• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৩০)

পর্ব – ১৩০

শ‍্যামলী দেখতে পেল বাবাকে নিয়ে তার মা এসে পড়লেন। মা ঢুকলেন রমানাথের মায়ের ঘরে। ঢুকেই ডুকরে কেঁদে ফেললেন বাসন্তীবালা। দিদি, তোমাকে যে এভাবে দেখতে হবে স্বপ্নেও ভাবি নি।
রমানাথের মা বললেন, কি আর করবে বলো! সব আমার অদৃষ্ট। একটা মাস হয়ে গেল। এই দিদিরা আসা যাওয়া করছেন। তাই কোনোমতে চলছে। কত কি নিয়ম কানুন, শ্রাদ্ধের কত কি আয়োজন। ওঁরা না থাকলে অথৈ জলে পড়তাম। বাড়িতে তো কেউ আর নেই। ঝি চাকর দিয়ে এসব তো হয় না। বুঝদার পোড়খাওয়া লোক চাই। তুমি বলবে রমা তো আছে। ও আজকালকার ছেলে, বোঝেই বা কি আর জানেই বা কি? তবে ছেলে আমার সোনার টুকরো। মা যা বলবে, একপায়ে খাড়া।
শশাঙ্ক পাল শাদা বিছানার উপর নকুড় নন্দীর ছবির প্রতি প্রণাম জানালেন। রমানাথের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, বৌদি, দাদা তো সংসারটা ভাসিয়ে দিয়ে যান নি, এমন রাজচটক বাড়ি, গাড়ি, ছেলেও বিচক্ষণ, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে, একে বলে আলোয় আলোয় যাওয়া।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রমানাথের মা বললেন, বড্ডো শৌখিন মানুষ ছিলেন। ঘরে ঘরে পুরোনো বনেদি বাড়ির খাট, দেরাজ, টেবিল। ঠাকুর পো, তোমাদের বাড়িতে গিয়ে জাপানি টি পটে চা খেয়ে ওঁর এত ভাল লেগেছিল যে, আমায় সাথে করে নিয়ে গিয়ে কলকাতার হাতিবাগানে ভাল দোকানে পছন্দসই টি সেট, সরবত সেট, কফি সেট কিনে আনলেন। রোজ সকালে চা খাবার সময় বলতেন, এবার বৌমা এসে গেলে এইসব জিনিসের কদর বুঝবে। খুব বলতেন, আহা কি চমৎকার মেয়েটা। শুধু দেখতে দিয়ে তো কিছু এসে যায় না। বাবার কারবার কিভাবে ডাকাবুকো ছেলের মতো করে সামলাচ্ছে দ‍্যাখো। যেমন বলিয়ে ক‌ইয়ে, তেমনি চটপটে। ওই বাগানের ভিতরে একটা জায়গায় ব‍্যাডমিন্টনের কোর্ট করবেন বলতেন। বৌমা ব‍্যাডমিন্টন খেলবে। আমরা বুড়ো বুড়ি দেখব। শীতের দিন রবিবার সকালে বেরিয়ে পড়ব পিকনিক করতে।
এবার ছবির নকুড় নন্দীর দিকে তাকিয়ে রমানাথের মা বললেন, ওগো, দেখতে পাচ্ছ, পালবাবু আর বাসন্তী এসেছেন। শ‍্যামলী সব সময় তোমার ছেলের কাছে কাছে থাকছে।
ঘরে একটা আবেগের ঢেউ উঠল।
রমানাথের মা বলে চলেন, মানুষটা সব সময় বলত, বৌমা চা করে দেবে, দুপুরে তরমুজ নিংড়ে বরফ দিয়ে শরবত বানাবে, বেলের পানা করবে। আমি বলতাম, সে কলেজের ক্লাস করবে, না বুড়ো হাবড়ার ফাই ফরমাশ খাটবে? তখন বলতেন, মর্নিং কলেজ তো। দুপুরে গাড়ি পাঠিয়ে আনিয়ে নেব। বলতাম, সে লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে। সেই বিকেলের পর সেখান থেকে বেরোয়। বলতেন, বাড়িতে লাইব্রেরি বানিয়ে দেব। কি ব‌ই লাগবে মুখ ফুটে বলুক না। চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বললেন, নিজে গরিব বাপমায়ের ছেলে তো, লেখাপড়া করতে সুযোগ পাননি। তাই যারা পড়াশোনা করে তাদের খুব পছন্দ করতেন। কোনো শখটাই মিটল না।
এমন সময় একজন প্রবীণা এসে রমানাথের মাকে বললেন, ও বৌমা, চলো, ভুজ‍্যি দিতে হবে। কষ্ট করে গা তোলেন রমানাথের মা। বললেন, কেন আমাকে আবার টানাটানি করা। রমা দিলে হয় না?
