জাপানের বিখ্যাত কথাকার হারুকি মুরাকামির উপন্যাস লেখার শুরুটা খানিকটা আকস্মিকভাবেই হয়েছিল। মুরাকামি নিজেই জানিয়েছেন তাঁর প্রথম উপন্যাস হিয়ার দ্য উইন্ড সিং (শোনো বাতাসের সুর) লিখতে শুরু করার আগে অবধি তিনি সেভাবে লেখালেখি করেনই নি। তখন তিনি জাপানে একটি জ্যাজ ক্যাফে চালিয়ে দিন গুজরান করেন। ১৯৭৮ সালের ১ এপ্রিল একটি বেসবল খেলা দেখতে দেখতে এই উপন্যাসটির ভাবনা হঠাৎ করেই তাঁর মাথায় আসে। কাজ সেরে বাড়ি ফিরে তিনি রোজ একঘন্টা করে লিখতে থাকেন এবং চারমাস ধরে একটানা লিখে এই উপন্যাসটি শেষ করেন। উপন্যাসটি আকারে তেমন বড় নয়। চল্লিশটা ছোট ছোট অনুচ্ছেদ মিলিয়ে ১৩০ পাতার একটা পকেট বই। ১৯৭৯ সালের জুন মাসে জাপানের বিখ্যাত সাহিত্য পত্রিকা গুনজোতে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরের মাসেই এটি বই হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৭০ সালের অগস্ট মাসের কয়েকটা দিনের কাহিনী রয়েছে এই উপন্যাসটিতে। কাহিনীর শুরু ১৯৭০ সালের ৮ অগস্ট, যখন অনামা কথক গ্রীষ্মাবকাশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরেছে। উপন্যাসের সময়কাল আঠারো দিন। ২৯ অগস্টে গিয়ে কাহিনী শেষ হয়, যখন অনামা কথক গ্রীষ্মাবকাশ শেষে আবার ফিরে যাচ্ছে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে। কাহিনী বলতে অবশ্য একটানা কোনও আখ্যান নয়। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু স্মৃতিকথা, কিছু অনুভূতি, কিছু পর্যবেক্ষণ। উপন্যাসের কথকের কোনও নাম নেই এখানে। তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানাও যায় না। গরমের ছুটির অবকাশে সে কয়েকদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরেছে তার বাড়িতে। সেখানে ফিরে এক স্থানীয় পাবে যায় সে, মদ খেয়েই কাটিয়ে দেয় বেশিরভাগ সময়টা। অনামা কথকের বয়স মুরাকামির নিজের বয়সের সমান। ১৯৪৮ এর ২৪ ডিসেম্বর এই অনামা কথকের জন্ম আর মুরাকামির নিজের জন্মদিন ১২ জানুয়ারী ১৯৪৯ এ। উপন্যাসটিতে একটি বারে বসে এই অনামা নায়ক কেন অঢেল মদ্যপান করে, তার কোনও স্পষ্ট কারণ জানা যায় না। কদিন আগেই যার তৃতীয় প্রেমিকা হঠাৎ ই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু এজন্যই তার পানাসক্ত হয়ে পড়া না এ তার বহুদিনের স্বাভাবিক অভ্যাস, এর কোনও ইঙ্গিত উপন্যাসে নেই। কথক যদিও জানিয়েছে গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্যই তাদের এই মাত্রাতিরিক্ত বিয়ার পান – “গ্রীষ্মের এই গরমে আমরা যেন পাল্লা দিয়ে বিয়ার টানি। আমাদের খাওয়া বিয়ার দিয়ে ২৫ মিটারের সুইমিংপুল অনায়াসে ভরে ফেলা যায়। আর বাদামের খোসায় জে-এর বারের মেঝে পাঁচ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পুরো হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এটা যদি না করি, তাহলে গরমের অসহ্য যাতনা থেকে রেহাই পাওয়ার আর কোনো উপায় থাকে না”। তবে এ নিজের রক্তাক্ত হৃদয়কে নিরাসক্তি দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টাও হতে পারে। আমরা জানতে পারি কথকের শুধু এই তৃতীয় প্রেমটিই নয়, অনামা কথকের আগের দুটি প্রেমও হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম প্রেম ছিল হাইস্কুলের এক সহপাঠিনীর সাথে। স্কুল শেষ হবার কয়েক মাসের মধ্যেই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মেয়েটি