লাল নীল হালকা সাদা নানা রকম বাতি । তবুও ঘরটি ঝকঝকে পরিষ্কার না। হালকা হালকা পরিষ্কার।এ যেন চাঁদনীময় রাত কিংবা সবে ভোর অথবা পড়ন্তু সন্ধ্যা। সবার মন ফুরফুরে। গোলগোল টেবিলে কত রকম চকচকে নকশা।এ যেন নকশার রাজধানী। হালকা মিউজিকের তালে সরাব হাত পা দুলে। এই দোলা যে কত মহাসুখের দোলনা তা অনুভব করছে ওরা তিনজন, মো:খালেদ, আহমেদ হোসেন, এবং পাইলট প্রশান্ত। মালি মিউজিক রেস্টুরেন্টের গোলটেবিলে তিন খানা চেয়ার ত্রিভুজ আকৃতির করে মুখামুখি বসে আছে তিনটি কফির কাপ নিয়ে ওরা তিনজন।মাঝে মাঝে চকচকে সাদা দাঁতগুলো বেরিয়ে আসছে হায়নার মত। একি হাসি, মহা উল্লাসের হাসি। পৃথিবীর সবাই হেরে গেছে তাদের কাছে।মিডিয়া, পাবলিক, সমালোচক সবাইকে বানিয়ে দিয়েছে নিরন্তর ধূসর গাঁদা।
“ওরা সবাই বোকা, “বলে হা হা করে হেসে উঠলেন মো:খালেদ।
আহমেদ হোসেন ওর কথার সায় দিয়ে বলে উঠলো, “আমরা কারা বুঝতে হবে, খালেদ মিয়া।”
স্বগর্বে বলে যেতে লাগলো পাইলট প্রশান্ত, “আরে দেখতে হবে না, আমরা কারা; বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে বিদ্যা অর্জন করেছি বলে কথা; এতটুকু যদি না করতে পারি তা হলে ত প্রতিষ্ঠানের মান কোথায় থাকে!”
কথা শেষে সবাই উচ্চস্বরে হা হা করে হেসে উঠলো। বাঘের মতো হরিণ মেরে আজ যেন উৎসবে মেতেছে তারা।
হঠাৎ হাসি থামিয়ে খালেদ, প্রশান্তকে জিজ্ঞাসা করে, “ভাই, তুমি যখন বিষয়টি দেখলা তখন তোমার কেমন লেগেছিল?”
“—–আরে শুনো না! প্রথম বিষয়টি দেখলাম আমার পরিচিত একজনের Facebook Profile এ।
রাতারাতি অনেকের profile দেখলাম। তার পরে বিভিন্ন পাবলিক মিডিয়ায়। এমনকি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে কথা তুলছে।আমার গায়ে ভাই জ্বর চলে এলো। এবার বুঝি আমি শেষ। আমাদের আর বুঝি রক্ষা নেই।ঈশ্বরের বিশেষ কৃপায়, দেখ ভাগ্য ক্রমে বিষয়টির তদন্ত পরে গেল আমাদের উপর।”
হা হা করে হেসে আহমেদ হোসেন বলে চললো, “আপন মামা মন্ত্রণালয়ের সচিব, তদন্ত আমাদের উপর পড়বে না ত কাদের উপর পড়বে!”
প্রশান্ত একটু করুনার সুরে, “যাই বল মিয়া,ওরকম সহজ সরল সোলতান আলীকে আমাদের ফাঁসানো উচিত হয় নাই।
কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন আহমেদ হোসেন, “কিসের উচিত হয়নি? শালা আস্ত একটা হারামজাদা।ওর জন্য গুলশানের চারতালা বাড়ির কাজ শেষ করতে পারি নাই। শালা ঘুষ খাবে না, দুর্নীতি করবে না।দু’টাকা বেতনে ওর পোষায়, আমাদের পোষায় না।শালা জীবনটারে হেল করে দিছে।”
খালেদের কন্ঠেও যেন আগুন, “শালা নাস্তিক, নামাজ নাই, কালাম নাই। ফছিগিরি করে।ঘুষ খাবে না, দুর্নীতি করবেনা, দেখ এখন কেমন লাগে, দিছি ত ফাঁসিয়ে। গত বছর বায়না দিয়েও ওর জন্য সাভারে এক বিঘা জমি কিনতে পারি নাই।শালা জীবনটারে নরক বানিয়ে দিছে।”
কথা গুলো অসহ্য লাগল; প্রশান্ত আপন মনে অতীতের নোংরা কাজ গুলো নিজের মনের আয়নার ভাসাতে লাগলোঃ–আমি, খালেদ আর আহমেদ তিনজনে যখন সন্ধ্যাবেলায় নিজের বাড়ি ছাদে প্লান করিযে; নদী খনন এবং পার সংরক্ষণ কাজের প্রকল্পের আমরা চারজনই হলাম উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এর মধ্যে সোলতান আলী খুব সৎ। সে কোন কাজে ভেজাল চায় না।তার জন্য আমরা অনেক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হই।তিনি অন্য একটি কাজের জন্য বিদেশে থাকায় এই প্রকল্পে তিনি তেমন ভাবে ঠিক মতো দেখভাল করতে পারেন নি, সেই সুযোগ আমরা খুব খারাপ ভাবে কাজ করে প্রকল্পের প্রায় ষাট শতাংশ অর্থ আত্মসাৎ করি। পরে যখন সোলতান আলী বিষয়টি বুঝতে পারে, তখন খুব সতর্কতার সাথে গোপনে বিষয়টি প্রকাশ করে দেয়। এই সততাই তার জীবনকে নষ্ট করে দেয়।আমরা যখন তিন জন তদন্তের কাজ করি তখন সকল তথ্য ওলট পালট করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে, জাল কাগজপাতি বানিয়ে মন্ত্রণালয়ে জমা দিই। তাতে সকল দুর্নীতি দায়ভার চাপে সোলতান আলীর উপর। বাংলা মন্ত্রণালয়। আমাদের তদন্তই হবে চূড়ান্ত তদন্ত। আর কেউ এই বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবে না।কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা আর দেখা হবে না। সত্যের জয় চির দিন হয়।
কথাগুলো স্মরণে আসতেই নিজের প্রতি ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রবল বেগে ধেয়ে আসতে লাগলো আত্ম সংশোধনের লাল নীল হালকা সাদা কাল সহস্র ঘৃণা।তাই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশান্ত ওদের লক্ষ্য না করে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, “তোমরা থাকো, আমি আসি।”
“আর একটু থেকে গেলে হয় না”
“আমার কেমন যেন লাগছে। আমি আর পারছি না।,”বলে বেরিয়ে গেলেন প্রশান্ত।
ওর এই যাত্রা পথ কেউ খেয়াল করলো না। এইটাই পৃথিবী। এটাই চরম সত্য।