দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১০৬)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১০৬
সকাল হতে দেরি আছে। পুবের আকাশে হালকা গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। পাখিরা বাসায় চঞ্চল হয়ে উঠল। কী সরল জীবন ওদের। ভাবে শ্যামলী। পাখি তো ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে না। শুধু মাত্র ডিম পেড়ে শিশুর জন্ম দেবার জন্য বাসা বানায়। নইলে তার আলাদা করে বাসার প্রয়োজন নেই। সকাল হবার আগেই পাখি জেগে উঠে জীবিকা সংগ্রহ করে। পাখি বাপ পাখি মা খাবার এনে বাচ্চাদের খাওয়ায়। তারপর ডানা দিয়ে আগলে রাখে। শৈশবের পাঠ্যবই থেকে ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের গে নেক এর অনুবাদ চিত্রগ্রীবের ওড়ার শিক্ষা মনে পড়ে গেল তার।
তারপর ছোট্টবেলায় শেখা একটা কবিতা মনে পড়ে গেল শ্যামলীর। “ঘুমায় যখন বাসায় পাখি, মায়ের ডানা ঢাকে/ ঘুমায় যখন বিড়ালছানা, মায়ের কোলে থাকে/ দিন ফুরালে ঘুমটি নেমে আমার চোখে আসে/ ঘুমের ঘোরে তাকিয়ে দেখি মা রয়েছেন পাশে/ আছেন না কি আরেকটি মা, সকলের মা যিনি/ দিনে রাতে সবার পাশে জেগে থাকেন তিনি।”
মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে শ্যামলীর মনে পড়ল টুনটুনির গল্প। বাসা বানিয়ে ডিম পেড়েছিল টুনটুনি পাখি। একদিন ছোট্ট ছোট্ট ছানা বেরোলো ডিম ফুটে। নিচে রোজ ঘুরঘুর করত একটা বেড়ালনী। তার ছানা খাবার লোভ। বেড়ালনী তক্কে তক্কে থাকত, কখন মা পাখি একটু উড়ে যাবে, আর সে গাছ বেয়ে উঠে ছানা খাবে। টুনি জানত, তার পাহারা আলগা করা চলবে না। তখন ঘুরঘুর করতে থাকা লোভী বেড়ালনী টুনি পাখিকে বলত, কি করছিস লা টুনটুনি? আর তাকে দেখে মা পাখি ভক্তি দেখিয়ে বলত, পেন্নাম হই মা ঠাকরানী। ভক্তি দেখালে, সেই সময় বেড়ালনী তাকে আর আক্রমণ করে কোন্ মুখে। তাই লজ্জা পেয়ে সরে যেত। আস্তে আস্তে টুনি পাখির ছানারা বড় হল, উড়তে শিখল, বুদ্ধি হল। তারপর একদিন যখন টুনি নিশ্চিত, যে তার বাচ্চারা বিপদ আপদের মোকাবিলা করতে পারবে, তখন টুনিপাখি টহল মারতে আসা বেড়ালনীকে কি বলেছিল, সব মনে পড়ে শ্যামলীর।
পাখির বুদ্ধির কথা ভাবতে ভাবতে শ্যামলীর মনে হল, পাখির শরীর গড়তে কি আশ্চর্য পরিশ্রম করেছে প্রকৃতি। পাখির হাড়কে করেছে অনেক বেশি ফাঁপা আর হালকা। গা মুড়ে দিয়েছে পালকে।
পরিযায়ী পাখিকে দিয়েছে অদ্ভুত ডানার জোর আর দিক চেনার ক্ষমতা। কত পাখি শীতের দেশ থেকে উড়ে আসে ডিম পাড়তে, পথ চিনে চিনে।
পাখি তো সঞ্চয় করে না। ওইজন্যে প্রকৃত সাধুব্যক্তি কোনো সঞ্চয় করে না। কালকূটের লেখা মনে পড়ে শ্যামলীর। সাধু ব্যক্তি ভিক্ষা করে অন্নসংস্থান করবেন। চাল ডাল যা জুটবে, তার সাথে যদি পয়সা জোটে, তাহলে মালসা কিনে অন্নভোগ বানাবেন সাধু। নিজেকে দেবেন, আর পাখপাখালিকে দেবেন। ওই হল খেচরান্ন। সহজ কথায় খিচুড়ি। খেচরান্ন কথায় পক্ষিজীবনের কথা বোনা আছে। পাখির মতো জীবন। চলে যাবার সময় মালসাটি ভেঙে দিয়ে যেতে হবে। অনিশ্চিত জীবনে ভেসে পড়তে হবে। ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় সাধুর সাজে না। বহতা পানি, রমতা যোগী। যে নদীটি জলের ধারা অব্যাহত থাকতে পারল না, তার শুদ্ধতা স্বচ্ছতা বজায় থাকে না।
