• Uncategorized
  • 0

জন্মদিনে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন : স্টিফেন হকিং ( ১৯৪২ – ২০১৮)

লিখেছেন – মৃদুল শ্রীমানী।

স্টিফেন হকিং ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী। সেই সঙ্গে প্রতিভাধর গণিতবিদ। জাতি পরিচয়ে ইংরেজ। আজ আট জানুয়ারি এই মহাবিজ্ঞানীর জন্মদিন। ১৯৪২ সালে আজকের দিনে তিনি জন্মেছিলেন। আর গত ২০১৮ সালের ১৪ মার্চে তিনি প্রয়াত হন। ১৯৭৯ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ত্রিশ বছর ধরে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের লুকাসিয়ান অধ্যাপক ছিলেন। এটি একটি অত্যন্ত সম্মানিত পদ। পরবর্তীকালে তিনি ওই কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বগত মহাজাগতিক চর্চা কেন্দ্রের গবেষণা বিভাগের মহানির্দেশক বা ডাইরেক্টর ছিলেন। আমৃত্যু তিনি ওই পদে বৃত ছিলেন।
স্টিফেন হকিং একজন অসাধারণ মানুষ। কিন্তু সেটা শুধু এইজন্য নয় যে তিনি মহান বিজ্ঞানী গ‍্যালিলিও গালিলির তিনশততম প্রয়াণ দিবসে জন্মেছিলেন এবং আরেক যুগন্ধর বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এর ১৩৯তম জন্মদিনে প্রয়াত হন। বস্তুতঃ পক্ষে স্টিফেন হকিং এর এই জন্মদিন ও মৃত্যুদিনের সাথে ওই দুই বিজ্ঞান সাধকের মৃত্যু ও জন্মদিনের সমাপতন একটি নিছকই ঘটনা। এই জন্ম মৃত্যুর তারিখের সাথে অন‍্য মহাবিজ্ঞানীদের যোগকে আমি বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারছিনা। কিন্তু স্টিফেন হকিংয়ের জীবনটি একটি অসাধারণ রূপকথার চাইতেও বেশি রোমাঞ্চকর। কেন, তা বলছি আজ তাঁর জন্মদিনে।
স্টিফেন হকিং কিন্তু নোবেল পুরস্কার পাননি। পান নি এ কারণে যে কোনো তত্ত্বগত আবিষ্কার নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয় না। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এর যুগান্তকারী “ই ইকোয়াল টু এম সি স্কোয়ার” সূত্রটি নোবেল পুরস্কার পায়নি। তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আলোকবিদ‍্যা সংক্রান্ত গবেষণার জন্য। কিন্তু হকিং ১৯৭৬ সালে ম‍্যাক্স‌ওয়েল সম্মান পেয়েছেন। ওই ১৯৭৬ সালেই আরো পেয়েছেন হাইনম‍্যান পুরস্কার, ও হিউ সম্মান। ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ এই পর পর দুই বছর তিনি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এর নামাঙ্কিত সম্মান মাল‍্যে সম্মানিত হয়েছেন। ১৯৮৭তে পেয়েছেন পল ডিরাক স্মারক সম্মান। ২০০৬ সালে পেয়েছেন বিশ্ববন্দিত কোপলে মেডেল। এছাড়াও সারা জীবন ধরে অজস্র সম্মানে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। কিন্তু সেগুলি পাবার চাইতেও অসাধারণ ঘটনা তিনি নিজের জীবনে ঘটিয়েছেন। এবং সেই অসাধ‍্য সাধনের জন‍্য‌ই আমি তাঁর জীবনকে রূপকথার চেয়েও আশ্চর্য ঘটনা বলে মনে করি।

স্টিফেন হকিং এর কাজের মূল ক্ষেত্র ছিল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ও কোয়ান্টাম মহাকর্ষ। ১৯৬৬ সালে তাঁর ডক্টরাল থিসিস । ক্রমপ্রসারণশীল ও ক্রমবর্ধনশীল বিশ্বের বৈশিষ্ট্য নিয়ে তিনি আরো একজন বিশ্ববিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী রজার পেনরোজের সাথে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সূত্রগুলির ভিত্তিতে গ্রাভিটেশন‍্যাল সিঙ্গুলারিটি থিয়োরেম নিয়ে কাজ করেছিলেন। এটা বলতে গিয়ে তিনি আপেক্ষিকতাবাদের সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ‍্যা মিশিয়েছেন। ১৯৬৩ সালে, যখন তাঁর মাত্র একুশ বৎসর বয়স, তখন তিনি একধরনের স্নায়বিক ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন। ক্রমশ তাঁর পেশিগুলি নাড়াবার ক্ষমতা হারিয়ে যেতে থাকে। আমরা কথা বলি মুখের ভিতর জিভ ও ঠোঁট দুটোর পেশির নানাবিধ সমন্বয়ে। হকিংয়ের রোগ গুরুতর রূপে প্রকটিত হয়ে তাঁর কথা বলার ক্ষমতা গেল হারিয়ে। মুখের সামান্য একটা পেশির সামান‍্য নাড়াচাড়া করার সক্ষমতা অবশিষ্ট ছিল, আর সেইটুকু সম্বল করে একটি বাক্যগঠন যন্ত্র মারফত হকিং কথা বলতেন। এই দুরারোগ্য অসুখজনিত দুর্দশা বহন করতে করতে তিনি কঠিন তাত্ত্বিক গাণিতিক গবেষণা চালিয়ে গিয়েছেন। আর সেটা অর্ধশতাব্দী ধরে করে গিয়েছেন। এই যে জীবনের প্রতি আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসা, প্রকাশের সাধনা, দুর্ভাগ্যকে অতিক্রম করে নিজের মেধা ও মননের উচ্ছ্বাস, এটাকেই আমি বলছি এক অনন‍্য সাধারণ রূপকথা।

