দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৫৮)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ৫৮
১৫৭
সুযোগ বুঝে অনুষ্ঠান কক্ষ থেকে সরে পড়েছিল শ্যামলী। তার কোনো ইচ্ছাই ছিল না ফলাফল জানবার। একেবারেই আগ্রহহীন নিরাসক্ত নির্লিপ্ত মন নিয়ে সে বক্তব্য রেখেছিল, এবং অভ্যাসের কারণেই নিজের আলোচনা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শেষ করতে পেরেছিল।
রাস্তায় নেমে সে চলল অ্যাডভোকেট অনসূয়া চ্যাটার্জির বাড়ি। কোর্টে পূজার ছুটি পড়ে গিয়েছে। আর বেশিরভাগ আইনজীবী, যাঁদের যথেষ্ট পরিমাণে আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে, তাঁরা এইসময় সপরিবারে ট্যুরে গিয়ে থাকেন। শ্যামলীর মনে হল, গত সন্ধ্যায় তার উচিত ছিল অনসূয়া দেবীর কাছে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়ে রাখা। আর তিনি ঠিক কোথায় থাকেন সেটা ভাল করে জেনে নেওয়া। কিন্তু, তার জামাইবাবুর জন্য সব কিছু গুবলেট হয়ে গিয়েছে। তারপর মনে হল, হেডমিস্ত্রির অন্যায় কাজের ব্যাপারে মাথা ঘামাতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়েছে। তারপর মনে হল শান্তু ওইরকম অশান্তি সৃষ্টি না করলে জামাইবাবু দৌড়ে আসত না। তারপর মনে হল, শ্রমজীবীদের মধ্যে দায়বদ্ধতার অভাবের জন্য এই অবাঞ্ছিত জটিলতা পাকিয়েছে।
অনসূয়া শহরের প্রধান একটি এলাকায় থাকেন। এখানে এই মফস্বল শহরের বর্ধিষ্ণু ও প্রতিপত্তিশালী লোকজন বসবাস করেন। সেখানে পৌঁছে দুচারটি বাড়িতে জিজ্ঞাসা করতেই অনসূয়া চ্যাটার্জির বাড়ির হদিশ মিলল।
ওঁর বাড়ির সদর দরজার মাথার উপরে সাদা মার্বেল পাথরের উপরে খোদাই করা ‘ওঁ তৎসৎ’। দরজার পাশে পিতলের ফলকে লেখা কয়েকজন পুরুষের নাম। তাঁদের একজন চিকিৎসক একজন ইঞ্জিনিয়ার ও দুজনের নামের পাশে আইনি পেশার পরিচিতি। কিন্তু অনসূয়ার নাম লেখা নেই। পিতলের ফলকটি যথেষ্ট মলিন। এটাই অনসূয়ার বাড়ি কি না নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে দুজন আইনজীবীর নাম যখন ফলকে লেখা আছে, তখন অ্যাডভোকেট অনসূয়ার হদিশ পেতে এখানে অসুবিধা হবে না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে বেল বাজাল। বেল বাজল না। কয়েকটি বার চেষ্টা করে শ্যামলী বুঝতে পারল কোনো কারণে বেলটি বিদ্যুৎ সংযোগ হতে বিচ্ছিন্ন করা আছে। দরজার কড়া নাড়বে ভাবল। কড়া বেশ ভারি। অনেকটা চেষ্টার পর উপরের ব্যালকনি থেকে এক মাঝবয়সিনী মহিলা নিচের দিকে তাকালেন। কাকে চাই জিজ্ঞাসা না করেই তিনি বললেন, “তিনি পড়তেছে। যাও বাছা, এই ভর দুকুরে কোনো সাহায্য হবে নি।”
শ্যামলী রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেল। তাকে কি কোনো অসহায় ভিখারির মতো দেখাচ্ছে? নিজের ব্যাগে একটা ছোট্ট আয়না তার থাকে। সেটা বের করে দেখবে? তারপর সে নিজেকে সামলে নিয়ে বোঝাল, অনসূয়ার দুঃস্থ মানুষকে সাহায্য করার অভ্যাস আছে। আর স্বচ্ছল পরিবারের আশ্রিত মানুষ বাইরের সাহায্যপ্রার্থীদের খুব একটা পছন্দ করে না। আজ ওই মহিলা হয়তো এমন দুপুরে অনেক মানুষকে ভাগিয়ে দিয়েছে। তাই ভাল করে না তাকিয়েই তাকে অমন করে বলে ফেলেছে।
শ্যামলী আবার কড়া নাড়ল। পরপর কয়েকবার। আবার উপরের ব্যালকনি থেকে সেই একই মহিলা বলল, “বলছিনি, দিদি এখন বিশ্রাম নিতেছে। এখন পয়সা কড়ি দুব নি।”
শ্যামলীর ডাক ছেড়ে কান্না পেল। আগেরবার তবু মহিলাটি সাহায্য কথাটা বলেছিল। এবারে একেবারে পয়সার কথা বলে দিল!
