• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক প্রকল্পশ্রীরিয়্যাল ধারাবাহিকে প্রকল্প ভট্টাচার্য (পর্ব – ২ ।। প্রথম ভাগ)

পরিমলবাবুর পরিবারকথা

পর্ব ২ : স্কুল অ্যাডমিশন   

মুখ্য চরিত্র : পরিমলবাবু (বয়স পঁয়ষট্টি, ক্লার্কের চাকরি করে রিটায়ার করেছেন) পরমা (পরিমলবাবুর স্ত্রী, বয়স পঞ্চান্ন, গৃহবধূ) প্রসূন (ছেলে, বয়স ত্রিশ, আইটি ফার্মে চাকরিরত) জুঁই (পুত্রবধূ, বয়েস পঁচিশ, স্কুল টিচার) প্রীতি: (মেয়ে, বয়স পঁচিশ, কলেজে পড়ে) প্রিয়ম (নাতি, বয়েস সাত বছর, ক্লাস টু)
অন্যান্য : রমেশবাবু (পরিমলবাবুর বন্ধু), স্কুলের অ্যাডমিশন অফিসার, আনন্দ: (প্রীতির প্রেমিক)
(পরিমলবাবু বাজার থেকে ফিরলেন)
পরিমল- পরমা, ও পরমা! তাড়াতাড়ি এসো!
পরমা- উফফ, সাতসকালে এমন চিৎকার করছ কেন! আসছি তো!
পরিমল- আরে চিৎকার করছি কী আর সাধে! এই নাও, ব্যাগটা ধরো!
পরমা- কী এমন ভারি ব্যাগ, যে এতটা বয়ে এনে আর রান্নাঘর অবধি আর বইতে পারছ না!
পরিমল- আরে না না ভারি নয়, গরম।
পরমা- গরম! তার মানে! কী কিনে আনলে!
পরিমল- কিনেছি তো ক’টা আনাজপাতি আর একটু মাছ, কিন্তু যা দাম সব জিনিসের, পুরো আগুন গরম!!
প্রসুন- বাঃ! বাবা একেবারে গরমাগরম বাজার নিয়ে এসেছ! দারুণ তো!
পরিমল- আর বলিস না! এই বছর দশেক আগেও বাজারে গিয়ে দুই থলি ভর্তি করে নিয়ে আসতাম, আর এখন…
প্রিয়ম- দাদু, এখন সব দোকানে সিসিটিভি লাগানো আছে, ধরা পড়ে যাবে!
জুঁই- এই, বড়দের মধ্যে কেবল কথা বলা, তাই না? হোম-ওয়ার্ক হয়ে গেছে সব?
প্রিয়ম- হোম-ওয়ার্ক তো দেয়ইনি কিছু!
জুইঁ- তাহলে পরীক্ষার পড়া তৈরি করো যাও!
প্রিয়ম- মা, সবে তো একটা পরীক্ষা শেষ হলো, পরের পরীক্ষা তো সামনের মাসে!
জুঁই- ওঃহো, তাহলে প্রজেক্ট-এর কাজ করো!
প্রিয়ম- প্রজেক্ট কী গো? ওয়ার্ক এজুকেশন? আমাদের স্যারই আসেন না ক্লাসে! ঐ পিরিয়ডে অন্য টিচার এসে বলে রিভিশন করো রিভিশন করো!
প্রসুন- বাহ! তাহলে আমাদের ছেলের সব পড়াশোনা শেষ! কী আনন্দ!
জুঁই- তুমি হাসছ, আর ও ভাবছে তুমি ওকে সাপোর্ট করছ!
প্রসুন- মোটেই সাপোর্ট করছি না। প্রিয়ম, ঘরে গিয়ে পড়তে বসো। নাহয় নতুন লেসন কিছু পড়ো বা অঙ্ক কষো। যাও।
পরমা- আহা, ছোট ছেলে, এইভাবে সবসময় পড়তে বলিস কেন!
প্রসুন- মা, তুমি বুঝবে না। আজকাল প্রচণ্ড টাফ কম্পিটিশন। পয়েন্ট এক নম্বরের জন্য সুযোগ ফস্কে যায়!
জুঁই- নেহাত আমাদের স্কুলটা গার্লস স্কুল, নয়তো প্রিয়মকে আমার স্কুলেই ভর্তি করে দিতাম। এইভাবে হোম ওয়ার্ক না দিয়ে, প্রজেক্ট না দিয়ে ওদের পড়াশোনার বারোটা বাজাচ্ছে।
