দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২)
by
·
Published
· Updated
‘যেনাহং নামৃতা স্যাং’
৮
অতিথিরা চলে এলেন। বাইরে তখন যাকে বলে কনে দেখা আলো। বাবার সাথে কথা হয়ে যাবার পর মায়ের সাথে কোনও কথা বলেনি শ্যামলী। কেননা, মায়ের নিজের কোনও মত নেই। বাবা যা বলেন , আর বাবার গুরুদেব যা বলেন , সেটাই মায়ের মত।
অতিথিদের সামনে বসলো শ্যামলী।
নাম জানতে চাইলেন ছেলের বাবা। বলতে হল। কি পড়াশুনা কর? বলতে হল। অঙ্ক নিয়ে কেন পড়ছ?
এই জায়গাটায় একটু থমকে গেল শ্যামলী। সে চেয়েছিল অটো মোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। বাবার ব্যবসাটা হাতে কলমে বুঝবে। নইলে কমার্স। হিসেবটা অন্ততঃ নিজে দেখবে। বাবা স্পষ্টতঃ চান নি। শশাঙ্ক পাল ভাবতেই পারেন না যে তার কনিষ্ঠা কন্যা পৈতৃক কারবার দেখাশোনা করছে। শ্যামলী চুপ করে থাকে।
বললে না তো অঙ্ক নিয়ে কেন পড়ছ ?
কি বলা যায় বুঝতে পারছি না। শ্যামলী নিজের অস্বস্তি গোপন করার চেষ্টাও করে না।
সে কি, একটা বিষয় নিয়ে পড়ছ, কিন্তু কেন পড়ছ তা বলতে পারছ না? ছেলের পিসেমশায় বেশ মুরুব্বিয়ানা করে বলেন।
বলতে পারলে ভাল হত হয়ত। কিন্তু সত্যি সত্যি জানি না কেন অঙ্ক নিয়ে পড়ছি। কেন সংস্কৃত নিয়ে পড়ছি না। বলতে পারলে ভাল হত।
এতো বেশ মজার কথা। হচ্ছিল অঙ্ক নিয়ে পড়ার কারণের কথা। তুমি আবার টেনে আনলে সংস্কৃতের কথা। ব্যাপারটা কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে।
বীরুকাকা তাড়াতাড়ি বলে বসলেন – না, ওর দিদি তো সংস্কৃতে এম এ করেছে। ওই জন্যে সংস্কৃতের কথা বলছে।
ধারালো চোখে চান পিসেমশায়।
দ্যাখো , তুমি টুয়েলভে অঙ্ক পড়েছ। তোমার সায়েন্স ছিল। নেহাত কম নম্বর পেলে তোমায় ওরা অঙ্ক নিয়ে পড়তে দিত না। যুক্তিতে এসো।
হ্যাঁ , আপনার কথা খুব যুক্তিযুক্ত। শ্যামলী খুব নম্র হয়ে বলে।
কিন্তু তোমার অঙ্ক পড়ার কার্যকারণ কী ?
কি জানেন , ভারতীয় মেয়েদের যুক্তি বা কার্যকারণ নিয়ে বিশেষ ভাবা মানা।
তার মানে? পাশ থেকে পাত্রের কাকা বলে ওঠেন। যুক্তি বা কার্যকারণ নিয়ে ভাববে না ?
ভাববো নিশ্চয়। কিন্তু বেশি ভাবলে প্রবাহণ রাজার সভায় যাজ্ঞবল্ক্য গার্গী -র মাথা নামিয়ে দেবার হুমকি দেবেন।
পাত্রের মা বললেন, তোমরা কি যে বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। গার্গী আবার কোন মেয়ে ? ওকে কে হুমকি দিচ্ছে?
