দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৮৬)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ৮৬
১৮৫
রামনারায়ণ বললেন, আমি যা শুনে গেলাম, তা আমার ভাল লাগল না। তবে শ্যামলীর মাথার উপর আমার হাতটা রইল। ও বলুক আর না বলুক, ওর দিকে আমরা নজর রাখব।
শশাঙ্কবাবু বললেন, আমি তোমার কাজের ব্যাপারে নাক গলাই নি কিন্তু।
রামনারায়ণ বললেন, আমি একটু গলিয়ে দিলাম দাদা। দোষ করলে ওপরওলার কাছেই বোঝাপড়া করব।
বলে তিনি উঠে পড়লেন। বাড়ির কেউ তাঁকে আবার আসবেন বলল না। শ্যামলী সদরের দিকে এগিয়ে গেল তাঁকে গাড়িতে তুলে দিতে। গিয়েই সে দেখতে পেল অনসূয়া চ্যাটার্জি তাঁর গাড়ি থেকে নামছেন।
শ্যামলীর মনে পড়ল অনসূয়াদি’র ড্রাইভার গোবিন্দকাকা গতকাল নিজের চোখে তাকে দাদার হাতে ঘুঁষি খেতে দেখে গিয়েছে।
এখন রামনারায়ণ সিংহ চলে যাবার পর পরই অনসূয়াদিকে আসতে দেখে শ্যামলীর ভিতরটা কু গেয়ে উঠল। মুখে অবশ্য বলল আসুন আসুন।
অনসূয়া চ্যাটার্জিকে দেখতে পেয়ে রামনারায়ণ নিজেকে আড়াল করে চট করে গাড়িতে ঢুকে পড়ল। তার পরেই তার ইঙ্গিতে তার ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। অনসূয়া শ্যামলীকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই লোকটা তোদের বাড়ি এসেছিল কেন রে?
শ্যামলী অনসূয়া চ্যাটার্জির দিকে তাকালো। বলল, এই লোকটা আমাদের গ্যারাজে গাড়ি সারিয়ে পয়সা দিতে চাইত না। আজ ওর বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটার হেস্তনেস্ত করে এসেছি। আর গাড়ি সারানোর টাকা মার যাবার চান্স নেই।
অনসূয়া চ্যাটার্জি বললেন, লোকটা সুবিধার নয়। তুই বলেই বলছি, যার তার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যায় না।
শ্যামলী মনে মনে বলল, উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে। মুখে অবশ্য কিছু বলল না।
অনসূয়া শ্যামলীকে বললেন, কি রে, আমায় ঢুকতে বলবি না?
লজ্জা পেয়ে শ্যামলী বলল, হ্যাঁ দিদি, চলুন।
অনসূয়া বললেন, তোর বাবার সঙ্গে কথা বলব।
শ্যামলী বলল, অনসূয়াদি, বাবা যে একটু অসুস্থ!
অনসূয়া বললেন, শ্যামলী, ইংরেজি ভাষায় একটা কথা আছে, হিট দ্য আয়রণ, হোয়েন ইট ইজ় হট। আমি শুধু তোমার দিদি নই। আমার একটা সামাজিক পরিচয় আছে। সেই কাজটা করব বলেই আমি এসেছি।
কথাটা শুনে, কিংবা দামি শাড়ি পরা কে মহিলা এল দেখতে সবিতা পিসি বারান্দা থেকে উঁকি মারল।
শান্তুও নিজের ঘরের দরজা ফাঁক করে উঁকি দিয়ে দেখে নিল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে শশাঙ্ক পালের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বুকের কাছে হাতজোড় করে অনসূয়া নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ভিতরে আসতে পারি?
