• Uncategorized
  • 0

ছোট গল্পে অমিতা মজুমদার

অভ্যাস

আজ বাংলা বছরের প্রথম দিন। ছুটির দিন হলেও আজ সীমা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। বছরের প্রথম সূর্যোদয় দেখবে বলে। এটাও সীমার একটা অভ্যাস অন্য আরো পাঁচটা অভ্যাসের মতো। গত পঁচিশ বছরে এরকম কিছু অভ্যাস তৈরী হয়েছে যা আর বাদ দিতে পারছেনা। মনে পড়ে প্রথম যখন অর্কর সাথে দেখা হয় তখন এরকম কোন অভ্যাসই তার ছিলনা। বিয়ের পর অর্কর সাথে থাকতে থাকতে কখন যে এই অভ্যাসগুলো তার সাথী হয়ে উঠেছে সে টেরও পায়নি।
এবারেও প্রতিবারের মতো সূর্যোদয় দেখতে ছাদে চলে যায়। একা একা উদীয়মান সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে অপলক। বিয়ের পর প্রথম বছর দশেক তো তারা চলে যেতো দুদিন আগে সমূদ্রের কাছে। সাগরপারের বালুকা বেলায় বসে সূর্যোদয় দেখার একরকম নেশা ছিল অর্কর। সেই নেশা সীমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়। তাইতো যে বছর বুবাই জন্মালো সেই ছয়মাসের বুবাইকে নিয়েও তারা সাগরে গিয়েছিল। পরে যখন বুবাই অসুস্থ হয় তখন সবাই খুব বকাবকি করেছিল সীমাকে।
আস্তে আস্তে বুবাই বড় হতে লাগলো, বিন্দি জন্মালো। সীমা আর সেভাবে সাগরে যেতে পারেনা। কিন্তু অর্ক প্রতিবছরই যায়। সেই থেকে সীমা ছাদে চলে যায় বছরের প্রথম সূর্যোদয় দেখতে। বুবাই, বিন্দি এখন অনেকটা বড় হয়ে গেছে। বুবাই তো সেই বছর পাঁচেক আগে বিদেশে পড়তে গিয়ে সেখানেই এক সহপাঠীর সাথে ঘর বেঁধেছে। একবার বৌ নিয়ে এসেছিল ।তারপরে ঐ ফোনেই যা কথা হয় নিয়ম করে সপ্তাহে একদিন। কিছু গদবাঁধা কথা বলার পর দুজনারই কথারা হারিয়ে যায়। যদিও কয়েকবার বলেছে মা তুমি এখন এখানে চলে এসো। কিন্তু সীমা যেতে পারেনি।না যেতে পারেনি কথাটা ঠিক নয় সে ইচ্ছে করেই যায়নি।তার মনে হয়েছে এই বেশ আছে নিজের মতো করে।
বিন্দিও তার নিজের সংসারে ভালই আছে। জামাই ভালো ব্যবসা করে। মেয়ে স্বামী নিয়ে তার সংসার। যদিও সীমা চাইতো বিন্দি কিছু একটা করুক। কিন্তু বিন্দি নিজের মতো করে ভালো থাকতে চায়। নিয়ম করে পালা পার্বনে এসে তাকে দেখে যায়,উপহার দিয়ে যায় ।সীমা তাতেই খুশি।
সীমা জানে আজ একবার বুবাই ফোন করবে। সন্ধ্যা বা রাতে বিন্দি একবার আসবে। তাই অভ্যাস মতো ফোনটা কাছ ছাড়া করেনা। আবার নাতনির জন্য তার পছন্দের চিঁড়ের পোলাও করার আয়োজন করতে লেগে যায়।
হঠাৎ সীমার মনে হলো আজ সে তার অভ্যাসগুলোকে মানবেনা। যে কথা সেই কাজ।তাড়াতাড়ি ফোনটার সুইচ অফ করে দূরে সরিয়ে রাখে। চিঁড়ের পোলাওয়ের আয়োজন বন্ধ করে স্নান করতে চলে যায়। স্নান সেরে বেরিয়ে এসে কাপড় পরে নেয়। একটু হালকা সাজগোজ করে। আয়নায় নিজেকে দেখে আর মনে মনে ভাবে সেতো দেখতে মন্দ নয়!