শোন বৌদি , গার্গী একজন মহিলা পণ্ডিত। যাজ্ঞবল্ক্য আর এক পণ্ডিত। অনেক আগের কথা।
শ্যামলী মাথা নিচু করে বলল গার্গীর কথায় যুক্তি আছে না নেই , সেটা বড়ো নয়। যাজ্ঞবল্ক্য গ্রুপের গায়ে জোর বেশি। জোর যার মুলুক তার।
শশাঙ্ক পাল রেগে ওঠেন। মেয়ে পড়াশোনায় ভাল। তাই অঙ্ক নিয়ে পড়তে দিয়েছি।
শ্যামলী বলল – ওই তো বাবা বলে দিলেন।
সে কি মা, বাবা বললে চলবে কেন? আমরা তো তোমার সাথে আলাপ করতে এসেছি।
যা জিজ্ঞাসা করবেন জানা থাকলে উত্তর দেব।
তোমার কি কিছু জিজ্ঞাসা আছে ?
শ্যামলী বলে ফেলল – জিজ্ঞাসা মানুষের সব সেরা প্রবৃত্তি। ওই জন্যে সেরা মানুষদের জিজ্ঞাসু বলে। ওটাই মনুষ্যত্বের পরিচয়।
কেবল পাকা পাকা কথা। এটা তোমার কলেজের ডিবেট নয়। যা জানতে চাইছেন সোজা সরল উত্তর দাও। শশাঙ্ক পাল গর্জে ওঠেন।
দেখছেন তো – আমার মতপ্রকাশের কি চমৎকার ব্যবস্থা ?
ইতিমধ্যে ট্রলি ঠেলে বীরুকাকু সাজানো মিষ্টির প্লেট নিয়ে হাজির।
৯
সকালে উঠে কলেজ যাবার জন্যে তৈরি হতে হতেই শ্যামলী খবর পেল বীরুকাকু হাঁক ডাক করছেন যে পাত্র পক্ষের মেয়ে খুব পছন্দ হয়েছে। সবিতা পিসি তার সাথে তর্ক জুড়েছে যে এ মেয়েকে পছন্দ হবারই কথা। যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনি ঝকঝকে বুদ্ধি, এ রকম ওরা আর পাবে কোথায় !
কলেজে বের হবার সময় সবিতা পিসি তার কানে কানে বলল আজ বিকেলে পাত্রের বন্ধুরা আসছে।
পার্স –এ গোণা গুণতি পয়সা। কলেজে কেঊ বিশ্বাস করবে না যে শ্যামলীর কাছে টাকা নেই। শ্যামলী বাবার কাছে পয়সা চাওয়া বন্ধ করেছে। কিন্তু কি করে যে চলবে সেটা এখনও ভেবে উঠতে পারে নি। ঠিক করলো যে উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করায় পল্লী সুজন সংঘ থেকে যে হাতঘড়িটা উপহার দিয়েছে , ওটা বেচে দেবে। তার পর টিউশনি ধরবে।
কলেজ থেকে ফেরার পর বই খাতা নিয়ে বসলো শ্যামলী। ঘড়িটা বেচা গিয়েছে। দোকানদার কিছু জানতে চায় নি। লোকটা ভদ্র। একজন নাগরিকের কোনও একটা সমস্যা হতেই পারে। নিজের জিনিস বেচার অধিকার তার থাকতেই পারে। কোনও কৈফিয়ত দাবি না করে দোকানদার যে তাকে টাকা ধরিয়ে দিয়েছে এর জন্যে সে কৃতজ্ঞতা বোধ করলো।
১০
শ্যামলী মাধ্যমিকে যে কোচিং ক্লাসে পড়তো , সেই মাস্টারমশাইকে ফোন করবে ভাবল। তার পর ভাবল এ বাড়ির ফোন সে আর ব্যবহার করবে না। বিকেলের পর মাস্টারমশাই একবার হাঁটতে বেরোন। তখন এ বাড়ির সামনে দিয়ে যান। সেই সময় তাঁর কাছে গিয়ে কথা বলবে। ঘড়িটা বেচে যে টাকাগুলো সে পেয়েছে, সেটা পুরোনো স্কুল ব্যাগে ভারি গোপনে সে রেখে দিল। তার পর স্নানঘরে গিয়ে ঢুকল সে। আয়নার সামনে এক এক করে কানের, নাকের ও গলার অলঙ্কারগুলি খুলতে থাকল সে। সব শেষে নিজেকে দেখল সে দর্পণে – নিজের কাছে জানতে চাইল, তবু কি তোর ইচ্ছে করে পরের হাতে ঘুরতে ঘুরতে বিন্দু বিন্দু জীবন যাপন? দর্পণের ভিতরে ওর নিজস্ব আমি চোখ মেলে ঘরোয়া মেয়েটির সাথে কথা কওয়া শুরু করল।
১১
মায়ের চাপে শাড়ি পরতেই হল শ্যামলীকে। কোনও ভদ্র বাড়ির মেয়ে না কি লোকজনের সামনে শাড়ি ছাড়া পরেই না। হায় মা, তুমি তো খবরই রাখো না যে বাঙালি মেয়ে শাড়ি পরে দশজনের সামনে বেরোতে পারলো কার সৌজন্যে ? শোভন সুন্দর করে শাড়ি পরতে গেলে যে অন্তর্বাস ব্যবহার করে বাঙালি মেয়ে, তা কবে এলো।
এ মা, তোর নাকে কানে গলায় …। একি এসব ফাঁকা কেন? মা আঁতকে উঠলেন। ওমা, তোর কি হয়েছে বল মা, কোথায় ফেলে দিলি সব?
