উনিশ বছরের এক কিশোর কবি “নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা” নামক এক লেখা লিখে ইউরোপের ধর্মান্ধ সংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মগুরুদের কাছে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। নাম তাঁর পারসি বিসি শেলী। নব্য চিন্তাবিদ এই কবি প্রাচীণ অন্তঃসারশূন্য চেতনার জাল ছিঁড়ে হয়ে উঠেছিলেন চির বিপ্লবী সত্ত্বা এক। লিখেছিলেন “Promethus Unbound”. মিথোলজির আখ্যান থেকে প্রমিউথাসকে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর অমর কাব্যে। কে এই প্রমিউথাস? যারা গ্রীক পুরাণ একটু আধটু পড়েছেন তাঁরা প্রমিউথাসের আগুন চুরির গল্পটি জানেন। আর যারা জানেন না তাদের বলে রাখি, প্রমিউথাস ছিলেন গ্রীক দেবতা টাইটানের দ্বিতীয় পুত্র। দেবরাজ জিউস ছিলেন দূরসম্পর্কের আরেক ভাই। দেবরাজ জিউসের মনে মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছিল অপরিসীম। এক অনুষ্ঠানে দেবতা কে উৎসর্গ করে এক ষাড় হত্যা করা হয়েছিল, সেটা ভাগ হয়েছিল জিউস আর প্রমিথিউসের মধ্যে। কিন্তু জিউসের ভাগ্যে মাংস কম পড়ে, তাঁর ক্রোধ গিয়ে পড়ে প্রমিউথাস আর মানুষের ওপর। তখন রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে জিউস মানুষের থেকে আগুনের অধিকার ছিনিয়ে নেন। আগুনের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সমগ্র মানবকূল বিপদের মুখে পড়ে। ঠিক এসময় মানবদরদী প্রমিউথাস অলিম্পাস পাহাড়ের পেছনে লুকানো সূর্যচক্র থেকে আগুন চুরি করে মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচান। এতে ক্রোধ আরও বেড়ে যায় জিউসের। তিনি তখন ককেশীয় পাহাড়ে এক স্তম্ভের সাথে শেকল বেঁধে প্রমিউথাস কে আমৃত্যু শাস্তি দেন। কিন্তু এ শাস্তি ধোপে টেকেনি সে পরের কথা….কিন্তু এটাই মূল গপ্পো।
প্রমিউথাস কে??বুদ্ধি ও যুক্তিনির্ভর মননের সাহায্যে যে বারবার সমস্ত অন্ধ সংস্কারাচ্ছন্ন অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলে মানুষকে নতুন পথের নির্দেশ দেয়,সেই প্রমিউথাস। প্রতীকী হতে পারে, কিন্তু এর বাস্তবসন্মত অবয়ব কী সাংঘাতিক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে পারে যুগ যুগ ধরে সাক্ষী থেকেছে মানব সভ্যতা। অ্যারিস্টকার্স, অ্যানাক্সাগোরাস,গ্যালিলিও থেকে ভারতবর্ষের রাজা রামমোহন, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর…মূর্তিমান প্রমিউথাস….
এমনই একজন ছিলেন জিয়াদার্ণো ব্রুনো। পাগলাটে বেপরোয়া অনুসন্ধিৎসু। স্বভাবতই লাগামছাড়া অনুসন্ধিৎসা সনাতনী ব্যবস্থার আপত্তির কারণ হয়ে ওঠে।তার নেপথ্যে ছিলেন এক ইতালীয় বিজ্ঞানী। যিনি জীবন সায়াহ্নে এসে ইউরোপের সংকীর্ণ মনা ধর্মযাজকদের চিরন্তন বিশ্বাসে সজোরে আঘাত করলেন প্রকাশিত “দ্য রিভোলিউশনিবাস” গ্রন্থে। দূর্বোধ্য গানিতিক সমীকরণে প্রমান করে লিখলেন পৃথিবী নিশ্চল নয়। বরং পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। ব্যস!এরপরে কি হল তা সবারই জানা। বিজ্ঞানীর নাম ছিল কোপারনিকাস। বইটি নিষিদ্ধ হল। কয়েকটি গ্রন্থাগারে বইটির দাহকাজ সম্পূর্ণ হল। কোপারনিকাস কি উন্মাদ?? পৃথিবীর শুরু থেকেই মানুষ রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিশ্বাস করে এসেছে যে পৃথিবী স্থির। সৌরমন্ডলের কেন্দ্রে একবারে গেঁড়ে বসে আছি আমরা। নো নড়নচড়ন। যেখানে অ্যারিষ্টটল বলে গেছেন পৃথিবী ঘোরেনা,সূর্য ঘোরে। সেখানে কোথাকার কোন কোপারনিকাস উড়ে এসে জুড়ে বসে অঙ্ক কষে পৃথিবীকে ঘোরাচ্ছে?? সেদিন থেকেই বিজ্ঞান আর ধর্মের রাস্তাটা পৃথক হয়ে গেল হয়ত। কথা হচ্ছে, বইটি এসে পড়ল পাগলা ছেলেটির হাতে। প্রায় চারশো বছর আগের কথা, ব্রুনো শুধুই যে বইটি পড়লেন তা নয়, বইটিতে প্রকাশিত সমস্ত তথ্য সত্যনির্ভর কিনা তা জানতে দিনরাত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। যা আধুনিক বিজ্ঞান বহুপরে করেছে,কিন্তু চারশো বছর আগে ব্রুনো খালি চোখে কিছু সত্যের উদঘাটন করেছিলেন। যেমন, পৃথিবী সহ বেশ কিছু গ্রহ ঘোরে,তাদের পৃথক কক্ষপথ রয়েছে ইত্যাদি…. চার্চের কোপে পড়তে হল তাঁকে। সন্ন্যাসী বেশে যুবক ব্রুনো পালিয়েছিলেন দেশ থেকে। ভেনিসে এসে ঘরে ঘরে, দোকানে দোকানে,রাস্তাঘাটে প্রচার করতে লাগলেন সৌরজগতের সত্যতা। হিংস্র হয়ে উঠলেন ধর্মযাজকরা। ব্রুনো বন্দী হলেন। অকথ্য অত্যাচারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হল তাঁকে। তারপর আদেশ এল আগুনে পুড়িয়ে মারতে হবে ব্রুনোকে। ভস্ম হল ব্রুনোর দেহ। সমবেত সে জনতা এমন নারকীয় হত্যালীলা দেখতে দেখতে জিসাসের জয়গান করছিলেন শোনা যায়!ভাবুন!
