দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১১১)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১১১
গুরুদ্বার থেকে বেরোনোর সময় প্রবীণ শিখ ভদ্রলোক বললেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেও।
শ্যামলী হাঁ বাচক ঘাড় নাড়ল বটে, কিন্তু সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, সাঁইত্রিশ বছর বয়সী গণতন্ত্রের মজ্জায় কেন আজও এমন একটা সাংঘাতিক বিষফোড়া রয়ে গিয়েছে। এমনই তার অবস্থা, যে কোনো সময় গরল উদ্গীর্ণ করে দিতে পারে। বাঙালির ঘরে ঘরে সুভাষ চন্দ্রের প্রতি প্রীতির জোয়ার বহে যায়, আর তারপরেও বাঙালির সমাজে মেয়ের বিয়েতে বাপের ঘাড় মুচড়ে একগাদা টাকা পণ চাইতে পাত্রপক্ষ লজ্জা পায় না। যে ছেলে পণ নেবো না বলে, লোকজন সন্দেহ করে, সেই ছেলের কোনো গোলমাল আছে। বরযাত্রীর দল কন্যার বাড়িতে এসে খেতে বসে কেবলই মেয়ে পক্ষের আপ্যায়নের ত্রুটি খুঁজে চলে। সুভাষকে ভালবাসলে এমন করা যায়? বাঙালির প্রাণের সুভাষ জাপানের মাটিতে হিন্দু মুসলিম শিখ আর বাঙালি পঞ্জাবি মরাঠীর মেলবন্ধন করেছিলেন অথচ স্বাধীন দেশের বাঙালি মাঝে মাঝেই আর্তনাদ করে বলে, অবাঙালি লোকজন বাংলার সবকিছু গ্রাস করেছে। অথচ হিসাব নিলে দেখা যাবে ওকালতি জজিয়তি আর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কাজে বাঙালি বর্মা থেকে লাহোর অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতে এমন একটা বড় শহর খুঁজে পাওয়া কঠিন, যেখানে অন্ততপক্ষে একটা নেতাজি সুভাষ রোড নেই। এমন বড় শহর নেই যেখানে বিবেকানন্দ স্বামীর নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা সেবা সংঘ নেই। তাহলে বাঙালি অন্য প্রদেশের বাসিন্দাদের প্রতি এই ঘৃণা বুকে পোষে কি করে? ইন্দিরা গান্ধী নিহত এটা একটা খারাপ ব্যাপার নিশ্চয়ই, কংগ্রেসের গুণ্ডাবাহিনীর তরফে শিখগণহত্যাও অত্যন্ত খারাপ ব্যাপার। কিন্তু সভ্য ভদ্র মধ্যবিত্ত শান্তিপূর্ণ বাঙালি কি করে এই দাঙ্গার আবহে কলকাতার ধর্মতলায় ভীত সন্ত্রস্ত পঞ্জাবিদের ছেড়ে যাওয়া দোকান থেকে মালপত্র হাসি মুখে তুলে আনল? না, এক আধজন নয়, অনেকেই। আশ্চর্য! সহনাগরিকের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি পর্যন্ত নেই!
শহরের প্রধান মোড়ে গান্ধীজির একটি প্রতিমূর্তি। তার চারদিকে চারটি রাস্তা চলে গিয়েছে। গান্ধীজিকেও স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক ভাবে বিদ্বিষ্ট ব্যক্তির হাতে খুন হতে হয়েছে। নীরবে নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে গান্ধীজির প্রস্তর মূর্তি। চারদিক নিঝুম। সহসা কি কেউ আবার এসে গান্ধীজির মূর্তির বুকে গুলি চালিয়ে দেবে? গান্ধীজি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শেষ বাক্যটি বলবেন, হে রাম!