নিরুত্তাপ গলায় শ্যামলী মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে – গয়না পরতে তার ভালো লাগে না। মনে মনে মাকে বলতে চায়, সোনার হাতে সোনার কাঁকন কে কার অলঙ্কার? মা গো, আমি বাড়িতে কতো গয়না পরি, সেই দেখে কেউ আমার বাবার আর্থিক উপঢৌকন দেবার ক্ষমতা জরিপ করুক সে আমি চাই না।
১২
বীরুকাকু জেনে এসেছেন যে পাত্রের বন্ধুরা আজ শ্যামলীর নিজের হাতে বানানো চা খেতে চায়।
সে কি , আমায় চা বানাতে হবে কেন?
সবিতা পিসি তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, লক্ষ্মী মেয়ে আমার, এবারের মতো পার করে দে।
পিসির কথা শুনে হাসি পেলো শ্যামলীর। না, বাড়িতে আমি চা করি না বলে করতে পারবো না তা তো নয়। ওটা কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু আমার হাতে চায়ে কি ওরা বাড়তি টেস্ট পাবে? এই আব্দারটা কেন আমায় শুনতে হবে? কোনও সদুত্তর মিলল না।
চায়ের জন্যে ভালো সেট আছে বাড়িতে। তবে ব্যবহার হয় না। আজ মা বের করলেন সেই সেট।
পাত্র আসেন নি। তার জনা পাঁচেক বন্ধু এসেছেন। সবাইকে বসানো হলে সবিতা পিসি যেন কিছু জানেন না এমন ভান করে বললেন – আপনারা চা না কফি? শ্যামলীর হাসি পাচ্ছিল। সে সবিতা পিসিকে বলল – পিসি তুমি চায়ের সরঞ্জাম এখানে পাঠাও, তার পর আমি দেখি কি করতে পারি। বন্ধুরা হুররে করে উৎসাহ প্রকাশ করল। পট থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে শ্যামলী বলল – এই ইংলিশ টি বানালাম। এবারে দুধ আর চিনির কিউব নিজের নিজের খুশিমতো নিয়ে নিন অনুগ্রহ করে। বন্ধুরা খুশি। পাত্রী এত সহজে চা করে খাওয়াবে তারা আশা করে উঠতে পারে নি। একজন বলে উঠলো – আপনার দারুণ সুখ্যাতি শুনে এসেছি আমরা। আপনি না কি চমৎকার কথা বলেন। এখন বুঝছি নেহাত ভুল শুনি নি। শ্যামলী বলল – যার কারণে আপনাদের আসা, তিনি কি এসেছেন?
সে কি, আপনি তার ছবি দেখেন নি?
