• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৯০)

পর্ব – ৯০

৮৯

ফেরার পথে গাড়িতে গা এলিয়ে দিয়ে অনসূয়া বললেন, শ‍্যামলী জানিস্, এভাবে একটা দুটো কাপড় দিয়ে ওদের অভাব মিটবে না আমি জানি।
শ‍্যামলী চুপ করে বসে শোনে।
অনসূয়া বললেন, কিন্তু আমি কি করব বল্, মানুষের অভাব মেটাতে গেলে যা করতে হয়, তা আমার সাধ‍্যের বাইরে।
গাড়ি ছুটে চলেছে। রাস্তায় রাস্তায় এক একটা জায়গায় পুজো। মাইকে হিন্দি গান বাজছে। বলিউডের জনপ্রিয় ফিল্মের গান।   এই গানগুলোর মধ‍্যে কয়েকটা গান শুনতে শুনতে কান পচে গিয়েছে। আবার কয়েকটা গান বেশ ভাল। সেগুলো পুজো মণ্ডপে খুব বেশি বাজে না। তবে শুনলে ভালো লাগে। গাড়ি চলতে চলতে এক একটা গান কানে আসছে। আবার দূরে চলে যেতে যেতে সে গান মৃদু হয়ে গিয়ে অন‍্য একটা গান কানের দখল নিচ্ছে।
বেশিরভাগ মণ্ডপে যে গান শোনা যাচ্ছে, তার লিপ অমিতাভ বচ্চনের। এই ১৯৮৪ সালের পদ্মশ্রী প্রাপকের তালিকায় তিনি।
অনসূয়া চ‍্যাটার্জি বললেন, এবারে ছাব্বিশে জানুয়ারি অমিতাভ বচ্চন পদ্মশ্রী পেয়েছেন জানিস তো। শ‍্যামলী ভাবল, কি আশ্চর্য, সেও তো ঠিক এই কথাটাই ভাবছিল।
অনসূয়া বললেন শ‍্যামলী, বলতে পারিস, অমিতাভ বচ্চনের আসল নাম কি?
শ‍্যামলী বলল, না তো, উত্তম কুমারের আসল নাম জানি। অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়। আর সুচিত্রা সেন আসলে রমা সেন। কিন্তু অমিতাভ বচ্চনের নামটা আসল নয়?
অনসূয়া বললেন, না, অমিতাভ বচ্চনের বাবা কবি হরিবংশ রাই  প্রথমে ওর নাম রেখেছিলেন ইনকিলাব শ্রীবাস্তব।
পরে ছেলের নাম বদল করে  রাখেন অমিতাভ।
শ‍্যামলী বলে, তাই না কি!
অনসূয়া বলেন, ইনকিলাব নামের মানেটা তো পশ্চিমবঙ্গে কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না।
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ, ইনকিলাব মানে বিপ্লব।
অনসূয়া বললেন, এই রকম অক্টোবর মাসেই একটা বিপ্লবের জন্ম। দুনিয়া কাঁপানো দশদিন। আগে তো অক্টোবর বিপ্লব বলত। তারপর ক‍্যালেণ্ডার সংশোধন করে ওটার নাম হল নভেম্বর বিপ্লব।
শ‍্যামলী শোনে।
অনসূয়া বলে চলেন, জন রীডের লেখা সাড়া জাগানো ব‌ই দুনিয়া কাঁপানো দশদিন। সাত থেকে সতেরো, নভেম্বর মাসের এই দশদিনে রাশিয়া উথাল পাথাল।
শ‍্যামলী চুপ করে মন দিয়ে শোনে।
অনসূয়া বলেন, অমিতাভের জন্মের সালটা ১৯৪২।  ভারতের ক্ষেত্রে সেও একটা বিপ্লবের বছর।
গাড়ি চালাতে চালাতে গোবিন্দ ফিরে তাকায়। বলে, ওটা আমার‌ও জন্মসাল। আজ থেকে ঊনিশ বছর আগে আমি শ‍্যামলীদের বাড়ি এসেছিলাম। তখন ও গুটগুট করে হাঁটে।
অনসূয়া বললেন, অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে মৃণাল সেনের কি সম্পর্ক জানিস ?
শ‍্যামলী বলে, না তো!
অনসূয়া বলেন সিনেমা ইণ্ডাস্ট্রিতে অমিতাভ সেই প্রথম। না স্ক্রিনে নয়, মৃণাল সেনের ভুবন সোম ফিল্মে বচ্চন ভয়েস ন‍্যারেটার এর ভূমিকায়। ১৯৭১ এ আনন্দ। ডাক্তারের ভূমিকায় বচ্চন। অপোজিটে তখন নামকরা নায়ক রাজেশ খান্না।
শ‍্যামলী মন দিয়ে শোনে।
অনসূয়া বলেন, ত্রিশ বছর বয়সে অমিতাভ আনন্দ‌এ অভিনয় করে  সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত হলেন।
আচ্ছা শ‍্যামলী, বল্ তো, আনন্দ ফিল্মে বচ্চনের অভিনয় করা চরিত্রটার নাম কি?