প্রবীণারা সমস্বরে বললেন, তাই কখনো হয়? এ হল নিয়ম। তোমাকে করতে হয়। শ‍্যামলী চট্ করে শ্রাদ্ধস্থলে গিয়ে তার নির্দিষ্ট স্থানটিতে বসে পড়ল।
একসময় শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান শেষ হল। একজন প্রবীণা শ‍্যামলীকে ইঙ্গিত করলেন মূল পুরোহিত আর গীতাপাঠের পুরোহিতকে খাবার খেতে বলতে। পুরোহিতেরা একযোগে বললেন, না না, কি দেবে আমাদের বেঁধে ছেঁদে দাও। আমরা ছাঁদাবাঁধা বামুন কি না, বাড়ি গিয়ে বসে খাব। শ‍্যামলী বলল, দুজনের জন‍্য‌ই টিফিন কেরিয়ারে বাড়ির জন‍্য খাবার গুছিয়ে রেখেছি। কিন্তু আজ এখানে আপনাদের খেয়ে যেতেই হবে। মূল পুরোহিত রমানাথের দিকে চেয়ে বললেন, এই মেয়েটি কে? মুখটিতে ভারি লক্ষ্মীশ্রী মাখানো। সারাক্ষণ ধৈর্য ধরে তোমার কাছটিতে বসেছিল?
রমানাথ উত্তর দিতে ইতস্ততঃ করছেন দেখে শ‍্যামলী বলল, আমি ওঁর গুণগ্রাহী বন্ধু। যে পুরোহিত গীতা পাঠ করেছিলেন, তিনি বললেন, গার্লফ্রেন্ড? শ‍্যামলী বলল, না না, এমনি ফ্রেন্ড। ওয়েল উইশার। মূল পুরোহিত হেসে বললেন, তোমাকে দেখেই আমি  বুঝেছি। পতি সোহাগিনী হ‌ও মা। প্রবীণা শ‍্যামলী ও রমানাথকে ইঙ্গিত করলেন দুই পুরোহিতকে প্রণাম করতে। রমানাথ সঙ্গে সঙ্গে নত হয়ে প্রণাম করলেন। ধনুকের ছিলার মতো টান হয়ে শ‍্যামলী বলল, মৎকর্মকৃন্মৎপরমো মদ্ভক্তঃ সঙ্গবর্জিতঃ। নির্বৈরঃ সর্বভূতেষু যঃ স মামেতি পাণ্ডব। গীতার বিশ্বরূপদর্শনযোগ অধ‍্যায়ের শেষ শ্লোক।
দুই পুরোহিত আশ্চর্য হয়ে বললেন, গীতা তোমার মুখস্থ?
শ‍্যামলী বলল, না মুখস্থ ঠিক নয়, মা রোজ রোজ পড়েন তো, কৌতূহল হলে কখনো কখনো নেড়েচেড়ে দেখেছি।
গীতাপাঠ যিনি করেছেন, সেই পুরোহিত জানতে চাইলেন, তা হঠাৎ এই শ্লোকটা তুমি বললে কেন মা?
শ‍্যামলী বলল, এই শ্লোকে অর্জুনকে শ্রীভগবান বলছেন, যে ব‍্যক্তি আমার‌ই জন‍্য সমস্ত কর্ম করেন, আমার পরায়ণ হন, আমার ভক্ত হন, আসক্তিশূন‍্য হন, এবং সমস্ত প্রাণর প্রতি অশেষ প্রীতিভাবসম্পন্ন হন, সেই অনন্য ভক্তিযুক্ত মানুষ আমাকেই প্রাপ্ত হন।
মূল পুরোহিত বললেন, সে তো আমরা জানি, তুমি এই প্রসঙ্গে এটা বললে কেন?
শ‍্যামলী বলল, এটা বললাম এই কারণে যে, পতি সোহাগিনী হ‌ওয়া কোনো ভক্তিমান মানুষের লক্ষ্য হতে পারে না। গীতা মানলে ভক্তের লক্ষ্য কি হ‌ওয়া উচিত, তা শ্রীকৃষ্ণ এই শ্লোকে বলে দিয়েছেন।
মূল পুরোহিত বললেন, কি আশ্চর্য, মেয়েমানুষের কাছে স্বামীই ইষ্ট নয়?
শ‍্যামলী বলল, সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ। ময‍্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ। গীতা যখন বলছেন, যাঁর মন বুদ্ধি আমাতে অর্পিত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত, তাহলে একজন কেন অন‍্য আরেকটি মানুষের সোহাগ পাওয়ার জন্য লালায়িত হবে?