ড্রাইভারকে কাল ছুটি দিয়েছিল।ও বেচারার তো নববর্ষে বৌ বাচ্চা নিয়ে আনন্দ করতে ইচ্ছে করে। তার নাহয় কেউ নেই। একটা উবার ডেকে সোজা গাজীপুরের দিকে যেতে বলে। আগে একবার গিয়েছিল খোঁজখবর নিতে। অবসরে যাওয়ার পর যদি ওখানে থাকা যায় ! তাই পরিবেশ ব্যবস্থাপনা দেখার জন্য গিয়েছিল। আজ যাচ্ছে বছরের প্রথম দিনটা তাদের সাথে কাটাতে যাদের একদিন সব ছিল আজ কেউ নেই,কিছু নেই।
সীমার মনটা আজ খুব ফুরফুরে লাগছে। মনে হচ্ছে সেই ছোট্টবেলার মতো সে আজ স্বাধীন। কোন বন্ধন নেই তার আগে পিছে। মহানগরের কোলাহল আর যানজট ছাড়াবার পরই ড্রাইভারকে বলে এসি বন্ধ করে দিতে আর গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে দিতে।বাইরে যদিও গ্রীস্মের উষ্ণতা আছে তবুও তার সাথে বাতাসও আছে, চোখে মুখে লাগতেই সীমা আপন মনে গুনগুনিয়ে ওঠে– “কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা, মনে মনে মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা “ ।
পথের পাশের গাছপালা ঘরবাড়ির সাথে সীমার মনটাও ছুটে চলছে উল্টোদিকে। সেই ছোট্টবেলায় বাবার হাত ধরে মেলায় যাওয়া,চুড়ি ফিতা,খেলনা,বায়োস্কোপ কতোকিছুর জন্য যে বায়না করতো। সেদিন যেন বাবা কল্পতরু হয়ে যেতেন।যা চাইতো তাই বাবা দিতেন। ওই একটা দিন বাবা একেবারে অন্যমানুষ হয়ে যেতেন। বাড়িতে মাও এদিন তেমন বকাঝকা করতেননা।
তারপরে যখন অর্কের সাথে দেখা হলো ,সেও কেমন যেন ঠিক বাবার মতো সব আবদার মেনে নিত। অর্কের সাথে সেই দশটা বছর যেন ঘোরের মধ্যে ছিল সীমা। তাইতো জানতেই পারেনি জীবন আসলে কোন স্বপ্নে আঁকা ছবি নয়।
বিন্দির জন্মের বছর পাঁচেক পর সীমা তখন ঘোর সংসারী । অফিস আর সংসারে নিজেকে একেবারে লীন করে ফেলে। তাই খেয়াল করেনি অর্ক কখন কেমন করে অনেকটা বদলে গেছে। যখন খেয়াল হয় তখন আর অর্কের যেমন ফেরার উপায় ছিলনা,তেমনই সীমাও চায়নি সে ফিরে আসুক।
তাই অর্ক যেদিন সীমাদের ছেড়ে চলে যায় সীমা একটুও ভেঙে পড়েনি।বুবাই তাকেই দোষারোপ করেছিল তার বাবার চলে যাওয়া নিয়ে। সে কেন বাবাকে আটকায়নি। অবুঝ বিন্দি তেমন কিছু বলেনি।
তারপরে এই এতোটা বছর সে ভালই কাটিয়েছে। বুবাই বরাবর পড়ালেখায় ভালো ছিল তাই দেশের পড়া শেষ করে বাইরে যেতে অসুবিধা হয়নি। বিন্দিটা হয়তো মায়ের ভাঙা সংসার দেখে নিজের সংসার রক্ষা করায় বেশি মনোযোগী হয়েছিল।তাই উচ্চমাধ্যমিক পাশের পরপরই নিজে পছন্দ করে ব্যবসায়ী ছেলে আবিরকে বিয়ে করে। বেশ আছে। স্বামী সংসার সন্তান নিয়ে মহাব্যস্ত দিন কাটে তার।
বড় হবার পরে মাঝে মাঝে সীমাকে দোষারোপ করে এটা সেটা বলতো এখনো বলে সংসার করা,পুরুষ মানুষের মন বুঝে চলা,তাদের সুখ সুবিধার দিকে খেয়াল রাখা এগুলো সব পুরুষ মানুষই চায়। তাই তার বাবার কোন ভুল ছিলনা। সীমার জন্যই তারা বাবার আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