চট্ করে গোবিন্দ বলে, বাবুমশাই।
অনসূয়া তাকে বলেন, গোবিন্দ তুমি মন দিয়ে গাড়ি চালাও।
তারপর বলেন, জানিস শ‍্যামলী ওই ক‍্যারেকটারটার নাম ছিল ডাক্তার ভাস্কর ব‍্যানার্জি। অমিতাভ এই রোলটা করে বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাক্টরের সম্মান পেয়েছিলেন। আর রাজেশ খান্নার  চরিত্রের নাম ছিল আনন্দ সায়গল। ফিল্মটার পরিচালক ছিলেন হৃষীকেশ মুখার্জি। আর মিউজিক ডিরেক্টর সলিল চৌধুরী। ফিল্মটার স্ক্রিপ্ট বা চিত্রনাট্য যিনি লিখলেন, তিনিও একজন অসাধারণ প্রতিভাবান লোক। গুলজার। একাত্তরের বারোই মার্চ ফিল্মটা রিলিজ করল। ওই বছরের ন‍্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেল আনন্দ। পরের বছর ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। অমিতাভ বচ্চন পেলেন বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাক্টর অ্যাওয়ার্ড। ত্রিশ বছর বয়সে প্রথম একটা হিট ফিল্ম করতে পারলেন অমিতাভ। এর আগে এক ডজন ফিল্ম ফ্লপ হয়েছে। এরপর বাহাত্তর সাল। মার্চ মাসের তিন তারিখে রিলিজ হল বম্বে টু গোয়া। ফিল্ম পরিচালনায় মেহমুদ। সঙ্গীত পরিচালনা করলেন রাহুল দেববর্মণ। এই ফিল্মে অভিনয় করেছেন অরুণা ইরানি, শত্রুঘ্ন সিনহা। এটাও হিট হল। অমিতাভ বচ্চন বম্বে ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির বাঘা বাঘা লোকদের নজরে এসে গেলেন।
পরের বছর ভারতীয় মেইনস্ট্রিম সিনেমায় একটা বিরাট বাঁকবদল করে দিলেন পরিচালক প্রকাশ মেহরা। তিয়াত্তরের মে মাসের এগারো তারিখে রিলিজ হল জঞ্জীর। স্টোরিটা ছিল সালিম খানের। জাভেদ আখতার অনেটাই সহযোগিতা করেছিলেন। মিউজিক করেছিলেন কল‍্যাণজি আনন্দজি। এই ফিল্মে বচ্চন পুলিশ ইন্সপেক্টর বিজয় খান্না। একটা ব্লকবাস্টার ফিল্ম হিসেবে নিজেকে চেনালো জঞ্জীর। বলিউড ফিল্মে রোমান্টিক যুগ বদলে অ্যাকশন যুগ শুরু হল। বিজয় খান্না চরিত্রে বচ্চন এতদূর জনপ্রিয়তা পেলেন যে পরে অনেক ফিল্মে ওই বিজয় নামের চরিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন।
মাইকে গান বাজছিল, কহীঁ দূর যব দিন ঢল যায়ে/ সাঁঝ কি দুলহন বদন চুরায়ে / চুপকে সে আয়ে/ মেরে খয়ালোঁ কে আঙ্গন মে / কোই সপনোঁ কে দীপ জলায়ে, দীপ জলায়ে…
 অনসূয়া গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে দিলেন। শ‍্যামলীও।
অনসূয়া বললেন, এটা মুকেশের কণ্ঠ জানিস তো।
গাড়ি ছুটে চলে, গোবিন্দ বলে, আজ শ‍্যামলী আছে বলে , আপনি কি চমৎকার করে সিনেমার গল্প বলে যাচ্ছেন।
একটু পরেই লতা মঙ্গেশকরের গলায় গান ভেসে আসতে লাগল, না জিয়া লাগে না/ তেরে বিনা মেরা কহিঁ জিয়া লাগে না
শ‍্যামলী গেয়ে উঠল, না মন লাগে না, এ জীবনে যেন কিছু ভালো লাগে না
অনসূয়া বললেন, জানিস শ‍্যামলী, এই দুটো গান‌ই আনন্দ ফিল্মের গান।
ঊনিশ শো পঁচাত্তরের জানুয়ারিতে যশ চোপড়ার পরিচালনায় দিওয়ার রিলিজ হল। এতে বচ্চন অ্যাংরি ইয়াংম‍্যান। লোকজন চাইছীল অ্যান্টি এসট‍্যাবলিশমেন্ট  বিষয় নিয়ে ফিল্ম হোক। যশ চোপড়া দিওয়ার এ তাই দিলেন।