না, নামটাও জানি না।
১৩
শ্যামলী বলল এক রাজা বিয়ে করার জন্যে তার বন্ধুদের সাথে নিজের বীণাটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কন্যে এলেন রাজপুরীতে সেই বীণার গলায় মালা দিয়ে। একজন বন্ধু বলে উঠলো – হ্যাঁ হ্যাঁ শুনেছি বটে। শ্যামলী বলল – রাজা নাটকের গল্প। ওই গল্পসূত্র ধরেই অরূপরতন, পরে শাপমোচন। রবীন্দ্রনাথের ভারি ভালবাসার প্লট।
সবাই বলল – হ্যাঁ হ্যাঁ শাপমোচনের গল্প।
তো যার সাথে বিয়ে হল তাকে দেখতে পায় না বলে রাণী সুদর্শনার ভারি দেখার আগ্রহ। সেই আগ্রহ থেকে অগ্নিকাণ্ড।
সবাই বলল হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। বর দেখতে ভাল নয় বলে ভারি গোলমাল হল।
শ্যামলী বলল – রূপক সাংকেতিক নাটক বলে আগে থেকে সাইনবোর্ড লাগিয়ে সুদর্শনার মেয়েজীবনের আকুতিগুলোর মুণ্ডপাত করা হয়। সত্যি সত্যি তো যন্ত্র বীণাকে ভালবেসে কোনও মেয়ে শ্বশুরবাড়ি আসে না। একটা মেয়ে একটা রক্তমাংসের পুরুষকেই খোঁজে।
অন্য একজন বলে উঠলো আপনার চায়ের মতোই আপনার কথা বলাও ভারি সুন্দর। আমাদের বন্ধুর গুরুজনেরা সবাই তো আপনার বাকপটুতায় মুগ্ধ।
শ্যামলী বলল শুধু কথায় তো চিঁড়ে ভিজবে না। কথার পিছনে ওজনটা কি আছে তাঁরা নিশ্চয় আন্দাজ করেছেন।
আপনি এক রকম ফাইনাল বলেই জানবেন। আমাদেরও খুব পছন্দ হয়েছে আপনাকে। আপনি যখন চা বানাচ্ছিলেন, সেটা দেখতেই কী ভাল লাগছিল।
শ্যামলী বলল – গোরা উপন্যাসে সুচরিতার এক বোন তো ওই রকম কারণেই বাড়িতে লোকজন এলে ক্রুশ কাঠি নিয়ে সেলাই করতে বসে যেত। কেউ কখনো তাকে বলেছিল – ক্রুশ কাঠি নিয়ে সেলাই করার সময় তার হাত দুটির খেলা দেখতে খুব ভাল লাগে। আর অমনি সে মেয়ে সে কথা বেদবাক্য বলে ধরে নিলো।
আপনি রবীন্দ্র সাহিত্য খুব ভালবাসেন, তাই না?
ভাল আর বাসতে পারলাম কই? মোটে আঠারো বছর বয়স পেরিয়ে উনিশে পা দিয়েছি আমি। বেশি পড়ার সুযোগ হল কোথায় আমার?
আপনার কি এই বিয়েতে মত নেই?
১৪
বিয়ে জিনিসটা আমার কাছে একটা চুক্তি।
না, আপনি পরিস্কার করে বলুন, আপনার মত আছে না নেই?
যদি বিয়েটা যার সাথে হচ্ছে, তাকে জানা না যায় , তা হলে তো মত দেবার প্রশ্ন উঠছে না। যাকে জানি না, চিনি না , দেখি নি, তার সাথে বিয়ের মত এর কথা উঠতে পারে না।
আমরা এই যে এসেছি , এটাকে আপনি কিভাবে নিয়েছেন?
একজন ভারতীয় মেয়ে যেভাবে নেয়।
কিভাবে নেয় ?
ওই এক রকম নেয়।
ভারতীয় মেয়ে বলতে আপনি কি মনে করেন?
ভারতে জন্মেছে – এমন একটা মেয়ে।
ভারতে জন্মালেই ভারতীয়?
না, বইতে আছে, ভারতীয় বাবা মায়ের কোলে জন্মালেও ভারতীয়।
জন্মেই ভারতীয় হওয়া যায় ?
না জন্মালে তো মানুষই নয়। আগে তো জন্ম।
ভারতীয় মেয়ে বলতে আপনি সীতা সাবিত্রীকে বোঝেন না?