কোথায় হারিয়ে যায়, তার আর সন্ধান পাওয়া যায় নি। দ্বিতীয় প্রেম স্টেশনে হঠাৎ আলাপ হওয়া একটি মেয়ের সাথে। ছাত্র আন্দোলনে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে কথকের ঘরে চলে আসে ও সেখানেই হপ্তাখানেক থেকে যায়। তারপর সেখান থেকে সে চলে যায় ও তাদের সম্পর্কের সেখানেই ইতি। তারপর এই তৃতীয় প্রেম, যার শুরুটা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে তাদের পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে। মেয়েটি ফরাসী ভাষা নিয়ে তখন পড়াশুনো করছে। পরের বসন্তেই হঠাৎ এই শোচনীয় পরিণতি, যে আত্মহত্যার কারণ কথক শুধু জানে না তাই নয়, অনুমানও করতে পারে না। কথক বাইরে থেকে নিজেকে নিরাসক্ত দেখানোর চেষ্টা করে, না সে সত্যিই নিরাসক্ত সে ধাঁধার উন্মোচন মুরাকামি এখানে করেন নি। পাঠক নিজের মতো করে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী।
কথকের মদ্যপানের সঙ্গী র্যাট বলে একজন। সে তিনতলা এক বাড়িতে থাকে, বেশ বড়লোক বাবার ছেলে। তা সত্ত্বেও সে বড়লোকদের কোনও এক কারণে তীব্র অপছন্দ করে, তাদের নিয়মিত গালাগালি করে থাকে। – “বড়লোকদের প্রতি র্যাটের মুখ খারাপ করা এটাই প্রথম নয়। আগেও বহুবার করেছে। তাতেই বোঝা যায়, আসলেই সে বড়লোকদের ঘৃণা করে। অথচ তার নিজের পরিবার মোটামুটি বড়লোকই। আমি তাকে তা স্মরণ করিয়ে দিলে জবাবও তার, ‘এ জন্য তো আমি দায়ী নই।” র্যাট ছাড়াও বারটেন্ডার জে’র সাথে অনামা কথকের মাঝেমাঝে কিছু কথাবার্তা হয় ও ক্রেতা খরিদ্দার সম্পর্কের বাইরে একটা হালকা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সে নিজে চিনা, কিন্তু তাদের থেকেও ভালো জাপানিজ বলে।
এই বারেই একদিন বাথরুমের কাছে একটি মেয়েকে অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে দেখে কথক। বারের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও তার কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। ব্যাগ থেকে পাওয়া ঠিকানার ভিত্তিতে তাকে তার ঘরে পৌঁছে দেয় কথক ও সেখানেই রাতটা থেকে যায়,যতক্ষণ না মেয়েটি সুস্থ হয়ে ওঠে। এই মেয়েটিরও কোনও নাম নেই আখ্যানে, তাকে আমরা চিনি বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটি নেই যার, এমন এক পরিচয়ে। এই মেয়েটির সাথে পরে কথকের আবার দেখা হয় তার কাজের জায়গায়, একটি রেকর্ডের দোকানে। এরপর আবার যখন মেয়েটি তার ঘরে আসে তখন সে জানায় সে এখন যৌন সংগমে অক্ষম, কারণ সদ্য তাকে গর্ভপাত করাতে হয়েছে।
লেখালেখি সম্পর্কে এই অনামা কথক উপন্যাসের এখানে সেখানে তার বেশ কিছু ভাবনা চিন্তার কথা জানিয়েছে। “গল্প লেখা স্বচিকিৎসার কোনো ব্যাপার না। বরং বলা ভালো, তা স্বচিকিৎসার হীন চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে স্বীকার করতেই হবে যে, সততার সঙ্গে কোনো কাহিনী বলা খুবই কষ্টকর। কেননা আমি যেসব শব্দ খুঁজে বেড়াই, তা মনে হয় গহীন গভীরে গিয়ে লুকায়। এটা একেবারেই সত্যনিষ্ঠ স্বীকারোক্তি, কোনো কৈফিয়ত নয়। তবে শেষ পর্যন্ত আমি যা লিখেছি, তা-ই সেরা, এর চেয়ে ভালো লেখা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। এ ছাড়া এ ব্যাপারে আমার আর কিছু বলার নেই। এখনো আমি ভাবছি, যেভাবে তুমি এখন দক্ষ, বছরের পর বছর, কিংবা দশকের পর দশক আগে তুমি তা ছিলে। এভাবে চিন্তা