সীমা এই চিরাচরিত অভিযোগ অনুযোগ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনা। মাঝেমধ্যে অর্কের জন্য একটা মন কেমন করা শূণ্যতা অনুভব করা ছাড়া সীমার স্বাভাবিক জীবনে কোন ছন্দপতন ঘটেনি। হ্যা অর্ক তাকে অনেক কথা বলেছে। বারবার বুঝাতে চেয়েছে তার অনুপস্থিতিতে সীমার জীবন কতোটা দুর্বিসহ হবে,চারিদিক থেকে তাকে ছিঁড়েখুড়ে খাবে। তারমতো নির্বোধের মাথার উপর অর্ক ছিল বলে সে জানতেই পারেনি পৃথিবীটা কেমন।
হ্যা প্রতিকুলতা এসেছে নানারকমের কিন্তু তাকে সাহস এবং বুদ্ধি দিয়ে মোকাবেলা করেছে সীমা। আর তাইতো জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় সবাই বলে একা হাতে কি সুন্দর সংসার সন্তান সামলেছে সীমা।
আজ এসব ভাবার জন্যতো সীমা নিজের অভ্যাস বদলে বেরিয়ে পড়েনি। একটাইতো জীবন সে জীবনে যাকিছু অনভিপ্রেত তাকে বাদ দিয়ে চলতে পারলেই তো শান্তি। তাই সীমা যেমন করে এক ঝটকায় তার এতো বছরের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে এসেছে সেভাবেই নিজের ভাবনার রাজ্যেও একরাশ স্বপ্ন এঁকে নেয়। যা পুরন করার জন্যই তার আজকের এই অভ্যাস বদল।
তাই সে ছুটে যাচ্ছে তাদের কাছে যারা একসময় সংসার সংসার করে প্রাণপাত করেছে। সংসারের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে গর্ব করেছে। সময়ের ছোবলে সেই সংসার তাদের বাতিল ঘোষনা করে সরিয়ে দিয়েছে সংসারের গন্ডি থেকে। এখানে এসে অনেকেই দুঃখ পায়,আহাজারি করে।কিন্তু সীমার কাছে মনে হয় এইতো ভালো। শুধু আপত্তি এর দুঃখ দুঃখ নামকরন আর মানুষের অকারণ আহাজারিতে।
এরকম একটা ঠিকানার নাম হতে পারে নক্ষত্রবাড়ি,অরুনালয়,সমৃদ্ধ প্রবীননিবাস। তা নয় বৃদ্ধাশ্রম।যেন বয়েস হলেই তাকে আশ্রমে থাকতে হবে। যেখানে থাকাটা মোটেই সুখকর নয় এই ভাবনাই তাড়িত করে সবাইকে। কিন্তু তা কেন হবে?
সীমা আসার পথে বাজার দেখে গাড়ি থামিয়ে নেমে পরে। কিছু ফল মিষ্টি কেনে। কিছু শুকনো খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ,খানকয়েক কাপড় কিনে নেয়। জানে ওখানে অনেকেরই এসবের দরকার নেই। পরিবার থেকে কোনকিছুরই অভাব রাখেনি। শুধু তাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে জিনিষটার তাই দিতে পারছেনা তারা। জীবন জীবিকা সহ স্বাভাবিক ব্যস্ততায় তারা নিজেরাই হিমসিম খাচ্ছে। তাই নিরুপায় হয়ে ছেলে হয়তো মাকে রেখে আসে,মেয়ে হয়তো বাবাকে রেখে আসে।
সীমা সেই অনাগত সময়টাকে সুযোগ দিতে চায়না। তাই এতোকালের অভ্যাসকে এক লহমায় ঝেড়ে ফেলে বেরিয়ে আসে আপন ঠিকানার সন্ধানে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।