……….সেই বিচিত্র রঙে-র খেলা দেখতে দেখতে হটাৎ , একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল হতেই আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম! লক্ষ্য করলাম পাম্পহীন সাইকেলটা ঠেলতে ঠেলতে এতখানি পাহাড়ি-পথ বেয়ে আসা সত্ত্বেও , আমার যেন সামান্য ক্লান্তিটুকুও অনুভব হচ্ছে না! আমি যেন সম্পূর্ণ অতীতহীন হয়ে হিলিয়ামগ্যাস ভর্তি একটা বেলুনের মতো হাওয়ার স্রোতে ভাসতে ভাসতে বাধাহীন এগিয়ে চলেছি ! আমার জীবনে যেন পুরানো কোনো ব্যাথা নেই, কোনো আঘাত নেই, তার বদলে একটা পক্ষীরাজঘোড়া যেন আমার বুকের ভিতরে ডানা ঝাপটিয়ে খচমচ করে উড়ে বেরাচ্ছে !
(পর্ব – ৩)
কিছুটা পথ এগোনোর পর বহু মানুষের কলরোল যেন একসঙ্গে শুনতে পেলাম। আরেকটু এগোতেই দেখলাম, একদল নারী পুরুষ নিজেদের মধ্যে রঙ্গ-রসিকতা, গান-গল্প করতে করতে হাট ফিরতি পথ ধরে যে-যার বাড়ি ফিরে যাচ্ছে । ভীড়টা আরও কাছাকাছি আসতেই লক্ষ্য করলাম, দলের পুরুষগুলি প্রায় খেলার ছলে কখনো মাঠে—গাছের নীচে কখনোবা, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আসঙ্গলিপ্সায় নি -জের নিজের নারীদেরকে ইশারায় আমন্ত্রণ জানা- চ্ছে আর, মেয়েগুলিও এক অদ্ভুত নাচের ভঙ্গিমায় যে-যার নিজের পুরুষসঙ্গীটিকে ছোঁয়ার খেলায় মেতে কখনো রাস্তার থেকে মাঠে, মাঠের থেকে রাস্তায় ছোটাছুটি করছে আর, অদ্ভুত মজার সুরে গান গায়তে গায়তে, হাসতে হাসতে শরীরময় এক অপূর্ব হিল্লোল তুলে একজন আরেকজনের গায়ের উপর ঢলে ঢলে পড়ছে! লক্ষ্য করলাম, অনেকে আবার আমার মতো-ই , ভুলভুলাইয়া-র হাটের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে। সেই ভীড়ের ভিতর হটাৎ, একটা কম বয়েসী ছেলে আমার পাশে এসে ঝুপ করে তার সাইকেল থেকে নেমে পড়লো। তারপর, আমার দিকে তাকিয়ে হাসিহাসি মুখে বললো , ” নতুন বাবু বুঝি ভুলভুলাইয়া-র হাটে যাবেন? “
ছেলেটি এমনভাবে তার সাইকেল থেকে নেমে এলো মনে হলো যেন ডানায় ভর করে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সে আমার সামনে এসে দাঁড়াল! আমি তার দিকে কিছুক্ষণ বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়লাম। বললাম, ” হ্যাঁ। ” তারপর, সাইকেলটা দেখিয়ে বললাম, ” এই যে এটা সারাতে হবে। “ছেলেটি আমার সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে বললো, ” ওঃ, তাহলে তো আপনাকে নন্দাইমিস্তিরির কাছে যেতে হবে। হাটের পশ্চিমে জোরা শিমুলগাছের তলায় ওর মন্ডি ।…. তবে, আপনাকে কিন্তু ধৈর্য ধরে বসতে হবে। আজ ওর অনেক কাজ ! “
