচয় পর্বটি খুব সহৃদয় মনে হয়েছিল। নাট্যপরিচালক হিসাবে কঠোর ব্যক্তিত্বের ঘেরাটোপে নিজেকে আবদ্ধ রেখে নিয়ম শৃঙ্খলা চাপিয়ে দেবার কোন প্রয়াস লক্ষ্য করিনি। বরং উল্টোটাই মনে হয়েছিল। সহজ সরল আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম।প্রথম দিনেই নতুন নাটকে একটি চরিত্রের জন্যে আমি মনোনীত হলাম একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে, বসে বসে সেই নাটকের কয়েকটি সংলাপ বলার মাধ্যমেই ঠিক পছন্দ হলনা লালুদার, নিজেও বুঝতে পারছিলাম।তার বদলে অন্য একটি পার্শ্বচরিত্রের জন্যে মনোনীত করা হল। উত্তেজনায় ভয়ে আনন্দে আমার কি অবস্থা বলে বোঝাতে পারব না। সেটা বোধহয় লালুদা নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন। যেভাবে উনি সংলাপটি বলছিলেন তার সিকিভাগ বলতে পারলেও দারুণ অভিনয়। গলার স্বরের ওঠানামা, মডুলেশন, এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন খুব সহজ ভাবে। নারভাসনেস কাজ করছিল বলে যথাযথ ভাবে সংলাপটি বলতে পারছিলাম না, তবু আমি সেই চরিত্রের জন্যে মনোনীত হই। এটা আমার বিরাট পাওয়া।
জানো নন্দিনী পরর্বতী কালে নট-রঙ্গ এর যখন পাকাপোক্ত সদস্য, তখনও নিজের পছন্দ অপছন্দের কথা কখনো লালুদা জানাইনি। বরং যে চরিত্রটির জন্যে আমাকে মনোনীত করা হয়েছে, সেটি ভালভাবে করার চেষ্টা করেছি। পরে এই ঠগ নাটকে রাখালের চরিত্রে অভিনয় করেছি, ভোলা দত্ত রবি ঘোষের সঙ্গে এই চরিত্রে অভিনয় করতেন, অভিনয়ের পর প্রশংসাও পেয়েছি অনেকের কাছ থেকে।
“ তাবলে কি কখনো মনে হয়নি এই চরিত্রটি পেলে খুব ভাল হত”।
“মিথ্যে বলব না তোমায়, অবশ্যই মনে হত। নট-রঙ্গ সদস্য হবার দিন পনেরোর মধ্যে, দুপুর বেলায় সাইকেল নিয়ে আমাদের গ্রুপের একটি ছেলে ডাকতে এলো। গিয়ে দেখলাম লালুদা বসে আছেন, হাতে লেখা একটি স্ক্রিপ্ট, তারপর দিন পাল্লারোডে আমাদের কল শো। দুটি একাংক নাটক সেখানে হবে, বনফুল’এর কবয়ঃ ও অমর গঙ্গোপাধ্যায়ের নিশির ডাক। এই নিশির ডাক নাটকটি আমাকে কপি করতে হবে। আমার হাতের লেখাটী লালুদার পঠনযোগ্য বলে মনে হয়েছিল। জেরক্স তখন এত প্রচলিত নয়। অমর গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা খুব ছোটছোট। এই নিশির ডাকে একটি চরিত্র ছিল বেহালা বুড়ো। নট-রঙ্গ এর আগে বেশ কয়েকবার এই দুটি নাটক অভিনয় করেছে। সুতরাং নতুন কাউকে দিয়ে অভিনয় করানোর প্রশ্নই ওঠে না। ওই বেহালা বুড়ো চরিত্রটী অভিনয় করছিলেন এক ডাক্তারবাবু ভোলাদা। রিহার্স্যালে দেখলাম এক্যশন কম্পোজিশান কোন ভুল চুক নেই তাঁর। পাঠটি মুখস্থ করেছেন যথাযথ। কিন্তু সংলাপ বলার সময় কেমন যেন সুর থেকে যাচ্ছে। তখনই মনে হয়েছিল, এই চরিত্রটি পেলে আমি একেবারে অন্যরকম অভিনয় করতাম।
“সেই ইচ্ছে কি পূর্ণ হয়েছিল?”
