• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৯২)

পর্ব – ৯২

৯১

বাড়িতে গিয়ে শ‍্যামলী দেখল সবিতা পিসি তার ঘরে খুব কম পাওয়ারের আলো জ্বালিয়ে বসে ঝিমোচ্ছে।
শ‍্যামলী ডাকল, পিসি!
পিসি বলল, অ, আসার সময় হল এতক্ষণে!
শ‍্যামলী বলল, দ‍্যাখো পিসি, তোমার জন্য কি এনেছি!
আচ্ছা, এত ঝিমোনো আলোয় থাকো কি করে তুমি?
 শাড়ি হাতে নিয়ে খুশি হল সবিতা। বলল, হ‍্যাঁ রে, তোর বাপ মায়ের জন্য এনেছিস তো?
শ‍্যামলী বলল, মাকে টাকা দিয়ে ছিলাম। বলেছিলাম, যার যা লাগে কিনে নিও।
সবিতা বলল, ও রকম বললে হয়? তোর মা একলাটি বেরিয়ে জামা কাপড় কিনে আনবে? পাল বাড়িতে এ হয়েছে কোনো দিন?
শ‍্যামলী বলল, যাই হোক, বাবা বলেছিল মায়ের হাতে পুজোর খরচ ধরে দিতে। আমি সেটা করেছিলাম।
সবিতা বলল, ক‌ই, বৌমণি তো আজ জামাকাপড় কিনতে বেরোয় নি। অবশ‍্য তোর বাবার শরীর খারাপ হতে কোথাও যায় না বৌমণি। যতটুকু পারে ঠাকুর ঘরে বসে থাকে।
শ‍্যামলী বলে, পিসি, আমি মাকে বলেছিলাম তোমাকে দিয়ে জামাকাপড় কিনে আনতে।
সবিতা অমনি বলল, ওমা, এই তোমার ফন্দি! ও আমি যাব না। পছন্দ করে কিনে আনব, আর এ বলবে, এ টা ভাল না,  ও বলবে, সেটা ভাল না। আমি অতো ফৈজতে নেই! আমি মোটেও যাব না তোদের জামাকাপড় কিনতে।
শ‍্যামলী বলল, দাদা আর অতনু তো নিজের নিজের পছন্দের জিনিস আগেই কিনে নিয়ে মাকে বিল ধরিয়ে দিয়েছিল। দিদিও তো নিজেদের জিনিস কিনে নিয়ে বিলটা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। কাজ তো অনেক সহজ হয়ে গেছে।
সবিতা বলল, দাদা যতদিন পর্যন্ত কারবার সামলাত, পছন্দ করে যা এনে দিত, তাই আনন্দ করে পরতাম। এটা ভাল না, ওটা ভাল না, এমনটা আমার মুখ দিয়ে কোনোদিন বেরোয় নি।
শ‍্যামলী বলল, যাই হোক, মা টাকা পেয়েছে, এবার তোমাদের জন্য কি করে দেখা যাক। তবে এই শাড়িটা পাল অটোমোবাইল দেয় নি।
সবিতা বলল, সে কিরে, কে দিল তবে?
শ‍্যামলী বলল, খুবই ইচ্ছে ছিল, তোমাকে পুজোয় শাড়ি দেব। আমার স্কলারশিপের টাকা জমিয়ে রেখেছিলাম। আমার ইচ্ছেপূরণ হল।
সবিতা বললেন, তোর জলপানির টাকা?
শ‍্যামলী হাসল। বলল, পরো। পাড়ার প‍্যাণ্ডেল থেকে ঘুরে আসি।
সবিতা বলল, তোকে নিয়ে আর পারি না।
শ‍্যামলী ফিরেছে টের পেয়ে তার বাবা তাকে ডেকে পাঠালেন।
শ‍্যামলীকে তার বাবা বললেন, তোকে আমি বলেছিলাম রামনারায়ণের ব‍্যাপার টা ভুলে যেতে। বলে দিয়েছিলাম ও একটা গুণ্ডা লোক। কিন্তু আমার কথা তো তুই শুনলিই না, তুই ওর বাড়ি গেলি, আর শুধু সেখানেই থেমে না থেকে গুণ্ডা টাকে বাড়িতে ডেকে আনলি। আবার বললি, ওই রকম একটা গুণ্ডা নাকি তোর বন্ধু! শ‍্যামলিমা, আমি ভাবতে পারছি না, নিজের বাবাকে তুই এতটা নিচে নামালি কি করে?
শ‍্যামলী বলল, এর কৈফিয়ত দেবার পরে তুমি নিশ্চয়ই বলবে অনসূয়া চ‍্যাটার্জি এবাড়িতে এল কেন, আর এল যদি, কোন্ সাহসে আমার সামনে আমার ছেলেটাকে ধমক ধামক দিয়ে গেল!
শশাঙ্ক পাল বললেন, এটা ঠিক যে শান্তু একটা ভুল কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু সেটা নিয়ে উকিলকে জানানোটা তোর একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে ব‌ই কি!
তবু বলব, অনসূয়া চ‍্যাটার্জি একটা বনেদি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। শিক্ষা দীক্ষায় অনেক এগিয়ে। সে সমালোচনা করলে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু একটা ওয়াগন ব্রেকার গুণ্ডাকে তুই বাবা মায়ের সামনে বসে বন্ধু বলবি, এটা আমার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, আমি ছোট্ট দু কথায় উত্তর দিচ্ছি। প্রথমতঃ, অনসূয়াদির কাছে আমি দাদার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করি নি। দাদা যখন আমায় পিঠের উপর ঘুঁষি বসিয়ে দিল, তখন গোবিন্দ কাকা ঘরে ছিল। গোবিন্দ কাকা যেই দেখল, একটা বড়ো হয়ে যাওয়া মেয়েকে শশাঙ্ক বাবুর বাড়িতে শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হতে হয়, আর বাড়ির বড়রা সেটার প্রতিকার করতে পারে না, তখন তার মনে হল, এই পরিস্থিতির একটা সামাজিক প্রতিকার হওয়া দরকার। অনসূয়াদি গোবিন্দ কাকার কাছে সবটা জানতে পেরে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি অনুযায়ী কিছু বলেছেন। আমি তাঁকে কোনো অভিযোগ জানাই নি। জানালে খারাপ হত না।