রামায়ণ মহাভারত এসব গল্পে সীতা দ্রুপদ নন্দিনী কুন্তী শকুন্তলা এদের কথা জানা যায়।
রামায়ণ মহাভারতকে গল্প মনে করেন?
উপন্যাস তো নয়।
ওগুলো মহাকাব্য মনে করেন না?
কাব্য হিসেবে তো পড়ি নি, গবেষণাও করি নি। গল্পের মত করে কিছু কিছু ঘটনা জানা আছে।
সীতা দ্রুপদ নন্দিনী কুন্তী শকুন্তলা এদের কথা বললেন। এদের কি মনে হয়?
বঞ্চিত মেয়ে। ঠকে যাওয়া মেয়ে।
কি রকম?
সীতা দ্রুপদ নন্দিনী আর শকুন্তলা এই তিনজনের জন্মের কথাটা ভাবুন।
কি রকম?
কন্যা সন্তান বর্জনের কথা মনে হয়।
আর কুন্তী ?
বালিকা বয়সে একজন পরিচিত পুরুষের হাতে ধর্ষিতা মেয়ে।
ধর্ষিতা?
ধর্ষণের মত ঘটনা না হলে পরিচিত ব্যক্তি হিসেবে সূর্য তাঁকে বিয়ে করতে পারতেন। সূর্য কুন্তীর সরলতাকে অপব্যবহার করেছেন।
আর দ্রুপদনন্দিনী ?
যাজ্ঞসেনী পাণ্ডবদের কামুকতা, ব্যক্তিত্বহীনতা, নীচতার শিকার।
পাণ্ডবরা কামুক, নীচ মনের, আর ব্যক্তিত্বহীন ?
অল্প করে বললে ওই রকম।
মানে আরও গাল দেওয়া যায় ?
একদম।
কিন্তু কেন?
প্রথম কথা , বড় ভাই জানে সেজ ভাই তীর ধনুক -এর বিদ্যায় যাজ্ঞসেনীকে অর্জন করেছে। মায়ের না জেনে বলে ফেলা কথাকে আশ্রয় করে ভাইয়ের বাগদত্তার শরীর ছুঁতে বড়জনের বাধল না। এই হলেন ধর্মপুত্র। অর্জুন বড়দাদার অন্যায়ের প্রতিকার করলেন না। দ্রুপদনন্দিনীকে বিয়ের পরেও তার তালিকায় সুভদ্রা, চিত্রাঙ্গদা, উলুপী … কিন্তু কেন? মহাভারতকার তৃতীয় পাণ্ডবকে জোর শাস্তি দিয়েছেন। অজ্ঞাতবাসে কিরীটি ফাল্গুনিকে বৃহন্নলা বানিয়েছেন। বৃহন্নলা আর কাকে বলা যায় ?
যুধিষ্ঠির একটি কুচুটে লোক। পায়ে হেঁটে স্বর্গ যাত্রার সময় দ্রুপদনন্দিনী পড়ে গেলে যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন যাজ্ঞসেনী তোমায় বেশি ভালবাসত। তাই তার পতন। ভাবুন তো ধর্মপুত্রের রুচি কেমন? ভাল পরিবার থেকে এক রকম বলে একটা গুণী সুন্দরী ব্যক্তিত্ববতী মেয়েকে নিয়ে এসে কত দূর হেলাফেলা? এর পরেও পাণ্ডবরা কামুক, নীচ মনের, আর ব্যক্তিত্বহীন বললে অন্যায় বলা হবে?
১৫
রামচন্দ্র সম্পর্কেও আপনি নিশ্চয় শ্রদ্ধাশীল নন ?
রামায়ণ একটা গল্প।
গল্প? মহাকাব্য নয়?
হ্যাঁ গল্পটা অনেকে মিলে অনেক দিন ধরে লিখেছে।
তাহলে বাল্মীকি নামে কাউকে আপনি স্বীকার করেন না ?
বাল্মীকি নামে একটা কবি গোষ্ঠী থেকে থাকতে পারে। একা একটা লোক পুরো গপ্পোটা বানিয়েছে এমন না হওয়াই খুব সম্ভব।
তাহলে রাম ভগবানের অবতার নন, আর বাল্মীকিও আদিকবি নন – শ্যামলীদেবী এই তো আপনার বক্তব্য ?