“অনেক পরে একবারই অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। অনেক লোক এই চরিত্রটি অভিনয় করেছে। কাউকেই আমার তেমন ভাল লাগেনি, সেকথাও কখনো আলোচনায় বলিনি পাছে লালুদা বুঝতে পারেন আমি ঐ চরিত্রটি সম্বন্ধে আমার দুর্বলতা আছে ওই চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছুক ছিলাম। দেখেছ একেবারে অন্য প্রসঙ্গএ এসে পড়েছি, বলছিলাম নটরঙ্গ এ আমার প্রথম দিনের কথা। সেদিনের রিহার্স্যাল আমি ভুলতে পারব না।
কেন রিহার্স্যাল তো শুধুমাত্র চর্চা, আসল অভিনয় নয়, তবে কেন একথা বলছ।
ঠিকই বলেছে, রিহার্স্যালের কথা কেই বা মনে রাখে।তবুও এওকথা বলতেই হবে তিনিই হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন মঞ্চে ঢোকা বেরোনো, কোনদিক দিয়ে ঘুরতে হয়।স্বরক্ষেপন, অভিনেতার দুটো হাত বড় সাংঘাতিক জিনিষ। কিভাবে মঞ্চে হাতের ব্যবহার স্বাভাবিক মনে হবে। সবই ধীরে ধীরে ওনার কাছ থেকে শিখেছিলাম।তবুও অনেক কিছুই বাকী থেকে গিয়েছিল নন্দিনী।
আমি এর আগে লালুদার কখনো অভিনয় দেখিনি, ধুতি পাঞ্জাবী পরে পান খেতে খেতে রাস্তায় যেতে দেখতাম। আচরণে অধ্যাপক সুলভ ভঙ্গি। খুব স্বাভাবিক। সেই মানুষটিকে যখন প্রথম দেখলাম একটি খবরের কাগজের অযোগ্য সম্পাদকের চরিত্রে। নিজের ব্যক্তিসত্বা সম্পূর্ণ আড়াল করে অন্য বাচনভঙ্গিতে ছদ্ম গাম্ভীর্য ও ঠুনকো ব্যক্তিত্ব আরোপের এক অসাধারণ অভিনয়। না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা মুহুর্তে মানুষটি কিভাবে পালটে গেলেন রিহার্স্যাল করতে উঠে। নাটক যখন অভিনীত হয় চরিত্রের সাজ পোষাক আলো, আবহ সঙ্গীত সাহায্য করে অভিনেতার অভিনয়কে ক্লাইম্যাক্সে নিয়ে যেতে। কিন্তু রিহার্স্যাল রুম সেখানে অভিনেতার শুধুমাত্র নিজস্ব এ্যাকশন আর বাচনভঙ্গি। নাটকের প্রতি কতখানি শ্রদ্ধা থাকলে তবেই রিহার্স্যালেও তিনি একশো ভাগ দেবার চেষ্টা করছেন। হতবাক হয়ে ওনার অভিনয় দেখছিলাম, আর বাঁধা পড়ে যাচ্ছিলাম এক অদৃশ্য বন্ধনে।
“তাহলে রিহার্স্যাল দেখাও একটা প্রাপ্তি বলো” ।
নিশ্চয়ই, উৎপল দত্তর কথা শুনেছি, শম্ভুমিত্রের কথা শুনেছি, নানান লোক মুখে শুনতে শুনতে মিথ হয়ে দাঁড়ায়। তার মধ্যে কতটা সত্যি কতটা কল্পনা আলাদা করে নিরুপণ করা যায় না, সেই মানুষটি কল্পলোকের বাসিন্দা হয়ে যান আমাদের কাছে। যেমন লালুদার মুখেই শোনা সেক্সপীয়ারের নাটক দেখতে প্রায়ই হাজির হতেন চার্চিল, অভিনেতারা তটস্থ হয়ে থাকতেন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন বলে নয়, নাটকের প্রতিটি সংলাপ তাঁর নাকি কন্ঠস্থ, সুতরাং অভিনেতাদের উপায় ছিল না, কোন সংলাপ ভুল বলার। বিষয়টি গল্প বলে উড়িয়ে দেবার কিছু নেই, এই চার্চিল সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। সেও লালুদার কাছ থেকেই শোনা।
