আমি এসে পড়ে অসুবিধা করলাম না তো?
দৃশ্যতই খুব অবাক রামনারায়ণ।
শ্যামলী বলল, আপনাকে দুর্গাপুজোর আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাতে এলাম। আরো বলল, বাড়িতে কিছু ফুল ফুটেছিল, এনেছি। আপনার ঠাকুরের কাছে রাখব?
রামনারায়ণ বললেন, আপনি, মানে তুমি শ্যামলী?
শ্যামলী বলল, হ্যাঁ। আমি শ্যামলী। আপনি তো আমাকে ভালো রকম চেনেন। তারপর বলল, ফুলগুলো ভাল লাগছে তাই না? আমি বসলাম কেমন? আপনি তো আমায় বসতে বলতেনই। আপনি স্টেটসম্যান পড়েন?
এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হন রামনারায়ণ। বলেন, না স্টেটসম্যান আজ আনিয়েছি। আপনার ছবি বেরিয়েছে স্টেটসম্যান কাগজে। আমি দেখছি আপনার ছবি। আর সেই সময় আপনি ঘরে ঢুকে আমার সামনে দাঁড়িয়েছেন। কী আশ্চর্য।
শ্যামলী হেসে বলল, আমি কিন্তু ছবি নই। মানুষ। আপনার জন্য ফুল আনলাম। থ্যাঙ্কিউ বললেন না তো?
রামনারায়ণ বললেন, থ্যাঙ্কিউ।
কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না এই মেয়েটা তাঁর দুর্গে ঢুকল কি করে! কেনই বা এল।
রামনারায়ণ বললেন, আপনার ছবি এই সাহেবি কাগজে বেরিয়েছে, আমার খুব ভাল লাগছে।
শ্যামলী বলল, থ্যাঙ্কিউ। আচ্ছা, মিস্টার সিংহ, আপনি বললেন, আপনি স্টেটসম্যান পড়েন না, তো আজকে হঠাৎ আনালেন কেন?
হাসলেন রামনারায়ণ। বললেন, কি জানেন, সকাল থেকে ফোন আসতে লাগল। স্টেটসম্যান কাগজটা দ্যাখো। শ্যামলীর ছবি বেরিয়েছে। কতকগুলো ফোনে এই খবর আসতে কাগজটা আনাতেই হল। আমি খুব খুশি হয়েছি।
কাগজটার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ না প্রকাশ করে শ্যামলী বলল, ওটা আমার ছবি নয়।
রামনারায়ণ হেসে উঠে বললেন, আপনি বললেই হবে? এই সেই ঝকঝকে চোখ, গালে চমৎকার টোল। বললেই হবে, এছবি আপনার নয়?
শ্যামলী বলল, সত্যি সত্যি ও ছবিটি আমার নয়।
রামনারায়ণ বললেন, আশ্চর্য তো। শহরশুদ্ধ লোক বলছে আপনার ছবি। আর আপনি বলছেন আপনার ছবি নয়? এই যে থুতনির কাছে এই যে মিষ্টি ভঙ্গিটা এটা চট করে সবার থাকে না। আর চোখে এত তেজ!
শ্যামলী মজাদার ভঙ্গিতে বলল, আশ্চর্য তো! রামসীতার ছবিতে হনুমানজীও থাকেন, তবু কেউ বলে না ওটা হনুমানজীর ছবি। সবাই বলে রামসীতার ছবি। এটা প্রফেসর সান্যালের ছবি। উনি আমাদের কলেজে এসেছিলেন।
রামনারায়ণ বললেন, এত নামকরা কাগজে আপনার ছবি বেরিয়েছে, অথচ আপনার একটুও অহঙ্কার নেই। আজকাল এ রকম দেখা যায় না।
মিস্টার সিংহ, কাগজে ছবি বেরোনো জিনিসটা বিশেষ কিছু নয়। আজ বাদে কাল ও জঞ্জাল। আসল কাজ হল ভাল হওয়া।
রামনারায়ণ বললেন, আজ আপনাকে যত দেখছি তত অবাক হচ্ছি।
শ্যামলী বলল, প্রথম দিনের থেকেও বেশি?
