জন্মস্থান – পুরুলিয়া
পেশা – সরকারি চাকরি
প্রকাশিত কবিতা বই :-
১) ডানায় সে চুম্বকত্ব আছে
২) উন্মাদ অন্ধকারের ভিতর
৩) ভিতরে বাইরে
৪) পোড়া নক্ষত্রের কাঙাল
৫) মুসলপর্বের স্বরলিপি
৬) কৃষ্ণগহ্বর
৭) শরীরে সরীসৃপ
৮) প্রেমের কবিতা
৯) পোড়ামাটির ঈশ্বর
১০) ঈর্ষা ক্রোমোজোম
উপন্যাস
১) কৃষ্ণগহ্বর
পূর্ব প্রকাশিতের পর…
সৌরভ। কবিতা লেখা যুবক। না, যুবক না বলে তরুণ বলাই ভাল। গ্রীণ হোস্টোলের ছোট্ট ঘরটাতে বসে কবিতা লিখছে যে তরুণ তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেল। বর স্কুলে পড়ায়। অঙ্কের শিক্ষক।
আরে গর্দভ অঙ্ক না হলে চলে! এটা যদি সৌরভ বুঝত! তাহলে হাত ফসকে কীভাবে কীভাবে ছিটকে যায় ” এই হৃদি ভেসে যাওয়া অলকানন্দা জল।”
তখন তুমি বারো ক্লাসের অধরা মাধুরী আর আমি প্রথম বর্ষের ইংলিশ। ‘ং’ মুছে মাছ হতে ইচ্ছে হত। সাঁতার কাটতে উচ্ছে হত। পয়সাওয়ালা মানুষের কিচেনে যেতে ইচ্ছে ছিল না বলেই ‘ং’ রেখে দিলাম। তোমার রেজাল্ট খারাপ হল। আমার দিকে আঙুল তুললে! অথচ একটাও চুমু না। ঠোঁট তো দূর কি বাত গাল পর্যন্তই যেতে পারিনি। দু’দুবছর ধরে প্লেটোনিক মারালাম। একেবারে কাঠকাঠ। শুকনো গাছের ডাল। রসহীন যাচ্ছেতাই মাইরি! ইচ্ছে কী হত না জড়িয়ে ধরতে! পাগল! ভয়েই মরে যেতাম। মাইরি, আজকালকার ছেলেমেয়েদের দেখলে না কেমন যেন ইয়ে মনে হয়। মনে হয়, আমরা শালা ফেকলু ছিলাম। নাকি আমাদের সময়ই ছিল অমন ফেকলুমার্কা। গবেট।
ভয়ে মরে যেতাম মাইরি! তোমার কি ইচ্ছে হত না! কিন্তু শালা বেকার কা জীবন তুমি ছোঁবে কেন আমায়! দ্যাখো বুকটা পুড়ে যাচ্ছে মাইরি। তুমি বিয়ে করছ! অন্য পুরুষের সঙ্গে শোবে! ভালোবাসবে! পারবে অন্যের থুতু, লালা, বীর্যের সহবাসে নিজেকে তুমুল ভাসিয়ে আবার ডুবিয়ে আবার ভাসিয়ে দিতে! ছিঃ! ওয়াক থু! কিন্তু কাকে এই ওয়াক কাকে এই থু! তোমাকে না আমাকে!
চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলল সৌরভ। জীবনে কাউকে চিঠি লেখেনি। ক্লাসে শুনেছে কীটস তাঁর প্রেমিকা ফ্রেনি ব্রাউনকে চিঠি লিখত। “For many a time/ I have been half in love with caseful death.”
“দেখ সৌরভ তোর প্রবলেমটা বুঝি কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই। তাই হাত পা গুটিয়ে বসে আছি। নাহলে… কিন্তু তুই ভাবছিস অন্যকিছু!” কাঁধে হাত রেখে বলল কৌস্তব।
” আসলে ঘুম হচ্ছে না আর ঘুমের বড়ি খেতেও ভয় হচ্ছে । যদি ফুটে যাই। ঘুম যদি আর না ভাঙ্গে। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে নিজের ভিতর কেউ যেন কোদাল দিয়ে খুঁড়ছে। কোপাচ্ছে মাটি কোপানোর মত। সুইসাইড করব করব করেও করতে পাচ্ছি না ভিতরের অন্য আমি বলছে চুপ শালা অমন হাজারটা মেয়ে তোর পিছনে ঘুরবে। একবার এস.এস.সি বা সি.এস.সি টা লাগিয়ে দে। তখন দেখবি কী ভাল লাগাটাই না লাগবে! বলত কৌস্তব, ভাল লাগার আছেটাই বা কী! ” মুখ নিচু করে কথাগুলো বলে গেল সৌরভ।
” তুই কী ভাবছিস! কী করবি এখন?”