রামের গল্পটা লোককে খুব টানে। কিন্তু রাম নামে লোকটাকে ভগবান বানালে বাল্মীকি গোষ্ঠীর লেখকদের বুদ্ধি বিবেচনার ওপর অবিচার করা হয়। শ্যামলী মৃদু স্বরে বলে ওঠে।
ঘরে তখন পিন পতনের শব্দ শোনা যাবে মনে হয়।
১৬
সীতা সম্পর্কে আপনিই বলেছেন তার জন্মের পিছনে কন্যাসন্তানের বর্জনের ইঙ্গিত আছে।
হ্যাঁ , যুক্তি দিয়ে দেখলে অমন মনে হয়। রাজা জনক যজ্ঞভূমি কর্ষণ করতে গিয়ে একটি কন্যাশিশু পান। রাজা দ্রুপদ যজ্ঞের আগুন থেকে পান পরমাসুন্দরী যাজ্ঞসেনীকে। মহর্ষি কণ্ব কুড়িয়ে পান শকুন্তলা কে। পাখিরা তাকে শীত থেকে রক্ষা করছিল। কৃষ্ণকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে কংসের রোষ দৃষ্টির সামনে যাকে আনলেন বসুদেব , সে একটি কন্যাশিশু। কন্যাশিশুর প্রতি ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটা লক্ষ্য করবেন। পরম করুণাময় ভারতীয় কন্যাশিশুদের জন্যে ইহজীবনে বিশেষ অধিকার নিশ্চিত করেন নি।
আপনার বক্তব্য খুব তীক্ষ্ণ।
সত্য যে কঠিন। মৃদুতর স্বরে বলে শ্যামলী।
১৭
রাম সীতার দাম্পত্যটা আপনি কি চোখে দেখেন?
আদর্শ ভারতীয় দাম্পত্য।
আদর্শ দাম্পত্য ?
হ্যাঁ , তার ভারতীয় ফরমুলা।
কি রকম?
বেশির ভাগ ভারতীয় পুরুষ নিজের স্ত্রী কে ক্ষমতা ফলাবার একটা জমি বলে মনে করে।
কি রকম?
শুনুন, মায়ের থাকে একটি ডিম্বাণু।
হ্যাঁ, সে আমরা জানি।
সে অপেক্ষা করে থাকে একটি শুক্রাণু এসে তাকে বিদ্ধ করুক। নইলে সে আঠাশ টা দিন আকুল আগ্রহে কাটিয়ে অভিমানে নিজেকে শেষ করে দেবে। বিপরীতে পিতার থাকে কোটি কোটি শুক্রাণু। একটি সমর্থ পুরুষের একবারের বীর্যক্ষরণে সেই রকম কোটি কোটি শুক্রাণু নারীর যোনি পথে দৌড় লাগায়; একটিই অভিন্ন লক্ষ্যে, কে বিদ্ধ করবে ডিম্বাণুকে। যদি কোনও একটা বিদ্ধ করতে পারল – তবে ডিম্বাণুর অপেক্ষা সফল। মাতৃ জঠরে নবীন ভ্রুণের অভিষেক পর্ব হবে।
সে তো বিজ্ঞানের কথা।
কথাটা সত্যি বলে মানেন কি না?
তা না মেনে উপায় কি?
তাহলে এক দিকে একা একটা ডিম্বাণু আকুল হয়ে অপেক্ষায় আর অন্য দিকে হাজার কোটি শুক্রাণু রেসের ঘোড়া -র মতো দৌড়বাজ। যে রেসে জিতব, সে জয়ী। জো জিতা ওহি সিকন্দর ! একজনের তপস্যা, অন্যজনের দৌড়। তার পর মাতৃজঠরে দশমাস দশদিনের পরিচর্যা, জন্মকালীন জননীযন্ত্রণা, তারপর স্তন্যদায়িনী।
আপনি কবিতার মতো করে কথা বলেন।
মুখ তুলে তাকায় শ্যামলী। কবিরা মিথ্যে বলে না।
তাহলে আদর্শ ভারতীয় দাম্পত্য কি রকম দাঁড়ালো ?