রামনারায়ণ বললেন, না না, প্রথম দিন খুব রাগ হয়েছিল। ডিএসপি সাহেব কে বলেছিলাম মেয়েটাকে তুলুন।
তার পর ভেবেছিলাম আপনার এগেনস্টে কেস দেব। তখন খোঁজ নিতে নিতে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এখন আমি আপনার ফ্যান।
শ্যামলী আশ্চর্য হয়ে বলল, আপনি আমার ফ্যান?
রামনারায়ণ বললেন, হুম। আমার পড়াশোনা হয়নি। অনেক কারণ ছিল। কিন্তু পড়াশোনা আমি ভালবাসি। আপনি এই জেলায় পড়াশুনায় ভাল রেজাল্ট করেছেন। আমার ছেলেমেয়েদের আমি আপনার কথা বলি।
শ্যামলী বলল, আপনি আমাকে লজ্জায় ফেললেন।
রামনারায়ণ বললেন, না না, তারপর শুনলাম আপনি খুব ভাল ডিবেট করেন। মেয়েছেলে এতভাল বলতে পারা, আমাদের এখানে একটাও নেই।
শ্যামলী দেয়ালের দিকে তাকায়। সেখানে একটি ক্যালেণ্ডার। অন্নপূর্ণার কাছে ভিক্ষা করছেন শিব। নিচে মোটা বড় হরফে লেখা রামনারায়ণ সিংহ অ্যাণ্ড কোং।
রামনারায়ণ জিজ্ঞাসা করলেন, মিস পাল, ক্যালেণ্ডারটা ভাল হয়েছে?
শ্যামলী বলল, চমৎকার পছন্দ আপনার।
রামনারায়ণ বললেন, আপনি বলছেন চমৎকার? আমার খুব আনন্দ হল।
শ্যামলী বলল, কিন্তু মিস্টার সিংহ, এই ছবির মানে কি?
রামনারায়ণ অবাক হয়ে বললেন, মানে আবার কি? শিউজির ছবি। বাস!
শ্যামলী বলল, না, এটুকুতে হবে না। আপনি আর একটু বলুন।
রামনারায়ণ বললেন, ওই তো অন্নপূর্ণার কাছে শিব ভিক্ষা করতে এসেছেন।
শ্যামলী জানতে চাইল, কিন্তু কেন?
রামনারায়ণ বললেন, শিবের তো কিছু নেই। তাই ভিক্ষা করছে।
শ্যামলী বলল, অন্নপূর্ণা শিবের কে?
রামনারায়ণ একটু চিন্তান্বিত হয়ে বললেন, বউ।
শ্যামলী বলল, তো বউ যদি হয়, বর আবার তার কাছে ভিক্ষা করে?
রামনারায়ণ হেসে উঠলেন। বললেন, এত যদি জানতাম আপনার মতোই ডিবেটিং করতে পারতাম।
শ্যামলী বলল, শুনুন, আমাদের বাঙালি কবি লিখেছেন, “ওথায় ত্রিলোকনাথ বলদে চড়িয়া, ত্রিলোক ভ্রমেন অন্ন চাহিয়া চাহিয়া।”
রামনারায়ণ সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
শ্যামলী বলল, দেখুন, শিব ত্রিলোকনাথ। কিন্তু তিনি ভিক্ষা করছেন। করছেন অন্নপূর্ণার কাছে। যিনি শিবজায়া। কিন্তু ত্রিলোকের অধীশ্বর হয়ে শিব ভিক্ষা করেন কেন?
রামনারায়ণ বললেন, আপনি বলুন। আপনার কাছে শুনতে ভাল লাগছে।
বাঃ, ক্যালেণ্ডার করলেন আপনি, আর গল্প বলব আমি?