প্রসুন- ঠিকই বলেছ। এই স্কুলে বেশীদিন পড়লে ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আচ্ছা, কাছেই যে ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটা খুলেছে, সেটায় প্রিয়মকে ভর্তি করালে কেমন হয়?
জুঁই- স্কুলটা ভালোই শুনেছি, তবে মনে হয় একটু হাই ফাই।
প্রসুন- সে হোক না, পড়াশোনাটা ভালো হলেই হলো। আর হাই ফাই হলে একটা সুবিধা, এক্সপোজার হবে বেশী।
পরমা- ওরেবাবা, ওদের তো প্লেনে করে বেড়াতে নিয়ে যায়! পাশের বাড়ির শ্যামলী বলছিল সেদিন, ওর নাতি তো ঐ স্কুলেই পড়ছে!
প্রসুন- বাঃ, সে তো ভালো কথা! প্রিয়ম প্লেনে চড়তে খুব ভালোবাসে।
পরিমল- আচ্ছা, আমি একটা কথা বলব?
জুঁই- একি, এভাবে জিগ্যেস করছেন কেন! নিশ্চয়ই বলবেন বাবা!
পরিমল- আসলে আমি তো পুরোন দিনের মানুষ, আজকালকার ব্যপারাস্যপার ভালো বুঝি না, তাই সব বিষয়ে মন্তব্যও করি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, শুধু বাড়ির কাজ কম দেয় বলেই প্রিয়মের ইস্কুল বদলানোটা ঠিক হবে না।
জুঁই- ঠিক তা নয় বাবা, সেটাই একমাত্র কারণ নয়। ওর স্কুলে এমনিই ইণ্ডিভিজুয়াল কেয়ার নেয় না, আর এক্সপোজারও বেশী পায়না ওরা।
প্রীতি- তোমরা সবাই কী নিয়ে কথা বলছ গো? প্রিয়মের স্কুলিং? কিন্তু ও তো গত পরীক্ষাতেও ফার্স্ট হয়েছে!
প্রসুন- সেটাই তো সমস্যা রে! আমি কোনোদিন টপ টেনের মধ্যে র‍্যাঙ্ক করিনি, এদিকে আমার ছেলে পরপর ফার্স্ট হচ্ছে, তার মানেই স্কুলের স্ট্যাণ্ডার্ডটা বুঝে দ্যাখ!
জুঁই- দিস ইস আনফেয়ার! আমি কিন্তু ফার্স্ট হতাম ক্লাসে, আর প্রিয়ম আমারও ছেলে, ভুলে যাচ্ছো কেন?
প্রসুন- ওক্কে, আয়াম স্যরি! আসলে ইট ওয়াজ এ জোক।
জুঁই- অ্যান্ড এ ভেরি পুয়োর জোক।
প্রীতি- আচ্ছা, জোকস এপার্ট, বাবা কী বলছ?
পরিমল- বলছিলাম, ঠিক কী কী কারণে প্রিয়মের স্কুল বদলানো দরকার, আমি বুঝতে পারছি না।
প্রসুন- বাবা, প্রিয়মের স্কুলে ইংলিশে কথা বলতে শেখায় না, স্টুডেন্টদের কোনো তেমন সোশ্যাল স্ট্যাটাস নেই…
পরিমল- তার মানে, মাতৃভাষায় কথা বলবার অপরাধে ওর স্কুল বদলানো প্রয়োজন?
প্রসুন- না বাবা, আমি তা মীন করিনি…
পরিমল- দ্যাখো, দু-পাতা ইংরিজি ফটর ফটর করে যদি নিজেকে শিক্ষিত ভাবো, তাহলে বাবা হিসেবে আমি মোটেই তোমায় নিয়ে গর্ব বোধ করব না। আর সোশ্যাল স্ট্যাটাস আবার কী? আমার বাবা সরকারী স্কুলে পড়াশোনা করেছে, আমিও তাই। কই, সমাজে মুখ লোকাবার মতো তো কিছু হয়নি! হ্যাঁ, তোমাকে আমরা বেসরকারী স্কুলে পড়িয়েছি, তবে মনে হচ্ছে সেটাই ভুল করেছি!