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ” সবাই বুঝি ওর কাছেই সাইকেল সারায়? ” ছেলেটি বললো, ” হ্যাঁ, তা তো সারায়! তাছাড়া, নন্দাই মিস্তিরির কী শুধু একটা কাজ! ও নতুন জুতো তৈরি করে, ছেড়া জুতোয় তাপ্পি মারে, ছেলেদের খেলার বল, ছাতা, সাইকেলের টায়ার সেলাই করে। হাঁড়ি কড়াই বালতি জলের গামলা ফুটো হয়ে গেলে সারিয়ে দেয়, বাটনা গাছের কাঠ দিয়ে দাঁ, করাত খুকরি-র হাতল বানিয়ে দেয় । “
আমি বললাম, ” ও বাবা, তাহলে তো ওর অনেক কাজ ! “
ছেলেটি বললো, ” আরও আছে! ঢেকি-ছাটা চাল, নতুন ধানের খৈ, চিড়া,জ্বালানিকাঠ, মাটিরতেল, খড়, কঁচি বাঁশ সব পাওয়া যায় নন্দাই মিস্তিরির মন্ডিতে ! “
তারপর, একটু থেমে ছেলেটি বললো , ” চলুন , আমিই আপনাকে ওর কাছে পৌঁছে দিই। ” বলে-ই , সে আমার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলো। আরও কিছুটা পথ এগোবার পর ছেলেটি আঙুল তুলে দূরে দেখিয়ে বললো, ” নতুন বাবু , ওই দেখুন ভুলভুলাইয়ারর হাট ! “
আমি দূর থেকে ভুলভুলাইয়া-র হাট দেখ -লাম ! হাট তো নয়, যেন একটা মেলা বসেছে ! দূর- বর্তী সেই রাস্তার থেকেই আমার মনে হলো, সেই মে- লার ভিড়ে কেউ-ই হাঁটছে না, সকলেই যেন নাচের ভঙ্গিতে এক জায়গার থেকে আরেক জায়গায় যা- তায়াত করছে! ছেলেটির সাথে পায়ে পায়ে আমি ভুলভুলাইয়ার হাটে গিয়ে ঢুকলাম। হাটের ভিতরে পা রাখতেই মনে হলো , আমি যেন একটা সব পেয়ে -ছির দেশে এসে ঢুকে পড়লাম! কী নেই সেখানে! দেখলাম, হাটের প্রায় মধ্যিখানে বসেছে মনোহারি দোকান! মেয়েদের বেলোয়ারি চুড়ি, রেশ্মিফিতে, মাথার ঝুমকো কাটা, গিরিমাটি , আলতা পাতা,ছোট ছোট শিশিতে মোম আর , ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি মেয়েদের ঠোঁট রাঙানোর একরকম আরক , পুঁতির মালা, কাজললতা, রুজ, পমপমের দোকান ঘিরে খুব ভিড় জমে উঠেছে! একটু দূরেই একটা মহুল গাছের নীচে বসেছে নাগরদোলা! সেখানে ছেলেমেয়েরা সব রঙগ-রসিকতায় মেতেছে! আমি সেই ছেলেটির সঙ্গে সামনের পথ ধরে এগোলাম। লক্ষ্য করলাম, সেই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে যেতে আমার যেন কোনও অসুবিধেই হচ্ছেনা। সকলের জন্যেই যেন ভিন্ন ভিন্ন পথ আগের থেকেই নির্দিষ্ট করা আছে। বুঝতে পারলাম, প্রত্যেকেই যে-যার নির্দিষ্ট পথ ধরে যাতায়াত করছে বলেই, সকলের হাঁটার মধ্যে যেন নাচের মতো-ই একটা ছন্দ তৈরি হচ্ছে ! ছেলেটি এবার আঙুল তুলে বললো, ” নতুন বাবু, ওই যে জোরা শিমুলগাছ। ওইখানেই নন্দাইমিস্তিরির মন্ডি। আমাকে জোরা শিমুলগাছ দেখিয়ে দিয়ে ছেলেটি বললো, ” এবার আমি যাই, মায়ের জন্য কাপড়ে ফুল তোলার রঙিন সুতো কিনতে হবে। “
আমি তাকে ধন্যবাদ জানাবার আগেই সে হাঁটা দিল। আমি জোড়া শিমুলগাছ লক্ষ্য করে এগোলাম।