যে সাধু সঞ্চয় করে, তার সাত্ত্বিক জীবন থাকে না। সে বিষয় বাসনায় জড়িয়ে পড়ে। পাখির মতো জীবন ভেবেছিল মানুষ। শ্যামলী পাখির মতো জীবন ভেবেছিল। বলাকার জীবন ভেবেছিল। শুদ্ধতম জ্ঞানের চর্চা করে যাবে ভেবেছিল। জ্ঞানের আলোয় স্নিগ্ধ আপসহীন মেরুদণ্ড টানটান জীবন ভেবেছিল।
মাকে পুজোর হাতখরচ পর্যাপ্ত পরিমাণে দিয়েছিল কারবারের লাভের টাকা থেকে। সাধারণ চাকুরীজীবী মানুষ অত বোনাস পায় না। কিন্তু মা বেশিরভাগ টাকাটা শান্তু আর অন্তুকে জামাকাপড়ের বিল মেটাতে দিয়ে ফেলল। তনুকে দিল খানিকটা। বাকিটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে জুয়ো খেলে ধরা পড়ল তার ভাইয়েরা। মহাভারতকার দেখিয়ে দিয়েছেন জুয়াড়ি কি করে সমাজ আর সংসারকে বিধ্বস্ত করে দেয়। আর জুয়াড়ি যুধিষ্ঠিরের পাপকর্মের ফল ভুগেছেন যাজ্ঞসেনী, যাঁর ওই জঘন্য অসম্মান প্রাপ্য ছিল না। তার আগে ইন্দ্রপ্রস্থ গড়ে সেখানে জ্যাঠতুতো ভাই দুর্যোধনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেইজ্জত করেছেন যুধিষ্ঠির। অহঙ্কার মদে মত্ত হয়ে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন অতিথি নারায়ণ, তাকে কোনোমতেই অসম্মান করা চলে না। ইন্দ্রপ্রস্থ যুধিষ্ঠির গড়েও ছিলেন পাপের পথে। কৃষ্ণ ও অর্জুন বেড়া আগুন দিয়ে ঘিরে ফেলেছিলেন খাণ্ডববন, ময়দানবের এলাকা। অরণ্যের প্রাণীদের হত্যা করেছিলেন কৃষ্ণ ও অর্জুন। ময়দানব কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এসেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে মুক্তিমূল্য আদায় করেছিলেন রাজা। ইন্দ্রপ্রস্থ বানিয়ে তবে বাঁচার সুযোগ পান ময়দানব। সেই অতি আশ্চর্য সুরম্য প্রাসাদের মালিক হয়ে অহঙ্কার হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের। তাই তিনি অতিথি দুর্যোধনকে প্রকাশ্যে হেনস্থা করতে পিছপা হন নি। জুয়ার সাথেই একসাথে অহঙ্কার মদে মত্ত হয়েছিলেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব।
বাবা নিজের হাতে গড়া কারবার থেকে মুঠো মুঠো টাকা তুলে নিতে দ্বিধা করেননি। যার যা প্রাপ্য নয়, তাকে পুজোয় সেই মাপের উপহার দিতে গিয়ে, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবিকে দু পায়ে মাড়িয়ে গিয়েছেন বাবা। মা বাবাকে লুকিয়ে লুকিয়ে ছেলেদের মদের অভ্যাস নীরবে দেখে গিয়েছেন।
বাবা রাগ করবেন কিংবা ব্যথা পাবেন বলে মা সব তথ্য চেপে গিয়েছেন। বাবা মা দুজনেই তাঁদের সামনে বড় হয়ে যাওয়া বোনের উপর শান্তুকে হাত তুলতে দেখে শাসন করেন নি। এই সমস্তই অপরাধ। আর এই অন্যায়ের জন্য আজ পরিবারের সম্মান বিধ্বস্ত। বাইরে পাড়ায় সকলের প্রশ্নাতুর চোখের সামনে দিয়ে সে হাঁটবে কেমন করে? কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে কানাকানি হলে সে আটকাবে কি করে? ভাবতে ভাবতে কান্না পেল মেয়ের। চোখের ভিতর থেকে আগ্নেয় প্রবাহের মতো বেরিয়ে আসছে উষ্ণস্রোত। মেয়ে চেয়ারে বসে পড়ে হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকল। যে মেয়ে কখনো কাঁদতে পারে না, সে যদি কখনো কাঁদে, সে কান্না হয় বাঁধনহারা। ফুলে ফুলে কাঁদছে শ্যামলী। তার বাবা কিছু একটা আন্দাজ করে মেয়ের ঘরে ঢুকে দেখলেন মেয়েটা কেঁদে চলেছে। ডাকাবুকো, স্বাস্থ্যবান, ব্যক্তিত্বময়ী মেয়েকে কাঁদতে দেখে বাবারও কান্না পেয়ে গেল। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বাপ আর মেয়ে কাঁদতে লাগল। বাসন্তীবালা এসে বাপ মেয়েকে ওভাবে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।