দুই পুরোহিত ভেবে পেলেন না আর কি বলবেন। মাথা নিচু করে বললেন, এই অল্প বয়সে এতখানি গীতা মুখস্থ করতে আর কাউকে দেখি নি। শ‍্যামলী বলল, ক্ষমা করবেন, আমি মুখস্থ করি নি, আমি শ্লোকগুলি অনুভব করার চেষ্টা করেছি। তাতে বুঝেছি, নিজের প্রবণতা অনুযায়ী কাউকে শত্রু না ভেবে কাজ করে যাওয়াই মনুষ্যত্ব। দুঃখের কথা, গীতার আদর বেশিরভাগ লোকজন করেই না। কিন্তু এবার চলুন, আপনাদের খেতে বসাই। হাতে শাদা তোয়ালে আর সাবান নিয়ে একটি বধূ কাছেই দাঁড়িয়েছিল। শ‍্যামলীর চোখের ইঙ্গিতে তাকে এগিয়ে আসতে বললে মূল পুরোহিত বললেন আবার সাবান কেন, এমনি হাত ধুলেই তো হয়! শ‍্যামলী বলল, না, ভাল করে হাত ধুতে সাবানটা দরকার। পুরোহিত বললেন, তোমাকে যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি।
ততক্ষণে বাসন্তীবালার কাছে খবর চলে গিয়েছে, শ‍্যামলী দুই বামুনকে খুব করে গীতার অর্থ শুনিয়ে দিয়েছে। তিনি নিজের মেয়েকে চেনেন। তাড়াতাড়ি ছুটে এসে শ‍্যামলীকে বললেন, তুই একটু ওদিকে যা, আমি ওঁদের দেখাশুনা করব।
গীতাপাঠ যিনি করছিলেন তিনি শ‍্যামলীকে বললেন, আর একটু থাকো মা, ভগবানের আশির্বাদে প্রায়ই শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে গীতা পড়ি। কিন্তু কেউ শোনে না মা। আমি পড়তে হয় পড়ে যাই। তারা জানে বামুনটা পড়ছে পড়ুক, আমরা যে যার মতো গল্পগাছা করি। আজ তুমি যেভাবে ভেতরের কথা টেনে টেনে খুলে দেখালে, আমার যেন একটু একটু চোখ খুলে গেল। তবে কিনা কলিতে অন্নগত প্রাণ। দুটি ভাতের যোগাড় কেমন করে করব, সারাক্ষণ ওই চিন্তা। উচ্চ চিন্তার সামর্থ্য কোথায়?
শ‍্যামলীর মনে পড়ল, রমানাথও উপবাস করে রয়েছেন। সে রমানাথকে বলল, এবার আপনি একটু চলুন, আপনাকে জল মিষ্টি দেবার স্পেশাল দায়িত্ব আমার।
গীতা যিনি পাঠ করেছেন, তিনি রমানাথকে বললেন, চিরকাল গল্পে শুনেছি, সিনেমায় দেখেছি, নায়ক নায়িকাকে সহজ সরল ভাবে বন্ধুর মতো মিশতে। বাস্তবে কোনো দিন দেখিনি। আজ মনে হচ্ছে আগের বয়সটা যদি ফিরে পেতাম! যাও বাবা, তুমি একটু কিছু মুখে দাও গে।
রমানাথ গেলেন মায়ের কাছে। মা তুমি আগে মুখে কিছু দাও। এমন সময় কাচের গ্লাসে গ্লুকোজ গুলে প্লেটে করে দুটো বিস্কুট নিয়ে ঢুকল শ‍্যামলী। রমানাথের মায়ের কাছটিতে বসে বলল, পুরোহিতরা খাচ্ছেন, এবার আপনি একটু মুখে দিন। রমানাথের মা বললেন, না শ‍্যামলী, আমার খোকাকে আগে খাওয়াও। আমি দেখি।
শ‍্যামলী বলল, উনি ওঁর ঘরে গিয়ে নিরিবিলিতে খাবেন এখন। আপনি শুরু করলে ওঁকে নিয়ে যাব। রমানাথের মা বললেন, ওকে এখানেই দাও না, খাক, আমি দেখি।
রমানাথ বলল, ব্রাহ্মণের খাট বিছানা সব প‍্যাক করে গাড়িতে তুলল কি না দেখি।
একটি মেয়ে ফুট কেটে বলল, রাঙাদা এখন নতুন মানুষের সঙ্গে খেতে বেশি আনন্দ পাবে।
শ‍্যামলী বলল, রমানাথ, আপনি না হয় আপনার মায়ের পাশে বসেই একটু খেয়ে নিন।
রমানাথের মা অবাক হয়ে শ‍্যামলীর মুখের দিকে তাকিয়ে র‌ইলেন। একজন প্রবীণা বললেন, হ‍্যাঁ রে শ‍্যামলী, অত বড় লোকটাকে তুই নাম ধরে ডাকছিস, তোর সাহস তো কম নয়?
শ‍্যামলী বলল, ওঁকে আমি প্রথম থেকেই নাম ধরে ডাকি। ওঁর মনে হয় আপত্তি নেই।
রমানাথের মা বললেন, সে তোমরা একান্তে কিভাবে ডাকো, সেটা পাঁচজনের সামনে না করলেই নয়?
রমানাথ বলল, মা, আমার নামটা তুমি দিয়েছ ডাকার জন‍্য। সিন্দুকে তুলে রাখার জন‍্য নয়।
তার কথা শুনে ঘরশুদ্ধ সকলে অবাক হয়ে গেল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।