এরপর পঁচাত্তরের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রিলিজ হল শোলে। অমিতাভ আর ধর্মেন্দ্র।  জয় আর বীরু। দুই ক্রিমিনাল। সঞ্জীব কুমার ঠাকুর বলদেব সিং। হেমা মালিনী বাসন্তী। জয়া ভাদুড়ি রাধা। আর আমজাদ খান সাজলেন গব্বর সিং। রমেশ সিপ্পির পরিচালনা। গান লিখলেন আনন্দ বকশি। মিউজিক ডিরেক্টর রাহুল দেববর্মণ। মেহবুবা মেহবুবা গানটা আরডি সাহেব নিজে গাইলেন। গানটা সাড়া ফেলে দিল।
শোলে সিনেমাটা রিলিজের দিন স্বাধীন ভারতের বয়স ত্রিশ হয় নি। কিন্তু শোলে বিগত পঞ্চাশ বছর সময়কালের অন‍্যতম সেরা সিনেমার তকমা পেল। অনেকেই বলেন, জনপ্রিয়তম দশখানা ভারতীয় ফিল্মের নাম করতে হলে তার মধ্যে শোলে কে রাখতে হবে।
কিন্তু, তার অল্প কয়দিন আগেই পঁচাত্তরের বারোই জুন, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহন লাল সিনহা লোকসভায় ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনকে অবৈধ বলে রায় দিলেন। সারা দেশে গণতন্ত্রের টুঁটি টিপে ধরতে পঁচিশে জুন ঊনিশশো পঁচাত্তর থেকে সাতাত্তরের একুশে মার্চ অবধি জরুরি অবস্থা জারি করে রাখলেন ইন্দিরা গান্ধী। গণতন্ত্র প্রিয় মানুষ স্বৈরতন্ত্রী ইন্দিরাকে চিনে নিল।
বেয়াল্লিশ আর পঁচাত্তর, এই দুটো সালকে খেয়াল কর্ শ‍্যামলী। অনসূয়া বললেন, বেয়াল্লিশ সালে আপামর ভারতীয় চেয়েছিল ইংরেজ দূর হোক। একটা বিপ্লবের মতো পরিস্থিতি হচ্ছিল। তারপর সেটাকে ধামাচাপা দিতে একটা দাঙ্গা হাঙ্গামার পরিস্থিতি তৈরি করে এমনভাবে দেশভাগ হল, যে দুটো চিরশত্রু দেশ তৈরি হল। অথচ এরকম হবার কথা ছিল না। ধর্মান্ধতা গণ আন্দোলনকে বিপদে ফেলে। ভারতীয় সিনেমার মধ‍্যে পরিচালকরা মানুষের চাহিদার রূপরেখা খুঁজতে চাইছিলেন। একাত্তরের বরানগর কাশিপুর গণহত‍্যার মধ‍্য দিয়ে সিদ্ধার্থবাবু বাংলার যৌবনের কোমর ভেঙে দিয়েছিলেন। আর পঁচাত্তরের জরুরি অবস্থা জারি করে গোটা দেশকে ইন্দিরা বুঝিয়ে দিলেন হিটলারি কাকে বলে। মানুষ চেয়েছিল অ্যাকশন, চেয়েছিল লড়াই, অ্যান্টি এশট‍্যাবলিশমেন্ট। অমিতাভের মধ‍্যে দেশের মানুষ সেই প্রতিবাদী লোকটাকে খুঁজে পেল। অথচ দ‍্যাখ নিজেকে চেনাতে পারার আগে তার ফ্লপের সংখ্যা অনেক।  দ‍্যাখ শ‍্যামলী, ত্রিশ বছরে পৌঁছনোর দিনে বচ্চনকে সেভাবে কেউ চেনে না, তার পকেটে বারোটা ফ্লপ সিনেমা। আর তার পরের বারো বছরে সে বুঝিয়ে দিয়েছে ভারতের মেইনস্ট্রিম সিনেমার ইতিহাস লিখতে গেলে সে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ‍্যায়। এই চুরাশি সালে সে ভারত সরকারের কাছে পদ্মশ্রী। একটানা প‍রিশ্রমে বচ্চন এটা অর্জন করেছেন। শ‍্যামলী, হতাশার কাছে মাথা নোয়ানো যাবে না। শিরদাঁড়া টানটান করে লড়ে যেতে হবে।
শ‍্যামলী বলল, দিদি, আমি একটু কারখানায় ঢুকব।  অনসূয়া বললেন, গোবিন্দ ওকে ওর কারখানায় পৌঁছে দাও।
গাড়ি থেকে নেমে শ‍্যামলী কারখানায় ঢুকল। তখনও তার কানে সেই গানের রেশ, আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা, আর কতদিন আমি রবো দিশাহারা…

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।