রামনারায়ণ বললেন, আমার কাছে খবর ছিল, আপনি নাস্তিক। ঠাকুর দেবতা মানেন না। কিন্তু আমি দেখছি আপনি বড় ভক্ত।
শ্যামলী বলল, শিব ওই রকম। ছলনা করে ভিখারি সেজেছেন। ধন দৌলত সোনাদানার ঊর্দ্ধে পবিত্রতা। শিব মানে পবিত্র।
রামনারায়ণ বললেন, বাঃ, খুব ভালো লাগল। এখন বলুন, আপনার জন্য কি করতে পারি।
শ্যামলী বলল, আপনার কাছে আমিও ভিক্ষা চাইতে এসেছি।
রামনারায়ণ হেসে উঠলেন। বললেন, মিস পাল, আপনি বলেন কি?
শ্যামলী বলল, মিস্টার সিংহ, লোকে মনস্কামনা পূরণ করতে দেবস্থানে হেঁটে হেঁটে যায় জানেন তো?
রামনারায়ণ অবাক হয়ে বললেন, তা যায়ই তো । দেবস্থানে হেঁটে না গেলে সে রকম ফল ফলে না।
শ্যামলী বলল, তাহলে আপনি বলছেন, কষ্ট করে হেঁটে হেঁটে গেলে ফল হয়?
রামনারায়ণ বললেন, আলবৎ হয়।
আমি আপনার এখানে হেঁটে হেঁটে এসেছি একটা মনস্কামনা নিয়ে। পূরণ করবেন তো?
রামনারায়ণ অবাক হয়ে বললেন, হেঁটে হেঁটে আসতে গেলেন কেন? আপনার বাড়িতে তো একটা গাড়ি আছে।
না , আমি মনস্কামনা নিয়ে হেঁটে হেঁটে এসেছি। এখন বলুন দেবেন কি না।
রামনারায়ণ বললেন, আপনি কি চাইছেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
শ্যামলী বলল, আমি আপনার বন্ধুত্ব চাইছি। পাব?
রামনারায়ণ একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, বন্ধুত্ব? তার মানে?
শ্যামলী বলল, বন্ধুত্ব মানে বন্ধুত্ব।
রামনারায়ণ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিয়ে বললেন, আমি আপনার থেকে বয়সে অনেকটা বড়। আর তাছাড়া আমি বিবাহিত। আমার ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে।
শ্যামলী বলল, আমি সোজা সরল নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব চাইছি। দিতে পারবেন না?
রামনারায়ণ বললেন, আমি রাজি।
তাহলে আপনি আমার বন্ধু হলেন?
শ্যামলীর চোখে চোখ রেখে রামনারায়ণ বললেন, হলাম।
শ্যামলী বলল, এবার বন্ধু হিসেবে অনুরোধ করছি আপনার পরিচিত লোকদের আমার কাছে গাড়ি সারাতে রেকমেন্ড করবেন।
রামনারায়ণ ঘনস্বরে বললেন, করব।
তারপর শ্যামলী বলল, আপনার রেফারেন্সে এখান থেকে কোনো গাড়ি কাজ করালে আমি একটা স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেব।
রামনারায়ণ বললেন, বেশ।
শ্যামলী বলল, এখান থেকে দুটো গাড়ি সারাতে গিয়েছিল। আমার লোকের দোষে পয়সা নেওয়া হয় নি। এই গাড়ির নম্বর।
রামনারায়ণ বললেন, ইশ ছি ছি, ভুল হয়ে গেছে। তারপর বেল বাজিয়ে টাকা আনতে বলল।
এবার আপনি একটু মিষ্টি মুখ করুন।
শ্যামলী হেসে সায় দিল।
রামনারায়ণ বললেন, আপনাকে গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসুক।
শ্যামলী বলল, না, তা হবে না।
রামনারায়ণ বললেন, কেন? আপত্তি কিসের?
শ্যামলী বলল, আপনি নিজে যদি ড্রাইভ করে পৌঁছে দিতে চান, আপত্তি করব না।
রামনারায়ণ শ্যামলীকে বাড়িতে পৌঁছে বলল, দাদাকে অমনি একটু দেখে যাই।
শশাঙ্ক পাল শ্যামলীর পিছনে রামনারায়ণকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।
ক্রমশ…