• Uncategorized
  • 0

গল্পে বেদশ্রুতি মুখার্জী

বাংলা বাঁচুক আগে

“প্লিজ বাংলা বাঁচান”- এই কাতর আবেদন ফেসবুক থেকে ইনস্টা, হোয়াটসঅ্যাপ টুইটার সর্বত্র চলছে। আমরা আঁতেল হতে গিয়ে গুটিকতক কবিতাও ঝেড়ে দিচ্ছি। কলেজস্ট্রিটে বই ভাসছে, আমরা বইপাড়ার দুঃখে যতটা না কাতর, তার চেয়ে ঢের বেশি ইলেকট্রিসিটি নেই, নেট নেই, ওয়াইফাইও কাজ করছে না, ওয়ার্ক ফ্রম হোম হবে কীভাবে- এসে ভেবে??? চুলগুলো দুই রাতেই সাদা হয়ে গেল নাকি ওয়াইফাই এর চক্করে??? হাত হয়তোবা অনেকের ব্যথা হয়ে যাচ্ছে জল তুলে তুলে। সত্যিই বিড়ম্বনা। আমাদের জল নেই, এই গরমে পাখা নেই, ইন্টারনেট নেই।
আর ওদের…
আমার আপনার মালতীর মা? সাবানাদের? কালোমেঘ ওদের সবটুকু লুট করে নিয়ে গেছে, একটুকরো জমি ছিল, ছিল একটা কাঁচাপাকা মিলিয়ে ঘর, কটা ভাঙা বাসন, পঞ্চায়েতের আশ্বাস একদিন তিন লাখ আশির ঘর মিলবে, আর বাচ্চার ইস্কুলের মিড ডে মিল। একে রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর। করোনার কড়াল থাবায় এমনিই দুমাস ধরে ঘরবন্দী, রোজগার নেই বললেই চলে, বর যেটুকু যা সবজি নিয়ে ফেরে, আর অন্য সবজিওয়ালাদের সঙ্গে মারপিট করে, শাসানি শোনে- “আমার এলাকায় ঢুকলে না”… সবাই তো সবজিওয়ালা, মাছওয়ালা, ক’টাকাই বা জোটে, আমরা তো হাইজিনের ভয়ে এমনিও ওদের থেকে খুব একটা নিইনা। ওরা করোনা মরোনা বোঝেনা বস, বোঝে খিদা, ভয়ংকর রাক্ষুসে খিদা, ওদের বাচ্চরাও আমার আপনার ভাগ্নাভাগ্নি বা বাচ্চাদের মত ন্যাকা নয়, ভাতে তাদের বমি পায়না, এদের কাছে ফিসফ্রাই, রোল, ফুচকা, পিৎজা বার্গার যেমন, ওদের কাছে একদলা গরম ভাত। একবেলা হয়তোবা জুটছিল, এরপর আর তাও জুটছে না। আমরা যখন নেটের অভাবে ছটফট করছি, কিংবা মার্কড সেফ খেলছি, তখন ওদের বাচ্চা গুলোও ছটফট করছে খিদায়, বললাম না ওদের খিদাটা খুব বেশি, আফটার অল রাষ্ট্র আর পুঁজিবাদ যুগে যুগে ওদের অভুক্ত রেখেছে যে। জয় শ্রীরাম আর জয় বাংলা কি সুন্দর একসাথে কাল বসিরহাটের মাঠে দুহাজারি চুক্তি করে উড়ে গেল বার্ডম্যান মাইকেল কিটনের মত, আর কোনো বিবাদ রইলোই না। কিন্তু ওদের কাছে টাকাটা পৌঁছবে তো??? স্বেচ্ছাসেবী দলেরাও কোমর বাঁধছে, কতটুকু ই বা খেমতা? এক দু প্যাকেট দুধ, দু এক কেজি চাল, আধসের ডাল, অল্পস্বল্প চিড়ে মুড়ি গুড়, এক প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিন, দু লিটার জল??? এনাফ না বাসা উড়ে গেলে??? ঐ ঠিক যেমন শ্মশান থেকে আপনি প্রিয়জন পুড়িয়ে এলে কমন কথা শুনবেন- ” সবাইকেই একদিন যেতে হবে, কেউ আগে কেউ পরে”…
এরপরও বলা হবে, এগিয়ে বাংলা, তাই পারবে বাংলা, ছেঁদো দৃষ্টান্তে নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ, রায়বাবু, অভিজিৎ অমর্ত্য তো আছেনই, আছেন সৌরভের জামা উড়ানো থেকে কদম কদম বড়ায়ে যা । আর তাছাড়াও এখন এত অগুনতি কবিরা আছেন যে, গুটিকতক একাদেমিজয়ী পদ্য তো আসবেই বস, এটাই এক্সপেক্টেড। এই অবস্থায় যারা পদ্যে “সেভ বাংলা”র হ্যাশট্যাগ মেরে সেফ গেম খেলেন, তাদের জন্য হারপিকও যথেষ্ট নয় আমার বাথরুমে।
হ্যাঁ বাংলা পেরেছে, ছিয়াত্তরে, আয়লা, ফনি, বন্যায়, এবারেও পারবে কিন্তু আমার আপনার অবদান??? আসল বাংলা তো মাঠে, আপনার আমার কফি হাউসে, একাডেমিতে নয়, পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত বেগুনকদরের মত গ্রাম হয়ে সেই গোসাবা, কাকদ্বীপ, গঙ্গাসাগর থেকে শুরু করে এই উত্তরের হবিবপুর, বিন্দোল থেকে চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে রিয়েল বাংলা। কাঠি লজেন্স চুষতে চুষতে ফাটা টায়ারকে লাঠি দিয়ে দৌঁড় করানো