” ভাবছি তো অনেক কিছুই। কিন্তু ভাবলেই তো হবে না। শালা মেয়েটা সব গুবলেট করে দিয়ে গেল।” বিরক্তি নামছে সৌরভের গলায়।
” আচ্ছা চল লেবু দেওয়া লাল চা খাই।”
“দশটা বেজে গেছে। আর বোধ হয় পাওয়া যাবে না। তবু একটা ট্রাই নেওয়া যাক, চল।” দুই বন্ধু বাইকে উঠল।
ফেনি ব্রাউন কি কীটসকে বিয়ে করেছিল? করেনি! কেনই বা করবে। বিয়ের তো যোগ্যতা লাগে। রোজগার লাগে। টাকা লাগে। অঢেল খরচা করার হিম্মত লাগে। নইলে মেয়েরা শোবে কেন বিছানায়! প্রেম প্রেম ভাব দু’চারদিন থাকলেও থাকতে পারে। তারপরের গল্পটা কিন্তু আলাদা আর সেটা হল ফেলো কড়ি মাখো তেল। কৌস্তব বলেছিল, “এটাই স্বাভাবিক ব্রাদার, অন্যরকম হলে জানতে হবে কোথাও কোনো গণ্ডগোল আছে।”
সৌরভ তার মেসের বন্ধু তুষারকে ফোন করল। সুইচ অফ। ধ্যাত শালা। ফোন বন্ধ করে কেউ শুয়ে থাকে! হ্যা, কেউ না থাকলেও তুষার থাকে। তার থাকতে পছন্দ হয়। আরামবাগের ছেলে তুষার। বাড়ি খুব কমই যায়। বাড়িতে মা আর দাদু। বাবা নেই।
বাবা কোথায় জানে না তুষার। কেন নেই জিজ্ঞেস করা হয়নি। মা তো কখনও বলেনি বাবার কথা। দাদু কি বলেছে মনে করতে পারছে না তুষার! বাবা তাহলে কোথায়! মাকে খুব তারিবত করেই সিঁদুর পরতে দেখেছে কিন্তু কখনও জজ্ঞেস করা হয়নি বাবা কোথায়! এই সব ভাবনা এলেই কেমন যেন লাগে। থালা বাটি ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছে করে। কাচের গ্লাস ভেঙ্গে মেঝেতে ছড়িয়ে তার উপর খালি পায়ে নাচতে ইচ্ছে করে। কিছুই ভাল লাগে না। তখন নিজেকে স্বাতীর কাছে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। যা কিছু সুখ, শান্তি আর আনন্দ- সোয়াদ সব কিছুই ওই স্বাতীর কাছে পেয়েছে তুষার। তুষারের দুঃখ এলে তাই স্বাতীর কাছে চলে যায়। স্বাতীও মেসে থেকেই পড়াশোনা করে।
স্বাতী তো কেবল বন্ধু ছিল তুষারের। যেদিন সৌরভের প্রেম ফালাফালা হল, ধুরমুশ করে মৌপর্ণা চলে গেল অন্য পুরুষের বিবাহে ও সহবাসে সেদিন তুষার কেঁদেছিল। স্বাতী ওকে বুকে টেনে নিয়েছিল। চোখের জলে ভিজে গিয়েছিল বুক। টপ পেরিয়ে ব্রেসিয়ার ছুঁয়ে কান্নার নোনাজল স্তনে মেখে স্বাতী অনুভব করেছিল পুরুষের প্রেম আর কান্না। একজনের প্রেম হারানোর যন্ত্রণায় আর একজনের আর্তি। এই তো কঠিন ও রুক্ষ জীবনের মাঝে বন্ধুতার সরল সমীকরণ। সৌরভ কাঁদেনি। সৌরভ কি তার কান্না লুকিয়ে নিয়েছিল কবিতার অক্ষর যাপনে!
সৌরভ যখন তুষারের মেসে পৌঁছে দেখে রুমে তালা ঝুলছে। তখনই বুঝতে পারল তুষার মোবাইল অফ করে আজ ঘুমিয়ে নেই। তাহলে ছেলেটা গেল কোথায়! কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয়! না থাক। নিশ্চয় স্বাতীর কাছে গেছে।
ও আজ তো রোববার! এতক্ষণ খেয়াল ছিল না সৌরভের।
রাস্তার দোকান থেকে এক ঠোঙা গরম জিলিপি আর সিঙাড়া কিনল সৌরভ। বেঞ্চিতে বসে একটা একটা করে খেয়ে নিল। দুপুরে কিছু খাওয়া যাবে না। যদিও দুপুরে খাওয়া আর না খাওয়াতে কিচ্ছু যায় আসে না তার। কারণ বাঁকুড়া শহরে আসার পর সৌরভ খুব কম দিনই দুপুরে খেয়েছে। সকাল দশটাই ভাত, ডাল খেয়ে নেয় পেটপুরে। তারপরে বিকেলের আগে আর খিদেই লাগে না। সে কথা যাক, সৌরভ আজ একটি নতুন বিষয় আবিষ্কার করল। জিলিপির নিজের প্যাঁচ থাকে বটে কিন্তু অন্যের মাথার প্যাঁচ খুলে দিতে পারে। সৌরভের ভাবনার স্রোতমুখ খুলছে এখন। ও ভাবল এই মিরাকল জিলিপি খাওয়ার পরপরই ঘটল।
তুষারের স্বাতী আছে। কৌস্তবের গীটার। সৌরভ তোর কী আছে! নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করল। কতদিন মায়ের মুখটা দেখেনি সৌরভ। বাড়ি যেতে ইচ্ছে হল তার। ব্লটিং পেপারের মতো অবাঞ্চিত এই সময়টুকু পার করতে হবে তাকে। তারপর জীবন হয়ত সহজ পথে গড়াবে। যদি না গড়ায়! কী করবে সে, পাগল হয়ে যাবে না তো! না, না, এইরকম ভাবনা কেন আসছে আজ!
পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই তুষার চলে এল। বাইক স্ট্যান্ড করে জল খেল।
সৌরভ জিজ্ঞেস করল, “তোদের খবর কী রে! কেমন আছিস?”
তুষার হাসল। বলল, ” বহুবচন কেন রে ভাই!”
” ন্যাকা! আমি জানতে চাইছি এতক্ষণ কী স্বাতীর কাছে ছিলি নাকি!” সৌরভ তুষারের মুখের দিকে তাকাল।
তুষার হাসতে হাসতে বলে, ” ভালই জ্যোতিষ চর্চা করছিস! ” কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে, ” জানিস, স্বাতী মেয়েটা খুব ভাল রে। ও না থাকলে আমি ভেসে যেতাম। আমার যে কী হত আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারি না।”
” স্বাতী তোকে ভালবাসে!” বিষ্ময় ছুঁড়ে দেয় সৌরভ।
” জানি না!”অবাক হয় তুষার।
সৌরভ তুষারের দিকে তাকায়। বলে,” স্বাতী যদি ফেনি ব্রাউন হতে চায়- যেমন মৌপর্ণা হয়ে গেল।”
“তুই কী বলতে চাস!” বলেই চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাগজের কাপটা দলা পাকিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় তুষার। সৌরভ অমন ভাবছে কেন! তুষারকে কি তার হিংসে হয়! অথচ সৌরভের প্রেম ভেঙ্গে গেলে তুষারের কান্না পায়। তুষার কাঁদে। তা’লে এমন বলছে কেন সৌরভ। স্বাতী উলটে গেলে কি সৌরভের ভাল লাগবে! আর স্বাতী উল্টাবেই বা কেন!
তুষার সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিল। বসন্তের দখিনা বাতাসে মিশে যাচ্ছে সেই ধোঁয়া। সেই সাদা সাদা ধোঁয়ার বিবর্ণ হয়ে যাওয়ার দৃশ্যও আজ উপভোগ্য মনে হয় তুষারের।
তুষার দেখল তার বিছানায় সম্পূর্ণ নগ্ন এক নারী তাকে ডাকছে। এই ডাক তো অতল জলের আহবান। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। এর আগে তুষার কখনও সম্পূর্ণ নগ্ন ও নির্জন নারী দেখেনি। তাই এত বিহ্বল। আবার পরমুহূর্তের ভয় ও সংকোচ তাকে কুঁকড়ে দিচ্ছে।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল স্বাতী। এক ধাক্কায় বাধ্য ছাত্রের মতো শুয়ে পড়ল তুষার। এক একটা টানে পোশাকের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ছে তুষার। তুষারের বুকের কাছে তিরতির করে কাঁপছে স্বাতীর গাঢ় গোলাপি নিপল। তাতে তুষারের লকলকে জিভের স্পর্শ! শরীরময় যাদু পালকের ছোঁয়া। জেগে উঠছে আদিম দেবতা। অবদমিত প্রাণের স্পন্দন। গ্রীষ্মের দাবদাহে পরস্পর পরস্পরের গ্রন্থনায় জেগে উঠছে দেহগত যজ্ঞের আহুতি। না, পাপ তো মনে হয়নি সেদিন। স্বাতীকে সে কথা বলেছিল তুষার।
স্বাতী বলেছিল,” আরে মনে হল বললাম। আসলে কিন্তু এটা পাপও নয় আবার পুণ্যও নয়। এ হল গিয়ে দুটি শরীরের আদিম গ্রহণ ও বর্জন। দুটি দেহের প্রেম ও নির্জন পূজা।”
এতটাই সহজ, সরল, আদিম আত্মভোলা মেয়ে কি তাকে ছেড়ে যেতে পারবে কোনো দিন! যদি যেতে বাধ্য হয় কোনোদিন, কোনো কারণে! অথবা অকারণে!
আজ থেকে সে সব ভেবে দুঃখ না পেলেও চলে। অনাগত দিনের কাল্পনিক বাস্তবতা তার হৃদয়কে মথিত করবে কিনা সে ভাবনাকে ইরেজ করে এগিয়ে যাওয়ায় তো জীবনের জার্নি। তুষার আপাতত সেই দিকেই বলছে চল লেটস গো…