উদ্বিগ্ন মুখে শশাঙ্ক বললেন, হ্যাঁ আসুন। বসুন।
অনসূয়া বললেন, আমার বাবা আর কাকামণি আপনার কাস্টমার ছিলেন। গোবিন্দচন্দ্রকে আপনিই আমাদের দিয়েছেন। তখন অবশ্য আমি কলকাতায় থেকে কলেজে পড়তাম। আমায় আপনি সেভাবে দেখেন নি।
পুরোনো দিনের কথা উঠতে শশাঙ্কের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, আপনার বাবার কাছে আমি অনেকবার গিয়েছি। আপনার মাকেও দুই তিন বার দেখেছি। আপনার মুখে আপনার মায়ের ছাপ আছে।
অনসূয়া স্মিতমুখে বললেন, পুরোনো দিনের লোকজন সবাই তাই বলেন। বাবা মা দুজনেই অনেকদিন হল চলে গিয়েছেন। কাকামণিও। কাকিমা জ্যেঠিমারা ছেলেদের কাছে চলে গিয়েছেন। আমি এখানে একা।
সবিতা খুব খুঁটিয়ে অনসূয়াকে দেখছিল। সে হঠাৎ বলে বসল, তা বাছা, একাটি থাকা বড় কষ্ট। হ্যাঁ গো মেয়ে, তোমার বাপ মা তোমার কোনো বন্দোবস্ত করে যান নি!
অনসূয়া অবাক চোখে সবিতার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। শশাঙ্ক পাল সবিতাকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, চুপ কর্ সবিতা। ওঁর বাবা কাকা সকলে তাঁহা তাঁহা নমস্য ব্যক্তি। ওঁরা যা রেখে গেছেন, তাতে সাতপুরুষ বসে খাওয়া চলে।
সবিতা আর কথা বলার সুযোগ না পেয়ে মুখ গোমড়া করে থাকে।
অনসূয়া বললেন, আপনার মেয়ে আজ আমার ক্লায়েন্ট।
মাথা নিচু করে শ্যামলী বলল, আর লজ্জা দেবেন না, একটা পয়সা দিতে দেন না, তায় ক্লায়েন্ট।
শশাঙ্ক পাল বললেন, সে সব দিনে আমি ষাট সালের আগের কথা বলছি, তখন এখানে কেউ মোটর পার্টসের দোকান করে নি। তখন সবার ঘরে অ্যামবাসাডর। আর তার আগের গাড়ি যাদের ছিল তাদের ল্যাণ্ডমাস্টার, মরিস, বেবি অস্টিন, ফিয়েট। পার্টস আনতে আপনার বাবা কাকার গাড়ি করে কলকাতা চলে যেতাম। সারাদিন মার্কেটে ঘুরে জিনিস কিনে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে, সাহেবরা গাড়িতে বাড়ি ফেরার পথে আমাকে তুলে নিতেন। খোঁজ নিতেন খেয়েছি কি না। হাতে দিতেন খাবারের প্যাকেট। নাহুমের কেক কত খেয়েছি। নিউ মার্কেটে কত কি কিনতেন। আমিও ভাগ পেতাম। আপনার বাবা কাকার অনেক সাহায্য পেয়েছি কারবার করতে গিয়ে।
সবিতা অবাক হয়ে শোনে। বলে, দাদা, কলকাতার দোকানের খাবারের ভাগ তো আমায় কোনোদিন দাও নি!
শশাঙ্ক বলেন, তখন তুই কোথায়? তখনো আমার বিয়েই হয়নি। বোনেদের বিয়ে দেবার দায়িত্ব ছিল। বিয়ে করলাম দেরি করে। তনুশ্রী হবার পর এই বাড়ি ফাঁদলাম। শান্তু যখন হল, তখনও বাড়ির কাজ চলছে। দিনরাত ভূতের মতো খাটি। বাড়ি কমপ্লিট হলে তোর বৌদিকে এখানে আনলাম। গাঁ ছেড়ে আসতে ভয় পায়।
বাসন্তীবালা ঝঙ্কার দিয়ে উঠে বললেন, ভয় না আরো কিছু! সারাদিন খাটাখাটনি করে তুমি আসতে। গায়ে সাবান ডলে ডলেও তেলকালির গন্ধ উঠতে চাইত না। শুলে তো মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়তে। সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠেই ভোঁ দৌড়। একা মেয়েমানুষ কি করে যে সামলেছি!
