• Uncategorized
  • 0

গল্পে চন্দ্রাণী মিত্র

শতাব্দীর পথে

সকাল ঠিক হয়নি তখন। আকাশে কোথাও কোথাও একটু আলোর ছোঁয়া। ঘুমন্ত কলকাতা জেগে উঠছে তখন সবে একটু একটু করে! আমার গাড়িটা ঠিক স্টেশনের কাছে এসে থামলো। এক হাতে মোবাইল, অন্য হাতে সেই আমার বেশ পুরোনো ঢাউস ব্যাগ একটা। আমি প্রতিবারের মতো পেছন ফিরে হাওড়া ব্রিজকে দুচোখ ভরে দেখে পা বাড়াতে যাবো, কানে ভেসে এলো গুরু গম্ভীর স্বর … “কেমন আছেন…!”
পাশ থেকে কুলির চিৎকার, ট্রেনের স্টেশন ছাড়ার আওয়াজ আর ওই স্টিমারের শত সহস্র শব্দ ভেদ করে ঠিক বুকের কাছটায় এসে আছড়ে পড়লো সেই ছটা শব্দ …. কেমন আছেন! কত উদাস করা দিনে, কত বিষণ্ণ সন্ধ্যায় আমি তো বারবার শুনতে চেয়েছি ওই কিছু অক্ষরে বোনা কিছু সম্বোধন …
কেমন আছি! আমি কি ছাই জানি তা! তাই ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক বিস্ময়ে দুচোখ সেই কাঁচের ভেতরে দুটো চোখে রেখে প্রশ্ন করলাম … “আপনি কেমন আছেন!”
আরো একটু কাছে সরে এসে বললেন, “ব্যাগটা তো বড্ড ভারী, কি কি ভরেছেন!”
উঁকি মারা গীতবিতান আর আমার সাদা কালো ডায়রী আগেই দেখে নিয়েছিলেন হয়তো! আমি কিছু না বলে এগোতে যাবো, ব্যাগটা পরম যত্নে নিয়ে নিলেন আর অদ্ভুত ভাবে বললেন, “ব্যাগ নিয়ে পালাবো না …. পালালে অন্য কিছু নিয়ে ভাববো”
মাথা নিচু করে ধীর পায়ে অনুসরণ করলাম অগত্যা। দশ নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম দুজনেই, হাতের ব্যাগ নেবার সময় হালকা ছোঁয়া পেলাম যেন, বুঝলাম অনিচ্ছাকৃত, তবু চমকে দেখলাম একবার। সেই কাঁচের ভেতরে দুটো চোখ একভাবে আমার চোখের মণি ভেদ করে কিছু যেন বুঝে নিতে চাইছে।
মাথা নিচু করে পা বাড়ালাম ব্যাগ নিয়ে। নিজের মনের ভেতরে সেই সদ্য দেখে আসা আরব সাগরের শত সহস্র ঢেউ আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে জানি, কিন্তু আমি তো কবেই শান্ত হয়ে গেছি! জানি তো কেউ নেই কোথাও …. তবু কেন ভাসি প্রতিনিয়ত কে জানে! ধীর পায়ে উঠে এসে জানলার ধারে এসে বসে পড়লাম! চোখ বাইরে, প্রতিবারের মতোই উদাস কেমন যেন ঘর ছাড়ার দুঃখ। অথচ পিছুটান সত্যিই তো কিছু নেই আমার! শ্রান্ত ক্লান্ত মনে দখিনা বাতাসের সেই উদ্দাম ছোঁয়া ভুলে তো গেছি আমি। তবু আজ একটু অস্থির আমি কেন!
ল্যাপটপ খুলে নিজের অজান্তেই লিখতে শুরু করলাম, পাশে ধপ করে কেউ এসে বসে পড়লো। তাকালাম না, প্রয়োজন নেই বলে …. কিন্তু সেই মেঘের বুক চিরে ওই বিদ্যুতের ঝলকানি হলো আবার …
“কি ভাবছেন!”….
হাতের পাশে মোটা কালো ব্যান্ডের ঘড়ি পড়া একটা হাত দেখতে পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে বলে ফেললাম, “একি এবারেও আপনি আমার পাশে!” গোবেচারা মুখ করে বললেন, “আচ্ছা এতে আমার দোষ কোথায় বলুন তো! দুপ্রান্তে বসে দুজনে টিকিট কেটেছে …. সময় স্থান কাল পাত্র কিছুই কারো জানা নেই”
বাদ সাধলাম তখনই, “আহা স্থান কাল বুঝলাম, পাত্র তাও অজানা!”
হাসলেন একটু, বড্ড কম হাসেন যতটা জানি, বলে উঠলেন, “তা আমি তো একা মানুষ নিজের সব কিছু নিজেকেই করতে হয়। আর কারো সম্বন্ধে এমন ভুল ধারণা কি করে রাখি বলুন তো! কত অভাগা পথ চেয়ে বসে থাকে একটু কৃপাদৃষ্টির জন্য !”….