পরমা- ওগো, তুমি অত উত্তেজিত হয়ো না, বসো। দিনকাল বদলেছে, তোমার বাবা, তার বাবার কথা কি এখন চলে! প্রিয়মের সিদ্ধান্ত ওদেরই নিতে দাও বরং।
পরিমল- আচ্ছা, এই আমি চুপ করলাম।
জুঁই- বাবা, আপনি ঠিক বলেছেন। সোশ্যাল স্ট্যাটাসটা কোনও কাজের কথা নয়। আমিও সরকারী স্কুলেই পড়েছি, তাই জানি। তবে স্কুল থেকে এক্সপোজার পাওয়াটা জরুরী। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া, পরীক্ষা দেওয়া, এগুলো এই স্কুলে হয় না।
প্রীতি- রাইট। কিন্তু বৌদি, স্কুল চেঞ্জ করলে প্রিয়মের মনে চাপ পড়বে যে! পুরনো বন্ধুদের, চেনা টিচারদের আর কম্ফর্টেবল পরিবেশ ছেড়ে একেবারে নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতে পারবে তো?
জুঁই- এটাও ভ্যালিড পয়েন্ট। কিন্তু কখনো না কখনো তো ওকে নতুন কোথাও যেতেই হতো, তাই না? হতে পারে কম্পিটিশন পেলে ও পড়াশোনায় আরো ইন্টারেস্ট দেখাবে, ফ্লারিশ করবে!
প্রাসুন- বাবা রেগে গেছ জানি, কিন্তু একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখ… আমারও মনে হয় স্কুল চেঞ্জ করাটা জরুরী। এবার মেজরিটি যা বলবে।
প্রীতি- আচ্ছা, আমার একটা সাজেশন আছে। হোয়াই নট বাবা নিজেই ঐ স্কুলে গিয়ে কথাবার্তা বলুক, ভালো করে দেখেশুনে নিক ওদের কী ব্যবস্থা, তারপর আমরা ডিসিশন নেব! বাবা যদি মনে করে যে ঐ স্কুল প্রিয়মকে স্যুট করবে, তাহলেই আমরা ওখানে অ্যাডমিশনের কথা ভাববো, নয়তো নয়! কী বলো সবাই?
জুঁই- বাঃ, এটা খুব ভাল আইডিয়া। বাবা, আপনিই গিয়ে নিজে সব দেখে আসুন, কথাবার্তা বলে আসুন।
প্রসুন- ঠিক, সেটাই ভালো হবে। বাবার পছন্দ না হলে আমরাও আর এই নিয়ে কোন আলোচনা করব না।
পরমা- আরে তোরাও যেমন! তোর বাবা কী বুঝবে স্কুলে গিয়ে? নিজে কোনও একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঠিকঠাক?
পরিমল- এটা বলো না পরমা, তোমাকে আমি নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছি!
পরমা- ধ্যাত! তুমি না, একটা যা তা!
প্রীতি- ইয়েয়েয়েয়ে!! তাহলে ডিসাইডেড! আমি এখনই আনন্দকে ফোন করে বলছি স্কুলে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখতে।
পরিমল- আবার সেই আনন্দ! সে তো ক্রেডিট কার্ড বেচে!
প্রীতি- ধুর বাবা, সে কবে ছেড়ে দিয়েছে! এখন ও স্কুল কোঅর্ডিনেটর! দশটা স্কুলের ম্যানেজমেন্ট সামলায়!
প্রসুন- আগে ক্রিকেটার, তারপর ক্রেডিটার… তারপর কোঅর্ডিনেটর… আহা কী আনন্দ!
(সকলের হাসি)

ক্রমশ…  

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।