ওই, তুমি সকল কষ্ট করো, সন্তানের পরিচয় কিন্তু পিতার নামে। বাবা ওয়াই ক্রোমোজোম দিলে পুত্রজন্ম, আর এক্স ক্রোমোজোম দিলে কন্যাশিশু। মায়ের কিন্তু একটি মাত্র যৌন ক্রোমোজোম। সেটি হল এক্স। সেটা ছাড়া মায়ের আর কিছু নেই। বাবার অপশন আছে। সে এক্স দিতে পারে , ওয়াই দিতে পারে। এক্স দিলে কন্যাশিশু , ওয়াই দিলে পুত্রসন্তান। কিন্তু রকেট তোলার পরেও ভারতীয় পুরুষের হাতে ভারতীয় নারী মার খায় কন্যাজন্ম দেবার অপরাধে।
আপনি বড় তীব্র করে বলেন।
শ্যামলী বড় বড় চোখ মেলে তাকায়। কিছু না বলেই অনেক বলে ফেলে।
১৮
আপনি কি নারীবাদী ?
আমি নারী, আর তার চেয়েও বড়ো কথা আমি একজন মানুষ।
রামচন্দ্রকে তাহলে আপনি আদর্শ মানুষ বলে মনে করেন না, তাইতো ?
একটা গল্প, তাও অনেক লোকের হাতে অনেকদিন অনেক ভাবে তৈরি। তার একটা মানুষ রাম চন্দ্র। তাকে নরচন্দ্রমা মনে করব কেন?
বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু রামচন্দ্রকে নর রূপে ভগবান মনে করেন। আমাদের কৃত্তিবাস কবির কথায় সীতা বলছেন – সকল সম্পদ মম দূর্বাদল শ্যাম।
হ্যাঁ শ্রীরাম পাঁচালিতে কৃত্তিবাস ওকথা লিখেছেন।
তা হলে?
কিন্তু সীতার মুখ দিয়ে কবি ওকথা যখন বলেছেন, তখনও সীতার জীবনে দুর্বিপাকগুলো নেমে আসে নি। রামের নারীবিরোধী নারীবিদ্বেষী চেহারাটা সীতা দেখে ওঠেন নি। সীতা এই নারীবিরোধী নারীবিদ্বেষী রামকে পরে পরে চিনবেন।
নরচন্দ্রমা রাম নারীবিরোধী নারীবিদ্বেষী ?
গল্পের রাম। রাম কোনও ঐতিহাসিক ব্যক্তি – এটা আমি মনে করছি না।
সাধারণ ভারতীয় কিন্তু রামকে আদর্শ পুরুষ মনে করেন বহুদিন ধরে। আর আপনি বলছেন তিনি নারীবিরোধী নারীবিদ্বেষী ?
তাহলে শুনুন আমি বলছি গল্পের রাম একজন মানববিদ্বেষী !
সকলে আঁতকে উঠে বলল সে কি বলছেন?
১৯
রামচন্দ্রকে মানববিদ্বেষী মনে করার কারণটা কী ?
কারণটা নয়, কারণগুলো। এক নয়, একাধিক ! প্রথমতঃ , রাবণের সম্পর্কিত বোন শূর্পণখা রামকে প্রপোজ করলে রাম তার বাবা দশরথের বহুবিবাহের ঐতিহ্য মেনে সে মেয়েকে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু একটি মেয়ের নাক কান কাটার ব্যবস্থা করা বীরপুরুষের কাজ নয়। আজকালকার অ্যাসিড আক্রমণের কথা মনে এসে যাচ্ছে। একটি মেয়ের নাক কান কেটে দিলে তার নারী জীবন সাংঘাতিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যায় না কি? বেঁচে থাকার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। নাক কান কাটা গেলে একটি যুবতী মেয়ে বেঁচে থাকতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারে।
আর?
সীতা একটু জেদী ছিল। অশোকবনে হনুমান তাকে পিঠে চড়ে রামের কাছে পৌঁছে দিতে চাইলে সীতা তাতে রাজি হয় নি। সীতা চেয়েছিল রাম নিজে এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাক।
তাতে কি হল?