এবার সত্যি রেগে গেলাম। “কি ভেবেছেন আমাকে বলুন তো! একে তো জানা নেই শোনা নেই সেই কখন থেকে কি কি বলে চলেছেন! আমি অন্য সিটে যাচ্ছি … বসুন আপনি এখানে”….
উঠে দাঁড়ালেন নিজের সিট ছেড়ে আর একেবারে দুহাত জোড় করে বলে উঠলেন, “ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দিন এবারের মতো”
আমি হতচকিত …. আশেপাশের সবাই দেখছে আমাদের দিকে। আমি স্বাভাবিক হবার আপ্রাণ চেষ্টা করে বসে পড়লাম ওই সিটে আর মাথায় হাত রেখে ধীরে ধীরে বলে ফেললাম … “সত্যি বলুন তো কি চান আপনি!”
মনের ভুলেই হয়তো সেই কালো ব্যান্ডর ঘড়ি পড়া হাতটা আমার অনামিকাকে খুব ধীরে ছুঁয়ে বলে উঠলো … “আমি যে বন্ধু হতে চাই আপনার!”
হাত সরালাম না, থাকলো ওই হাতের পাশেই … শুধু ক্লান্ত দুটো চোখ ওই কাঁচের ভেতরে সেই চোখের মণি কোঠা ছুঁয়ে বললাম, “কিন্তু আমি যে আর হারাতে চাই না মরুভূমিতে। আমাকে ক্ষমা করতে পারেন না আপনি। এ জগতে এত সর্ব গুন সম্পন্না মেয়েদের ভিড়ে আপনি আমাকে ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পান নি, আমি মানতে চাই না। না কি কোন নতুন খেলা এ আপনার … সত্যি বলুন তো কি মনে আছে আপনার।”
একেবারে শান্ত হয়ে গেলেন দেখলাম। লাল জগের গরম জল দুটো সাদা কাপে ঢেলে টি ব্যাগ তাতে ডুবিয়ে হাতের সামনে নয় হাতেই ধরালেন আর বললেন, “খেয়ে নিন, ভাল লাগবে।”
চা শেষ করে জানলার কাঁচের বাইরে চোখ আমার! ওই দূরের গাছ কোথাও শিমুল পলাশের একটু ছোঁয়া। কোথাও শুধু সারি সারি গাছ। আকাশের সাথে, বাতাসের সাথে কথা বলা সারাদিন। কি সুখে আছে ওরা …. এমন জীবন আমি যদি পেতাম।
ধ্যান ভঙ্গ হলো আবার … পাশে বসা সেই অবুঝ অস্তিত্ব নিজেও ডুবে ছিল কি সে কি জানি। কৌতূহল কিছুতেই নেই আর প্রশ্ন করি নি কাউকে কখনও। নিজের কথা উজাড় করে বলেছি কতবার … প্রতিদানে কিছু পাই নি! অভ্যেস হয়ে তো গেছিল আমার।
কিন্তু গতবারের আগের বার শতাব্দীতেই আমাকে অবাক করে সব কথা নিজের বলে দিয়েছিল কেউ। তার ঘর সংসার আর তার ছোট্ট মেয়ে তানিয়ার কথা। বলতে বলতে নানান ভাবের উতার চড়াব দেখেছিলাম সেই মুখে। জ্বলজ্বলে চোখ দুটো বারে বারে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছিল আর ঘোর কাটিয়ে এক প্রেমিক, এক জীবন সাথী আর বাবা আমাকে শুনিয়েছিলেন তার জীবনের বিবর্ণ মলাটের ভেতরের সেই রঙচঙে কিছু পাতার কথা।
প্রতিটি দিন মাস বছরের কথা নয় … পলাশের রঙে রাঙ্গানো ক্যানভাসের সেই কিছু আঁকা ছবি। যা আজও কথা বলে অরুণাভ নামে ওই একটা মানুষের সাথে।
তার ব্যস্ত জীবনে আর কেউ ছায়া ফেলেনি কোনদিন …ওই না কি আমায় ছাড়া। জানতে চাই নি তাও স্বভাবের বিরুদ্ধে কী জানি আমার ঠোঁট দুটো কখন যেন কথা বলে উঠেছিল …. বলেছিলাম “কোথায় তারা এখন!! আর আপনি হঠাৎ ছায়ার পেছনে দৌড়োচ্ছেন কেন …. “
উত্তরে যা বলেছিলেন তার পুরোটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি। শুধু বুঝেছিলাম যে কোথাও যেন সুর তাল কেটে গেছে কোন জীবনের গানের।
সেই দীর্ঘ চার ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের সফরে শুনেছিলাম তার কথা, অথচ একটিবারের জন্যও জানতে চান নি তিনি আমার কোন কথা। এভাবে এক দুবার নয় বেশ পাঁচ ছ বার দেখা হলো ওনার সাথে। গত বারেই একটু অস্থির মনে হলো যেন।
চুপচাপ বসেছিলেন অনেকক্ষন আর নামার আগে আমাকে অদ্ভুত ভাবে বলেছিলেন, “সত্যি বলুন তো আপনি কি দিয়ে তৈরী!”