ইতিহাসে যখনই বিজ্ঞান বা বস্তুবাদী মন কোনও সত্যের প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়েছে তখনই বহু দিনের পূঞ্জীভূত ধর্মান্ধতা, সংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাস তার টুঁটি চেপে ধরেছে।সাধারন মানুষের চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করবে একমাত্র ঈশ্বর এবং তাঁর অনুচরেরা।শুধু মধ্যযুগীয় ইউরোপ নয়, আমাদের দেশকেও ধর্মান্ধতার পোটেনশিয়াল আখড়া বলা যায়। খ্রীষ্ঠপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কথা, ভারতবর্ষের সযত্নে লালিত ভাববাদী আধ্যাত্মিক মহল তছনছ করে দিয়েছিল এক নতুন দর্শন। বাহ্যস্পর্শ দর্শন বা চার্বাক দর্শন। কোনও প্রামান্য নথি পাওয়া যায় না বলে এর সঠিক প্রবর্তণ কাল বা প্রবক্তার নাম জানা যায় না। তবে এটুকু জানা যায় যে আড়াই হাজার বছর আগে এই লোকায়ত দর্শনটি বৈদিক ভাববাদী সমাজের চিন্তাভাবনা এঁফোড়ওফোড় করে দিয়েছিল। চূড়ান্ত বস্তুবাদ কে হাতিয়ার করে চার্বাক যখন বলে ওঠেন ঈশ্বর বলে কিছু হয় না, নিবৃত্তি বলে কিছু নেই, পাপ পূন্য সব বাজে কথা, পরজন্ম ভাঁওতা ছাড়া কিসসু নয়,তখন স্বাভাবিক ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মভীরু চরাণামৃত সেবনকারীরা সব কিছু ভুলে এই বিরুদ্ধ মতবাদের বিনাশ চাইবেন। হলও ঠিক তাই। সমস্ত পুঁথি, নথি,কাগজ পুড়িয়ে ফেলা হল, বিষ্ণুপুরাণে এদের অস্পৃশ্য বলা হয়,কখনও বলা হয় চার্বাক পন্থীরা ঈশ্বরের অভিশাপ।কিন্তু মজার ব্যপার হল এত কিছু করেও এই দর্শনকে আটকানো যায় নি। আজও তার প্রভাব রয়ে গেছে। মতবাদ কে হত্যা করা যায় না।
এ বারংবার প্রমানিত যে যুক্তিনির্ভর সত্য আর অন্তঃসারশূন্য সংস্কার যতবারই মুখোমুখি মোকাবিলা করেছে ততবারই অন্ধ সংস্কার তাঁর মিথ্যে অহং আর মেরুদন্ডহীন অনুচর দের জুটিয়ে প্রচন্ড আক্রমনাত্মক ভাবে ছুটে গেছে বিপরীত দিকে। এ খুব স্বাভাবিক,খেয়াল করবেন যে রাস্তায় দুজন লোক তর্ক করলে সেই লোকটিই বেশী আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠে যার কাছে কোনও লজিকাল ব্যাখ্যা নেই। সেই লজিক শূন্যতা ঢাকতেই গলার জোরটা বাড়াতে হয় কখনও বা পেশীর জোর….যেকোনও মতবাদের একটা সার্বিক আবেদন থাকে,যা আপেক্ষিক সত্য,তার পরিসর কেবল “ঋণংকৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ” য়ের মধ্যে সীমিত থাকতে পারেনা। সে দর্শন বা ভাবধারাকে শুরুতেই দমন না করে যুক্তি দিয়ে যাচাই করাটা বুদ্ধিমান শ্রেণীর কাজ। আদি সত্যের খোঁজ সেই প্রাচীন দর্শনেই লুকিয়ে থাকে, এ তো প্রমানিত। আমরা যাদের সোশ্যাল রিফরমার বলি তাঁরা চিরকালই নিজের বিশ্বাসের ওপর অকুন্ঠ সন্মান রেখে সমাজের স্বার্থে সমাজের বিরুদ্ধে যান। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ মানুষের বহুদিনের চিন্তাভাবনার আঙ্গিক বদলানো। সেটা তাঁরা পারেন জন্যই তাঁরা একেকজন প্রমিউথাস। আর প্রমিউথাসের মৃত্যু নেই।