আবার এও শুনেছি ওঁর মুখে, অভিনেতার নাম বলেছিলেন ভুলে গেছি। লন্ডন থিয়েটারে প্রধান অভিনেতার খোঁজ নেই। অনেকেই জানেন তিনি কোথায় আছেন, শো আরম্ভ হবার কিছুক্ষণ আগে ভাটিখানার নর্দমার ধার থেকে তুলে আনা হল, জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে বেহেড মাতাল, নাটকের কার্টেন রেজারের (certain reiser) মিউজিক চলছে, একপ্রকার মেকাপ ছাড়াই ঠেলে স্টেজে ঢুকিয়ে দেওয়া হল,শুধু মাত্র কোর্টটা বাঁহাত দিয়ে ধরা পিঠে ঝুলছে, স্টেজে ঢোকার আগে শুধু একটি প্রশ্ন করলেন “ what’s the play”- প্রম্পটার উত্তর দিলেন Hamlet , ব্যস আর কোন প্রশ্ন নেই,চুটিয়ে অভিনয় করে গেলেন ।
“বাব্বা! এরকম অভিনেতাও পৃথিবীতে আছেন”।
“তবু তাঁকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ আপামর নাট্যমোদী মানুষ, অভিনেতা যন্ত্র হতে পারে না। যে চরিত্রে অভিনয় করছেন সেটিতে আত্মস্থ হতে সময় দিতে হবে। স্তানিস্লাভস্কির প্রদত্ত অভিনয় পদ্ধতিতে অন্ততঃ সেই কথাই বলাই হয়েছে।আসল কথা কি জানো নন্দিনী, অভিনেতা যে চরিত্রে অভিনয় করছেন নিজের মনের মধ্যে একান্ত বিশ্লেষণে সেটির রূপ নির্মান করতে হয়। তবে কি জানো অভিনয় করতে করতে অভিনেতা এমন একটা পর্যায়ে চলে যান, মঞ্চে পা দেওয়া মাত্র এমন একটা আলাদা ইন্সপিরেশন পান, তখন আর তাঁকে বলে দিতে হয়না। শারিরীক অক্ষমতা তুচ্ছ হয়ে যায়।তাই বোধহয় হয়েছিল সেই মদ্যপ অভিনেতার ক্ষেত্রে। যাই হোক যে কথা বলছিলাম –
এই মুহুর্তে আর একজনের কথা মনে পড়ছে, তিনিও বড় অভিনেতা নাট্য শিক্ষক, পরিচালক জ্ঞানেশ মুখার্জি। ওনার রিহার্স্যাল দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল, বীরু মুখোপাধ্যায়ের রাহুমুক্ত নাটকের। সঙ্গে ছিলেন গীতা দে, সারা রিহার্স্যালে জ্ঞানেশ মুখার্জি কোনসময় গলা তুললেন না। নিচু গলায় যে ওই মড্যুলেশন হতে পারে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। অথচ গীতা দে অত্যন্ত প্রাণবন্ত, সোচ্চার। তার পাশে জ্ঞানেশ মুখার্জির নিচু কন্ঠস্বর তুমি বলবে মানানসই হচ্ছিল কিকরে। ঠিকই, কিন্তু নাটকের গতি যে কোথায় পৌঁছিয়ে গিয়েছিল না দেখলে ভাবা যাবে না। প্রম্পটার ভুলে গেছে বই হাতে নিয়ে নাটক দেখছে রিহার্স্যালে। পরে এই জ্ঞানেশ মুখার্জি দেখেছি, ফেরারী ফৌজ নাটকে, শান্তিদার ভূমিকায়। মনে গাঁথা হয়ে রয়েছে । আমারও সেদিন এক অবস্থা, হাঁ করে নাটক দেখছি রিহার্স্যালে। শুধু যে তিনি অভিনয় করছেন তা নয়, সহ অভিনেতাকে কম্পোজিশান বুঝিয়ে দিচ্ছেন, ডায়লগ থ্রোয়িং দেখিয়ে দিচ্ছেন, আবার নিজের চরিত্রে ফিরে যাচ্ছেন।এই হলেন লালুদা, স্টেজের অভিনয়ই রিহার্স্যাল রুমে শুধু ড্রেস মেকাপ ছাড়া।