• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১১২)

পর্ব – ১১২

শুনশান রাস্তা। নিবু নিবু বাল্ব জ্বলছে লাইটপোস্টে। শ‍্যামলী নিজের সাথে নিজে কথা বলতে বলতে পথ হাঁটছে। অক্টোবরের শেষ দিনে সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এলে গা শিরশির করা শীত নামছে। এই ১৯৮৪ সালেরই জুন মাসের পাঁচ তারিখের কথা মনে পড়ে। পঞ্জাবের অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরকে শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন হরমন্দির সাহিব বলেন। শিখনেতা লঙ্গোয়ালের আমন্ত্রণে স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন জার্ণেল সিং ভিন্দ্রান‌ওয়ালে। ধর্মমন্দিরকে তিনি অস্ত্রাগার করে তুলেছিলেন।
শ‍্যামলীর মনে পড়ে ভিন্দ্রান‌ওয়ালে লোকটি তো কখনোই সুবিধার ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী খলিস্তান আন্দোলনের উদ্গাতা। ১৯৭৮ এর তেরোই এপ্রিল থেকে ভিন্দ্রান‌ওয়ালে এই খলিস্তান দাবি করে আসছিলেন। বিপক্ষে ছিলেন নিরঙ্কারী গোষ্ঠী। ১৯৮০ সালের ২৪ এপ্রিল নিরঙ্কারী নেতা গুরবচন সিং নিহত হল। তাঁকে খুনের ঘটনায় ভিন্দ্রান‌ওয়ালের দিকে অভিযোগের আঙুল ওঠে। এই রকম সময়েই গ্রেফতারি এড়াতে ভিন্দ্রান‌ওয়ালে স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় পেয়ে যান। ধর্মীয় অনুভূতিকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে ব‍্যবহার করার সেই শুরু। বিচ্ছিন্নতাবাদী খলিস্তান আন্দোলনকে কড়া সমালোচনা করতেন পঞ্জাব কেশরী সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক লালা জগৎ নারায়ণ। ১৯৮১ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে তিনি খুন হন। এবার ভিন্দ্রান‌ওয়ালে বললেন, এই খুনের জন‍্য আততায়ীর পুরস্কার প্রাপ‍্য।
এমনভাবে পুরস্কার ঘোষণা করায় খুব স্বভাবতই ভিন্দ্রান‌ওয়ালের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের সম্পাদককে খুনের অভিযোগ উঠেছে। এরপরই ২০ সেপ্টেম্বরে ভিন্দ্রান‌ওয়ালে আত্মসমর্পণ করেন। ঠিক একমাস পরে, ১৯৮১ সালের ২০ অক্টোবর তারিখে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে জোড়া খুনের দায়ে অভিযুক্ত ভিন্দ্রান‌ওয়ালেকে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়।
দ্রুতগতিতে ভিন্দ্রান‌ওয়ালের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রভাব বিস্তার লাভ করতে থাকে।  ১৯৮৩ সালের ২৩ এপ্রিল পঞ্জাব পুলিশের ডেপুটি ইনস্পেকটর জেনারেল এ এস অটোয়াল নিহত হন। ওই বছরই অক্টোবর মাসে ছয়জন হিন্দু তীর্থযাত্রী নিহত হন। কিন্তু ভিন্দ্রান‌ওয়ালের সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ঘাঁটি অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরকে উদ্ধার করতে ইন্দিরা গান্ধী অকারণ অবহেলা করতে থাকেন। লোকজন বলত, ভিন্দ্রান‌ওয়ালেকে তিনিই পপুলার হয়ে উঠতে সাহায্যকরেছিলেন।
ইন্দিরা ভেবে চলেছিলেন যে ধর্মস্থানকে সশস্ত্রবাহিনীর দ্বারা মুক্ত করতে গেলে শিখ ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়বে। ১৯৭৬ সালে ভারতীয় সংবিধানে যিনি ঘটা করে সেক‍্যুলার কথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি যে আসলে সেক‍্যুলারিজম বলতে নানাবিধ ধর্মীয় গোষ্ঠীর অসাধু কাজকর্মকে প্রশ্রয় দিতেন, তা কয়েকটি বছরেই বেপর্দা হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরাকে স্বর্ণমন্দিরে সেনা অভিযান করতেই হল। তাঁর সংকেতে ভারতের সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সিআরপি, বিএসএফ ও পঞ্জাব পুলিশ স্বর্ণমন্দিরে আত্মগোপন করে থাকা ভিন্দ্রান‌ওয়ালের বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণায়।
গুরু অর্জনদেব শহীদ দিবসে ভারতীয় বাহিনী স্বর্ণমন্দিরে আক্রমণ চালায়। ভিন্দ্রান‌ওয়ালে শিখদের মধ‍্যে ঠিক কোন্ জাতের আর কোন্ গাঁয়ের বাসিন্দা ছিলেন তা খোঁজ করে, ঠিক সেই জাতের ও সেই রকম এলাকার মানুষ মেজর জেনারেল কুলদীপ সিংহ ব্রারকে ধর্মস্থানে অভিযান চালানোর দায়িত্ব দেন ইন্দিরা। এই জাতপাতের হিসাব করতে তিনি বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি যুদ্ধ শুরু করার হুকুম দেন ১৯৮৪ সালের ১ জুন তারিখে। দোসরা জুন পঞ্জাবে প্রেসের কণ্ঠরোধ করা হল। রেল ও সড়কের পাশাপাশি আকাশপথ‌ও সিল করে দেওয়া হল।
জুনের তিন তারিখে যুদ্ধ শুরু। সাত তারিখে যুদ্ধ শেষ। ভারতীয় বাহিনীর চারজন দক্ষ অফিসার আর ঊন‌আশিজন জ‌ওয়ানের প্রাণের মূল‍্যে ভিন্দ্রান‌ওয়ালের কবলমুক্ত হল স্বর্ণমন্দির। কিন্তু গুরু অর্জন দেবের শহীদ দিবসেই এই কাণ্ডটি ঘটিয়ে শিখ জনতার কাছে চিরকালের মতো নিন্দনীয় মানুষ হয়ে রইলেন ইন্দিরা গান্ধী।
 কত শিখ সৈনিক ভারতীয় বাহিনীতে কাজ করতে অস্বীকার করল। কত পদস্থ আধিকারিক কাজে জবাব দিয়ে চলে গেলেন। ভাবতে ভাবতে হাঁটতে হাঁটতে শ‍্যামলী দেখল সে বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।