দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১১৮)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১১৮
বুকের নিচে বালিশ রেখে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শ্যামলী প্রবালের চিঠি পড়ে যাচ্ছে। ইশ্, মানুষটা এত লিখেছেন, সময় মতো হাতে পড়লে একটা না একটা উত্তর অবশ্যই দিত। তবু লেখাগুলো যে শেষ পর্যন্ত তার হাতে এসে পৌঁছেছে, এটা ভেবেই শ্যামলীর ভালো লাগছিল।
প্রবালের প্রেমপত্র লেখার দিনগুলো মনে পড়ছিল শ্যামলীর। প্রতি চিঠিতে ছবি এঁকে পাঠাতেন তিনি। লেখার ভাষা এবং হস্তলিপিতে যথেষ্ট যত্ন নিতেন, তাই সে সব গুছিয়ে রেখে দিয়েছে শ্যামলী। কিন্তু এই আমস্টারডাম থেকে লেখা চিঠিতে মানুষটা নিজেকে অনেক বড়ো ক্যানভাসে বিকশিত করেছেন।
বাঙালি সমাজে ভদ্রলোকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অবশ্যই স্থিতু হতে চেষ্টা করে। ব্যবসা হোক, বা পেশা, কিংবা চাকরি, যার যা প্রবণতা, সেই অনুযায়ী জীবিকা খু়ঁজে নেবার পর বাঙালি ভদ্রলোকে একটি বিয়ে করে।
মেয়ের বাবাও পাত্রের আয়ের সুযোগ সুবিধা বিষয়ে সচেতন থাকেন। মেয়েরাও। শ্যামলীর মনে পড়ে, তার একটি জ্যাঠতুতো বোন সুরঞ্জনার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হতে না হতেই বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়ে যায়। তখন একদিন মা কাকিমাদের আয়োজনে মেয়ে মহলের ঘরোয়া আড্ডায় সুরঞ্জনা সবার সামনে জোরালোভাবে বলেছিল, বিয়ে করব তাকে, যার এইটি আছে। বলে সে ডানহাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর সাহায্যে এমন একটা ভঙ্গি দেখিয়ে ছিল, যার অর্থ অতি স্পষ্ট।
শ্যামলী ভাবে, তার নিজের বাবা মাও তার বিয়ে দেবে বলে, তাঁদের সুসময়ে একটার পর একটা গয়না, আর ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছিলেন। ব্যবসায়ী পরিবারে টাকা কারবারে খাটানো ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করার চাইতে অনেক বেশি লাভজনক। তবু, যাতে কোনো কারণেই মেয়ের বিয়ের জন্য রাখা টাকা নয়ছয় না হয়, তাই বাপ মায়ের তরফে ওই চেষ্টা।
সেইসব গয়না আর টাকা দিয়ে সে জোর করে বাবার কারবারের দেনা মিটিয়ে দিয়ে প্রাণে আরাম পেয়েছিল। শ্যামলীর মনে পড়ে মনুর কথা। মনু তার সমবয়সী পিসতুতো দিদি। মনুর দিদি রুনুর বিয়ের বছর পাঁচ পরে মনুর বিয়ের কথা ওঠে। মনু নিজের বাবা মাকে কটকট করে শুনিয়ে দিয়েছিল যে, দিদিকে বিয়েতে যা যা দিয়েছো, আমার বেলা যেন কিচ্ছু ভাগে কম না পড়ে। মনু পিসেমশায়কে এভাবে কথাটা বলেছে জেনে শিউরে উঠেছিল শ্যামলী। একটা মেয়ে তার বাবাকে এভাবেও বলতে পারে?