বাচ্চাটার বাংলা, আসল বাংলা আমার আপনার ‘বাংলা টা ঠিক আসেনা’ বলা টেন পয়েন্ট এর ইঁদুরদৌড় এর উডবি অ্যাসপায়ারিং ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার এর নয়, আসল বাংলা প্রথম পিরিয়ড থেকেই জানালা দিয়ে মিড ডে মিলের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকানো অভুক্ত বাচ্চাটার, যে শুধু একটাই স্বপ্ন দেখে- “আজকে কী ডিম দিবে দিদিভাই”??? ওদের ভাতটুকুও জুটছে না হয়তোবা কতদিন, আমরা ওদের পড়া নিয়ে চিন্তিত, ওদের খিদা নিয়ে নয়। রাষ্ট্রের গায়ে ফোস্কা পড়বে যে… লকডাউনের পর আমফানে ওদের বইগুলো ভিজেছে, স্কুল থেকে দেওয়া শেষ সম্বল জামাটাও। দাঁড়িয়ে আছে ওরা বাংলা মেখে মাঠের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে, ভাতের জন্য আসলে এইরকমই দৃষ্টিটা শূন্য হয়, আমরা ভাত গল্পেও পড়াই তো রোজ। ওদের চোখে জল আর আসেনা, আপনার আমার আসে নেটের অভাবে। এভাবেই যদি লাঠি দিয়ে ঘর মুছে, আর লকডাউনে বসা বরকে দিয়ে বাসন ধোয়াতে পারেন আজীবন তবে বলার কিছুই নেই, যদি না পারা যায়, তবে আবারো বনগাঁ লোকাল চালু হবে কিন্তু, ওরা আবারো আমার আপনার বাড়িতে আসবে, তার আগে মরা জমিতে চলুন লাঙল দিয়ে ভিজিয়ে আসি একটু, এই মাসে নেটটা নাহয় পার ডে দুজিবি নাইবা ভরলাম। নাহয় সিগারেট টা একটু কমই খেলেন।
মনে আছে, ড্রেসিংটেবিলে রাখা লিপস্টিক গুলোর দিকে আফসানা বা সীমার ঘর ঝাড় দিয়ে এসে তাকানো সেই তৃষ্ণার্ত চোখদুটো। এবার কিন্তু চোখে আগুন কেননা পেটে যে বড্ডো দাবানল, তার আগেই আমরা কী সবাই মিলে আয় আরো বেঁধে বেঁধে আবারো বাংলা গড়তে পারিনা? রুদ্ধশ্বাসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে ফেলুদা, শঙ্কু, বোমক্যেশ, মিতিন মাসীরাও সবাই। মহানায়কও স্বভাব সুলভ ক্যারিশমায় সিগারেট টা টেনে বলছেন সত্যজিতকে- বাঙালিই মহানায়ক, এই দেখো ঠিক কেমন পারবে কোমর ভাঙা অর্থনীতিটাকে আবার চাঙ্গা করতে। সবাই সবাইকে বাঁচাতে পারব না ঠিকই, তবে টিচার পিছু স্টুডেন্ট এর দায়িত্ব নিই, প্রকাশক কবি পিছু একজন বাইন্ডারের, ফিল্ম মেকার অভিনেতা রা একজন করে টেকনিশিয়ানের, সাংবাদিক একজন করে হকারের। ব্যবসায়ী একজন করে কর্মচারীর, আপনার গিন্নি মালতীর মার। প্রতিটি ইন্ডাস্ট্রি থেকে এগিয়ে আসুক একটু একটু টালমাটাল ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপে সবাই। শুধু কাঁকড়ার মতো জাতির টেনে নামানোটা একটু বন্ধ থাক নাহয় কটাদিন, নন বেঙ্গলীদের থেকে শিখি নাহয় কিছু, অনেক তো কেরল মুম্বাই আমেরিকার এর জন্য গলা ফাটালাম, এবার দুর্গাগুলোকে নাহয় একটু বাঁচাই সবাই মিলে।
জানি এবার আমায় ড্যাশ ড্যাশ —— বলে গাল দিচ্ছেন অনেকেই, অনেকেই বলছেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো — আর আপনি যে আমায় গাল দিয়ে উঠে গেলেন রান্নাঘরে বৌকে সাহায্য করতে, পারবেন তো অফিস থেকে সারা জীবন এভাবেই আগলাতে? যদি না হয় উত্তর, তবে আজই মালতীদের রক্ষার খেলায় নামুন, দুজনেই তো ওয়ার্কিং মশাই, ওরা না বাঁচলে আমার আপনার বাচ্চা টা থাকবে কার কাছে??? আসুন সবাই এখনই জোটবদ্ধ হয়ে বাংলা বাঁচাই। বাকসর্বস্ব, কবিসুলভ, ভেতো, তর্কে টেবিলে আমফান আনায় অভ্যস্ত জাতি নাহয় আবার পথে নামলাম ছোট্ট ছোট্ট জগন্নাথ গুলোকে বাঁচাতে। তারপর দাদা দিদি রাম রহিম করোনা মরোনা সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং নিয়ে কপচানো, ইলিশ চিংড়ি, এক্সকে নতুন প্রেমিকার কাছে বেশ্যা বানানো- এসব মননের দৈন্যের বোতলের ছিপি আবার খুলে বসবো নাহয়…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।