তবু সে ঠিক করল ফিরে যাবে না। তার কেমন মনে হচ্ছিল এটাই অ্যাডভোকেট অনসূয়ার বাড়ি, আর তিনি বাড়িতে আছেন। এই সুযোগ শ্যামলী কিছুতেই ছাড়বে না।
সে চিৎকার করে “দিদি, দিদি” বলে ডাকা শুরু করল। ভিতরে অনসূয়া তাঁর বাড়ির বয়স্কা কাজের মেয়েকে বললেন, কে বাইরে চেঁচাচ্ছে, একটু দ্যাখো না।
ঝংকার তুলে হাত পা নেড়ে কাজের মেয়ে বলল, দুবার তাড়িয়ে দিয়েছি। তবুও যায় নি। আমি আর পারব নি।
অনসূয়া আশ্চর্য হয়ে বললেন, দুবার চলে যেতে বলেছো? কেন বলো দেখি? ওই টেবিলের ওপর একগাদা খুচরো পয়সা ডাঁই করে রেখেছি, দ্যাখো নি?
তা দেখব না কেন । কিন্তু দিলে যে ফুরিয়ে যাবে একদিন।
অনসূয়া বললেন, যায় যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আছে একটাও মানুষ যেন এ বাড়ির দুয়োর হতে কেঁদে ফিরে না যায়। এই আমি তোমাকে শেষ কথা বলে দিলুম।
কাজের মেয়ে অনসূয়াকে চোখ পাকিয়ে বলল, দুকুরবেলা কত রকম অপদেবতা মানুষের ছদ্মবেশে ঘোরে তুমি জান? আমি দরজা খুলি, আর আমাকে টেনে নিয়ে যদি চলে যায়?
হায় কপাল! অপদেবতাই যদি হবে তো দরজাটা খুলে দেবার অপেক্ষা করবে কেন সে? লাফ দিয়ে বারান্দায় উঠেও তো আসতে পারে।
কাজের মেয়ে ভয়ার্ত চোখে বলল, ঠিক তো। দ্যাখো দিকি এই এলো চুলে আমি যে উদিকে গেছনু গো। যদি লাফ দিয়ে আসত? আর কোনো দিন যাবু নি। ভর দুক্ষুর বেলা, ভূতে মারে ঢেলা।
কাজের মেয়ের কুসংস্কারের ঘটাপটা দেখে বিরক্ত হয়ে রাগে গজগজ করতে করতে একটা একটাকার কয়েন নিয়ে বারান্দা থেকে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিয়েই অবাক হয়ে গেলেন অনসূয়া। “আরে, তুমি শ্যামলী না?”
রাস্তায় সে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় লোকে উপর থেকে পয়সা ছুঁড়ে ফেলল দেখে রাগে দুঃখে লজ্জায় কান্না পেয়ে গেল শ্যামলীর। “দিদি, আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?”
একছুটে নিচে নেমে এসে দরজা খুলে শ্যামলীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন অনসূয়া।