সে তো আমি নিজেও জানি না, বললাম না কিছু। চুপ ছিলাম আর জানলার বাইরে দেখেছিলাম সেদিন।
কিন্তু এবারে কেমন যেন একটু আলাদা মনে হলো।
সি সেভেন এ ওই বড় টেবিলের দুদিকে দুজনে বসেছিলাম জানলার ধারে। একবার দেখেও দেখলেন না দেখলাম। আমিও চুপ করে খবরের কাগজে মন দিলাম। দুর্গাপুরে পাশের সিটটা খালি হয়ে গেলো। এসে বসলেন কিন্তু চুপচাপ। আমি যথারীতি জানলার বাইরে চোখ রেখে কিছু দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। হালকা স্বরে ভেসে এলো কানে দুটো কথা .. ..”নামটাও জানি না, তাই সম্বোধন কি বলে করবো ভাবছি …”
ফিরে দেখলাম আর একটু হেসে বললাম, “নিজের সব কথা একজনকে বলে দিয়েছেন অথচ তার নাম কোনদিন জিজ্ঞেস করেন নি, এমনটা আমি কোথাও শুনি নি হয়তো !”
খুব অবাক হয়ে দেখলেন আর সেই সাদা ঝক ঝকে কাঁচের ভেতরে বসা ওই জ্বল জ্বলে চোখ দুটো যেন হাজার তারার আলোর ঝিকিমিকিতে ভরে গেলো। বললেন …”এত সাহস পাই নি যে ….”
মনের ভেতরে যে উথাল পাথালি ঢেউ আছড়ে পড়ছে তা তো বুঝতে দেওয়া যাবে না, তাহলে আমি কি করি! মন ছুটে যেতে চাইছে কারো কাছে … নাঃ আমি পারবো না। সিট ছেড়ে উঠে বেরোতে যাবো বলে উঠলেন, “কোথায় যাচ্ছেন উত্তর আমি পেয়ে গেছি। আর বিব্রত করবো না কোনদিন। বসুন আপনি নিজের সিটে আমি যাচ্ছি।”
উঠে চলে গেলেন নিজের সিটে। আর গন্তব্য আসার আগে অবধি ফিরে দেখলেন না আর। কিছুক্ষন পরেই স্টেশন আসার ঘোষণা হলো। কখন যেন উঠে চলে গেছেন দেখলাম। দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। গাড়িটা স্টেশন ছুঁই ছুঁই করছে। পাশে গম্ভীর গলা শুনলাম নামার আগে …… “নাম জানতে চাই না শুধু বলুন আর এই ট্রেনে আসবেন না হয়তো তাই না! ফোন নম্বরও নেই আমার কাছে। কি করে খুঁজবো আপনাকে!” আকুল দুটো চোখ কাঁচের ভেতরে অথচ আমার চোখের কত কাছে।
হাসলাম এবার …বললাম, “আসবো এই ট্রেনেই বারবার। থাকি না নামহীন বন্ধুত্বের বন্ধনে। সম্পর্ক হাওয়ায় ভেসে আসুক বারবার আমাদের কাছে … যেদিন মনের গভীরে দাগ কেটে আর ফিরে যাবে না তারা সেদিন নাম বলে দেবো অরুণাভ ! তুমি অপেক্ষা করবে এই সাদামাটা এক মেয়ের জন্য …! শতাব্দীর ওই কোন এক রিজার্ভেশন চার্টে পাশাপাশি নাম লেখা অবধি অপেক্ষা করবো আমরা দুজনে …কথা দিলাম এবার নিরাশ করবো না তোমাকে”
আপনি থেকে তুমি হয়ে যাওয়া অরুণাভর সাথে আর দেখা হয়নি আমার। আসলে দোষ আমাদের দুজনেরই নয়। ওই ওপরে বসা একজন রিজার্ভেশন চার্ট বানাবার সময় ঠিক যাকে নামের পাশে বসিয়ে দেন তার সাথে হয়তো জীবনের গাড়ি চলে না ঠিক করে, হাঁফিয়ে উঠে বারবার আমরা সিট বদলে ফেলতে চাই। কখনো পারি কখনো পারি না।
যে পারে সে পছন্দের সাথীর সাথে এগিয়ে যায় দূরের পথে আর কোথাও কোন অরুণাভ আমার মতো নাম না জানা কাউকে বন্ধু ভেবে এগিয়ে আসতে চায় ওই হয়তো কিছু পথ পিয়ানোর সুরের মাঝে কাটাবে বলে … জীবন চলে যায় সংকোচ আর অভিমানের হাত ধরে। শতাব্দী পরে হয়তো কোন এক নতুন শতাব্দীতে দেখা হবে আমাদের … আর ভুল করবো না আমি, ভেবে নিলাম মনে মনে। ট্রেনটা ছেড়ে চলে গেলো পাশ দিয়ে।
জানলার কাঁচের ভেতর থেকে জানি দুটো জ্বলজ্বলে হীরে দেখছে আমায়। একবার …. আস্তে করে হাত নেড়ে আমি চলে গেলাম …
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।