১৯৬৬র মার্চে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ‍্যা ও প্রায়োগিক গণিতের সূত্রে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ এবং কসমোলজি নিয়ে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এই গবেষণার সূত্রে তাঁর প্রবন্ধ ” সিঙ্গুলারিটি ও দেশ কালের জ‍্যামিতি” ১৯৬৬ সালের অ্যাডামস প্রাইজ লাভ করে। ১৯৭১ সালে তিনি ব্ল‍্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন এবং তার ফলে গ্র‍্যাভিটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন থেকে সম্মানিত হন। ১৯৭৩ সালে অন‍্য একজন গবেষকের সাথে তিনি লেখেন “দি লার্জ স্কেল স্ট্রাকচার অফ স্পেস টাইম” পুস্তকটি। এটিই স্টিফেন হকিং এর রচিত প্রথম ব‌ই। ১৯৭৩ থেকে হকিং কোয়ান্টাম মহাকর্ষ ও কোয়ান্টাম বলবিদ‍্যা নিয়ে গভীর চর্চা শুরু করেন। সেই গবেষণা লব্ধ ফল প্রকাশ পায় ১৯৭৪ সালে। হকিং বলেন যে ব্ল‍্যাক হোল থেকে বিকিরণ নির্গত হয়। এবং এভাবে বিকিরণ চলতে চলতে একসময় ব্ল‍্যাক হোলের শক্তি নিঃশেষিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে বিলীন করে দেয়। ব্ল‍্যাক হোল থেকে এই যে বিকিরণ, আজ একেই আমরা হকিংয়ের সম্মানে “হকিং রেডিয়েশন” বলে থাকি।

ব্ল‍্যাক হোল ও মহাকর্ষ নিয়ে হকিংয়ের গবেষণা বিজ্ঞানীমহলে এতটাই শ্রদ্ধা অর্জন করে যে, ১৯৭৮ সালে তিনি অ্যালবার্ট আইনস্টাইন পদক লাভ করেন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি দেন। ১৯৮১ সালে হকিং বললেন যে, মহাজগতের না আছে কোনো সীমানা , না আছে তার শুরু, আর না আছে তার শেষ। ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে হকিংয়ের বিখ্যাত ব‌ই “এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম” প্রকাশিত হয় এবং বিপুল বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ করে। মানব সভ‍্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে হকিং উদ্বিগ্ন ছিলেন। পারমাণবিক যুদ্ধ, গবেষণাগারে তৈরি ভাইরাস, আর গ্লোবাল ওয়ার্মিং মানব সভ‍্যতাকে বিনষ্ট করে দেবে এই দুশ্চিন্তা তাঁকে কুরে কুরে খেত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কিছু বিপদের ইঙ্গিত তিনি দিয়ে রেখেছেন। তবে এর চাইতে বেশি সাবধান থাকতে বলেছেন পুঁজিবাদের আগ্রাসী মনোভাবের থেকে।
হকিং ছিলেন ঘোষিতভাবে নাস্তিক। তিনি বিশ্বাস করতেন এই মহাবিশ্ব বিজ্ঞানের নিয়মে চলে। এবং কোনো সর্বময় কর্তার অঙ্গুলিহেলনে চলে না। সাধারণ মানুষের মধ্যে পরলোক সংক্রান্ত যে ধারণা আছে, তাকে তিনি অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের আজগুবি ধারণা বলে ব‍্যাখ‍্যা করেন। স্টিফেন হকিং ব‍্যক্তি মালিকানার বিপক্ষে ছিলেন এবং সর্বমানবের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার কথা বলতেন। হকিং ছিলেন মহাবিজ্ঞানী। তবে তার চাইতেও বেশি ছিলেন একজন মানবদরদী জীবনমুখী দার্শনিক।
আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।