দ‍্যাখো বাবা, দুর্যোধন যখন কুরুসভায় দ্রৌপদীর একমাত্র কাপড়টা ধরে টানছে, তখন দ্রৌপদী তার মহাবল পাঁচ স্বামীর কাছে সুরক্ষা না চেয়ে আত্মীয় কৃষ্ণের হস্তক্ষেপ চেয়েছিল। সে নিজের বাস্তব বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পেরে গিয়েছিল, যে হতভাগা জুয়ার আসরে নিজের বৌকে বাজি রাখে, সে মতিচ্ছন্নের কাছে সুরক্ষা চাওয়ার কোনো মানেই নেই।
আর, রামনারায়ণ বাবু আমাদের খুবই জ্বালাতন করছিল। তোমার মনে আছে হয়ত ওঁর লোকজন আমাদের টেবিলের কাঁচ ভেঙেছিল বলে আমি লড়াই করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতির বদল হল না। গাড়ি সারিয়ে দাম না দিয়ে চলে গেল ওঁর লোক। আমি চিন্তা করে দেখলাম, এই পরিস্থিতি চলতে দেওয়া যাবে না।
আমি ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম পয়সা আদায় করার জন‍্য। যদিও মালিক হিসেবে তোমার নিষেধ ছিল। কিন্তু আমাদের কথা ও কাহিনী ব‌ইতে দুর্গেশ দুমরাজ বলে একজনকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লিখেছেন প্রভুর কর্মে বীরের ধর্মে বিরোধ বাধিল আজ। বাবা, তোমার কারবারে আমি সামান‍্য মজুর। কিন্তু রামনারায়ণ বাবুর লোকজন এই অত‍্যাচার চালিয়ে যাবে, এটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।
শশাঙ্ক পাল অধৈর্য হয়ে বললেন, অন‍্যায় দেখে প্রতিবাদ করেছিস, সে তো ভাল কথা, তা বলে একটা গুণ্ডাকে বন্ধু বলতে হবে?
শ‍্যামলী বলল, বাবা, আমি যে মেয়েটা ভাল ন‌ই, সে নিয়ে আমার আত্মীয় স্বজনেরা জানেন। নিজের বাবার চিকিৎসার জন্য যখন বাড়িতে নিজের ভাইবোন কাউকে পেলাম না, তখন মনে হয়েছিল প্রবাল সেন আর অরিন্দম দাশগুপ্তের কথা। সেই নিয়ে তুমি কিছু না বললেও জামাইবাবু হয়ে অরুণদা পর্যন্ত কটূক্তি করতে ছাড়েননি। লোকের মুখে গালমন্দ শোনা আমার অভ‍্যেস হয়ে গেছে বাবা। আমার আর ওতে কষ্ট হয় না।
আর যদি বলো, বাবা হিসেবে আমি তোর সাথে রামনারায়ণকে এক গাড়িতে ঘুরতে দেখে অস্বস্তি বোধ করছি,
শশাঙ্ক পাল মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার পয়েন্টটা ঠিক ওইখানেই, রামনারায়ণের মতো একটা গুণ্ডাকে বন্ধু বলতে পারিস কি করে?
মেয়ে বলল, তুমি একা নও বাবা, অনসূয়াদি পর্যন্ত বলছিলেন, শ‍্যামলী, এই হাড়বজ্জাত লোকটার সাথে মিশিস না।
শশাঙ্ক পাল বললেন, যে কোনো সুস্থ বুদ্ধির লোক সে কথা বলবে।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, আমি একটা অ্যাডাল্ট মেয়ে। পড়াশোনায় খুব খারাপ ন‌ই তা তুমি জানো। ভারতীয় সংবিধানে একজন অ্যাডাল্ট নাগরিক কার সাথে মিশবেন, না মিশবেন, এটা তাঁর ব‍্যক্তিগত ব‍্যাপার। আজ আমি রামনারায়ণবাবুর বাড়ি গিয়ে গাড়ি সারানোর টাকা আদায় করে আনতে পেরেছি বাবা। আর আমি আজ‌ই টের পেয়েছি, রামনারায়ণ বাবুর ভিতরে কিছু আত্মজিজ্ঞাসা মাথা তুলছে। সে ভাল হতে চাইছে। সন্তানের মুখ চেয়ে নিজেকে সংযত করতে চাইছে। বাবা, মানুষ মাত্রেই দোষেগুণে মিলিয়ে তৈরি। সবটাই দোষ, আর গুণ কিছু মাত্র নেই, এটা কিন্তু হয় না। আমি রামনারায়ণ বাবু্র গুণগুলো খু়ঁজে নিতে শিখছি বাবা।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।