এদের চাইতে সে নিজে অনেক অন্যরকম। যেন অন্য নক্ষত্রের মানুষ সে। এদের সাথে কিছুতেই মিলমিশ হবে না তার। সে একেবারেই বেগানা একটা মানুষ। জীবনানন্দের “বোধ” কবিতা থেকে উঠে আসা একটা মানুষ। একটা একাকী মানুষ। প্রবাল সেনও তাঁর চিঠিতে একজন একাকী মানুষের কথা লিখেছেন। সেই মানুষটি আমস্টারডাম শহরের বুকে কিছু দিন বাস করেছিলেন। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ এর কথা বড়ো যত্নে, বড়ো আন্তরিকতায় লিখেছেন প্রবাল। নেদারল্যান্ডস এর মানুষ তিনি। ভ্যান গঘ সে শহরে কিছুদিন বসবাস করেছেন বলেই আমস্টারডাম শহর যেন ধন্য হয়ে গিয়েছে। ভ্যান গঘের নামে গোটা একটা মিউজিয়াম পর্যন্ত স্থাপনা করেছে শহরবাসী। আর সেখানে রেখেছে “দি পট্যাটো ইটার্স” আর “সানফ্লাওয়ার” এর অরিজিনাল ছবি। ১৮৮০ থেকে ১৮৯০, এই মাত্রই বছর দশেক সময়ে আঁকতে পেরেছেন গঘ। ১৮৯০তে জুলাই মাসের ঊনত্রিশ তারিখে সাঁইত্রিশ বয়সের ভ্যান গঘের জীবনাবসান । ছবি নিয়ে যারা কারবার করে, তাদের কাছে কাজ করতেন তরুণ ভ্যান গঘ। ছবি দেখে বুঝে কেনাকাটা করা, আর পয়সাওলা রসিক সমঝদার পেলে তাকে গছিয়ে দেওয়া ছবি ব্যবসায়ীদের কাজ। তাদের কাছে কাজ করতে করতে ভ্যান গঘের মনে হল, ছবি আঁকাই তাঁর জীবনের পরমা গতি।
ছবি আঁকতে চাইলেন নিজের মনে। কিন্তু কিছু তুলি টানাটানির পর গঘের মনে হল, ছবি আঁকার কায়দা কানুন নিয়ে একটু তালিম, একটু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়া দরকার। তবে যিনি আত্মার ভিতরে বিশ্বসেরা শিল্পীকে জাগিয়ে তুলছেন, তিনি স্কুলিংয়ের ধরাবাঁধা নিয়ম কানুন মানবেন কেন? প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গঘের গণ্ডগোল বেধে যেত। আবার নিজের মনের মতো করে আঁকতে ব্যস্ত হলেন। দশবছরের শিল্পিজীবনে একুশ শো শিল্পসৃষ্টি করেছেন গঘ। তার মধ্যে সাড়ে আটশোর বেশি অয়েল পেন্টিং।
ছবি আঁকাকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে চিনে নেবার আগে লণ্ডনের এক তরুণীকে ভালবেসেছিলেন গঘ। তখন মাত্র একুশ বছরের তাজা তরুণ। মেয়েটি গঘকে পাত্তা দেয় নি। বড়ো মর্মাহত হয়েছিলেন গঘ। নিজেকে ভীষণভাবে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। ক্রমে শুশ্রূষা খুঁজে নিয়েছেন প্রকৃতির নির্জন কোলে। এরপর প্রকৃতিই যেন গঘের প্রিয়তমা হয়ে ওঠেন। গঘ বলেন, তুমি যদি প্রকৃতিকে সত্যি সত্যিই ভালবাসতে পারো, তো তুমি যেখানে তাকাবে, সেখানেই অপরূপ সৌন্দর্য খুঁজে পাবে। এইটুকু পড়ে একবার জানালা দিয়ে না তাকিয়ে পারে না শ্যামলী। আনমনে বলে, বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর….শ্যামলী মনে মনে আউড়ে যায় … এমনই হিজল বট তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ… তার পর বেহুলার কথা মনে পড়ে শ্যামলীর। .. ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়…. বেহুলার মধ্যে ঝড়ে ডানাভাঙা খঞ্জনা পাখিকে দেখতে পারেন, দেখাতে পারেন জীবনানন্দ দাশ। তারপর চিঠির দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখে, গঘের আরেকটি বিখ্যাত কথা উল্লেখ করেছেন প্রবাল সেন, লিখেছেন, মানুষকে ভালবাসার চাইতে বড়ো মাপের কোনো শৈল্পিক অভিজ্ঞান হতেই পারে না। আর অসাধারণ বড়ো মাপের কাজ ঠিক কি করে হয়? গঘ বলেছেন, ধারাবাহিক ভাবে ছোটো ছোটো করে হলেও ভালো কাজ করে গেলে একদিন সব মিলিয়ে সেইখানে পৌঁছে যায়।
এমন সময় দরজায় জোরদার খটখট আওয়াজ শুনে খিল খোলে শ্যামলী। চা বিস্কুট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিসি। রাগ আর কান্না মেশানো গলায় বললেন, কি হয়েছে তোর বল্ তো? সবার ঘরে ঘরে কি আমি চা নিয়ে দৌড়ে বেড়াব? আমায় কি পেয়েছিস তোরা?
শ্যামলীর সামনে একটা মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যার কোনো স্মরণীয় অতীত নেই, আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ নেই। আর এই মাত্র প্রবালের কলমে সে যাঁকে চিনছে, একুশ বছর বয়সে প্রেমে মর্মান্তিক আঘাত পেয়ে তিনি সারাজীবনের জন্য শিল্পী হয়ে গেলেন। লাইব্রেরিতে এনসাইক্লোপিডিয়াতে গঘের আত্মপ্রতিকৃতি দেখেছে সে। চোখে ভেসে উঠছেন ভ্যান গঘ।
সবিতাপিসি বললেন, দাঁত পর্যন্ত মাজিস্ নি দেখছি। ভূতে পাওয়া মানুষের মতো চেহারা করেছিস তুই।
শ্যামলী মনে মনে বলল, হ্যাঁ, ভূতেই পেয়েছে আমায়। আমি মানুষের জীবনকে সত্যি সত্যিই ভালবেসে ফেলেছি। গঘের মতোই।