করলেই তুমি তোমাকে বাঁচাতে পারো বলে আমার ধারণা। তবে তার পরও যখন তোমার কাজ হয়ে যাবে, তখন হাতি সমতলে ফিরে এসে তোমার চেয়ে আরো সুন্দর শব্দে তার নিজের কাহিনী বয়ান করতে সক্ষম হবে”। … “লেখালেখি নিয়ে আরো কিছু লিখছি। তবে এটাই হবে আমার শেষ কথা। আমার কাছে লেখালেখি খুবই কষ্টকর একটা ব্যাপার। কখনো কখনো মাস কেটে যায়, একটা লাইনও লিখতে পারি না। আবার কখনো কখনো একটানা তিন দিন তিন রাত ধরে লেখার পর একসময় বুঝতে পারি, যা কিছু লিখছি তা কিছু হয়নি। এই সব কিছু সত্ত্বেও লেখালেখির মধ্যে আনন্দ আছে। জীবনযাপনের সমস্যাদির সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, লেখালেখির মধ্যে অর্থবহ কিছু খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ। এটা যখন আমি বুঝতে পারি, তখন আমার বয়স খুব কম। তাই বিস্ময়ে সপ্তাহখানেক ধরে হতভম্ব হয়ে থাকি।”
কথকের বাবা মার কথা এখানে কিছু নেই। তবে তার তিন কাকার উল্লেখ আছে। একজন জাপান জুড়ে বিভিন্ন উষ্ণ প্রস্রবনে ঘুরে ঘুরে বেড়ান। একজন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ঠিক দুদিন পরে নিজের পাতা মাইন বিস্ফোরণেই মারা যান। আর এক কাকা মারা যান ক্ষুদ্রান্তের ক্যান্সারে। এই কাকাই তাকে ডেরেক হার্টফিল্ড এর উপন্যাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এই কাল্পনিক ঔপন্যাসিককে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে এই আখ্যানে নিয়ে আসেন মুরাকামি। এই কল্পিত লেখক চরিত্রটি অনেক জনপ্রিয় উপন্যাসের রচয়িতা। দৈত্য, দানো, ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে কাহিনী ফাঁদতে তিনি ছিলেন ওস্তাদ। কথক জানিয়েছেন তিনি এনার থেকেই লেখার অনেক কলাকৌশল শিখেছিলেন। – “লেখালেখির ব্যাপারে ডেরেক হার্টফিল্ডের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। অবশ্য বলা উচিত, পুরোটাই তাঁর কাছ থেকে শেখা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে হার্টফিল্ড নিজে একজন সাধারণ মানের লেখক ছিলেন। আপনি যদি তাঁর বই পড়ে থাকেন, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন আমি কী বলতে চাচ্ছি। তাঁর লেখা পড়া খুব কষ্টসাধ্য। আর লেখার প্লট এলোমেলো, থিম একেবারেই শিশুসুলভ। এসব সত্ত্বেও যে কজন অসাধারণ লেখক তাঁদের লেখাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের মধ্যে তিনি অনন্য। হেমিংওয়ে, ফিৎজারেন্ডের মতো তাঁর সময়কার অন্যান্য লেখকের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছি যে তাঁর লেখালেখি তেমন সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়নি বলে আমার মনে হয়েছে”। … “ভালো লেখালেখির ব্যাপারে হার্টফিল্ড যা বলেছেন, তা জড়ো করলে দাঁড়ায় এ রকম—‘তিনি লেখক, যিনি সাহিত্য লেখেন। তাই বলা যায়, লেখকের লেখাই হবে মূলকথা। তিনি সব সময় দূরত্ব বজায় রাখবেন। আর তিনি কী বুঝলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং তিনি কী মাপকাঠি ব্যবহার করেছেন, সেটাই বিবেচনার বিষয়”।
মজার ব্যাপার হল মুরাকামির উপন্যাসটি প্রকাশিত ও জনপ্রিয় হলে অনেক পাঠকই ডেরেক হার্টফিল্ডকে একজন বাস্তব লেখক হিসেবে ধরে নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থাগারে তাঁর বই এর খোঁজ করতে থাকেন ও গ্রন্থাগারিকেরা এই নিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়েন।