তাতে রিস্ক ছিল। কেননা সাগরপার হবার ব্যাপার, যুদ্ধের প্রসঙ্গ, লোকক্ষয়। সীতা তার স্বামীর বাহুর উপর মাথা রেখে শুত, আর জানতো রাম বাহুতে বল যথেষ্ট।
কিন্তু তাতে কি হল?
কিন্তু স্বামী হিসেবে রামের মনের মধ্যে যে সীতার জন্যে অগাধ বিশ্বাস নেই – এটা সীতা আন্দাজ করতে পারে নি। সীতার মতো মেয়ে যে ভাল না বেসে শরীর দেবে না – এ বোধটা , স্ত্রী -র প্রতি এই আস্থাটা রামের গড়ে ওঠে নি। সীতা বার বার অগ্নি পরীক্ষা দিতে দিতে জীবনের প্রতি মমতা হারিয়ে ফেলেছিল। মি লর্ড, স্ত্রীকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেবার দায়ে আমি রামচন্দ্রকে অভিযুক্ত করছি।
সবাই বলে উঠলো – তার পর?
২০
রামচন্দ্রকে মানববিদ্বেষী মনে করার আর কী কী কারণ আছে ?
বালী সুগ্রীবের ঝগড়ায় আড়াল থেকে তীর ছোঁড়ার ব্যাপারটা ভাবুন।
বন্ধুকে সাপোর্ট করা অন্যায়?
সাপোর্ট করা এক জিনিস , আর সাবোতাজ আর এক জিনিস। দুই ভাইয়ে লড়াই। লড়াই কিষ্কিন্ধ্যা রাজ্যের পরিচালনা নিয়ে। ওটা দুই ভাইয়ের পৈতৃক রাজ্য হলে সেটা তারা কেমনভাবে পরিচালনা করবে সেটা তাদের পারিবারিক সমস্যা। বানরকুল সেখানে ফ্রী অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশনের দাবী করতে পারে। এমন কি প্লেবিসাইট বা রেফারেন্ডামের, মানে গণভোটের দাবীও তুলতে পারে। প্রজাদের সে অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু আড়াল থেকে একজনকে তীর ছুঁড়ে মেরে দেওয়া – ছি ছি, যে কোনও রকম পলিটিকাল আইডিয়ার বাইরে। কাপুরুষ এর মতো কাজ।
২১
রামচন্দ্রকে মানববিদ্বেষী মনে করার আর কোনও কারণ বলবেন?
গর্ভবতী স্ত্রীকে দূর করে দেওয়ার ঘটনাটা দেখুন।
সে তো প্রজারা চেয়েছিল বলে …।
ছেলের হাতের মোয়া আর কি! প্রজারা চেয়েছিল ? রাজা মশাই , তুমি কি চেয়েছিলে?
যীশুর বেলাও পিলেট অমন করেছিল। পাঁচ পাব্লিক চাইল – দ্যাখ রাজা, ছাড়তে চাইলে দস্যু বারাব্বাস কে ছেড়ে দাও – কিন্তু যীশু কবভি নেহি। হয়ে গেল কাজির বিচার। দাও যীশুকে ক্রুশে। রামচন্দ্র রাজা। প্রজারঞ্জন তার কর্তব্য। কিসে প্রজার ভাল হবে সেটা রাজাকে দেখতে হয়। কিন্তু শত অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, একটাও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায় , এই হল বিচার। তা ছাড়া ব্যালান্স অফ কনভিনিয়েন্স অ্যান্ড ইনকনভিনিয়েন্স তো আছেই। একজনের কতখানি সুবিধা করে দেবার জন্যে আর একজনের কতখানি অসুবিধা – সে তৌল তো করতে হবে? সীতাকে শাস্তি দেবার সময়ে এই ব্যালান্স অফ কনভিনিয়েন্স অ্যান্ড ইনকনভিনিয়েন্স ব্যাপারটা রাজার মাথায় ছিল? এই রাজা কি নিরপেক্ষ রাজা? না কি, এই রাজা প্রজাকে তেল দিয়ে নিজের সিংহাসন অটুট রাখতে পারলে বেঁচে যায়?