শশাঙ্ক পাল যেন স্বপ্নের ঘোরে বলে চলেন, এবাড়িতে আসার পর পুজো দিলাম। তারপর এই ছোটো মেয়ে। বড়মেয়ে খুব ফুটফুটে হয়েই জন্মেছিল। তাই ওর নাম দিয়েছিলাম তনুশ্রী। বড়ছেলেও চমৎকার হয়েছিল। শান্তনু নাম রাখলাম। এই মেয়েটা যখন হল, তখন একটু ময়লা ময়লা রঙ ছিল। নাম দিলাম শ্যামলী।
শ্যামলী ফুট কাটল। বলল, ময়লার ম আর ল এইদুটোই আমার নামের মধ্যে আছে। আমার বাবা মায়ের আমি ছাড়া সবকটা ছেলে মেয়ের নামে তনু আছে। আমার শুধু ম আর ল।
শশাঙ্ক পাল ব্যস্ত হয়ে উঠে বললেন, ও কি কথা রে, তোর নামে যে রবিঠাকুরের গোটা একটা কবিতার বই আছে রে!
অনসূয়া শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “শ্যামলী” কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটা তোর মনে আছে?
মেয়ে বলল, হ্যাঁ। কবিতার নাম দ্বৈত। ১৯৩৬ সালে লেখা।
অনসূয়া বললেন, কবিতাটা বল্ না শুনি।
শ্যামলী বলতে শুরু করল,
সেদিন ছিলে তুমি আলো আঁধারের মাঝখানটিতে,
বিধাতার মানসলোকের
মর্ত্যসীমায় পা বাড়িয়ে
বিশ্বের রূপ আঙিনার নাছ দুয়ারে।
যেমন ভোর বেলার একটুখানি ইশারা,
শালবনের পাতার মধ্যে উসুখুসু,
শেষরাত্রের গায়ে-কাঁটা-দেওয়া
আলোর আড় চাহনি;
উষা যখন আপন-ভোলা —
যখন সে পায় নি আপন ডাক-নামটি পাখির ডাকে
পাহাড়ের চূড়ায়, মেঘের লিখনপত্রে।
অনসূয়া বললেন,
পৃথিবী তাকে সাজিয়ে তোলে
আপন সবুজ সোনার কাঁচলি দিয়ে
অনসূয়া বলে চলেন,
দিনে দিনে তোমাকে রাঙিয়েছি
আমার ভাবের রঙে
আমার প্রাণের হাওয়া
বইয়ে দিয়েছি তোমার চারিদিকে
কখনো ঝড়ের বেগে
কখনো মৃদু মন্দ দোলনে
শ্যামলী বলল,
একদিন আপন সহজ নিরালায় ছিলে তুমি অধরা
ছিলে তুমি একলা বিধাতার;
একের মধ্যে একঘরে।
অনসূয়া বললেন,
তোমার সৃষ্টি আজ তোমাতে আর আমাতে
তোমার বেদনায় আর আমার বেদনায়
আজ তুমি আপনাকে চিনেছ
আমার চেনা দিয়ে
শ্যামলী বলল,
আমার অবাক চোখ লাগিয়েছে সোনার কাঠির ছোঁওয়া,
জাগিয়েছে আনন্দরূপ
তোমার আপন চৈতন্যে।
দিদি, এই “দ্বৈত” কবিতাটা কতবার পড়েছি। আজ কিন্তু অন্যরকম মনে হচ্ছে।
অনসূয়া বললেন, বলে ফ্যালো কি মনে হচ্ছে।
শ্যামলী বলল, দিদি, এ কবিতাটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার আর আপনার জন্যেই লিখেছেন।