সুমিতাদি, ছিপছিপে লম্বা গড়ন উজ্জ্বল শ্যাম বর্না ঝকঝকে কথা বার্তার মানুষটির সাথে আলাপ হলো মাস নয়েক আগে । কলিগ হিসেবে প্রথমেই সকলের মন কাড়তে পারে নি সুমিতাদি। প্রথম প্রথম চুপচাপ বসে থাকতো। কি যেন দেখতো সকলের চোখে মুখে। বেশ কিছু এই ভাবেই চলার পর আর এক সহকর্মী মলিনাদি সুমিতাদিকে বললো, তোমার কাজটা কি বলোতো আমাদেরকে অব্জার্ভ করা নাকি অফিশিয়াল কাজকর্ম কিছু করা?
সুমিতাদির চোখে মুখে একটা বিরক্তি ফুটে উঠলো। বললো , আমি একটু বুঝে নিতে চাইছি। ঠিক সময় শুরু করবো। উত্তর টা ঠিক পছন্দ হলো না মলিনাদির। যথারীতি নালিশ গেলো ম্যানেজারের ঘরে। ম্যানেজার সাহেব সুমিতাদিকে ডেকে বেশ দুচার কড়া কথা শুনিয়ে দিলো। সুমিতাদির পাতলা পাতলা ঠোঁট গুলো চেপে এমন ভাবে তাকাতো, আমাদের কেমন অস্বস্তি হতো। যাই হোক, এই ভাবেই চলতে চলতে সুমিতাদির সাথে আমাদের বেশ ভাব হয়ে গেলো। কাজে কর্মে কথায় বার্তায় বুঝতে পারলাম আমাদের অফিশিয়াল কাজকর্ম সম্বন্ধে সুমিতাদি বেশ ওয়াকিবহাল। দায়িত্ব পরায়ন একজন সহকর্মী পেয়ে বেশ সন্তুষ্টি এলো সকলের মনে।
অফিসে ঢোকার কিছুদিন পরেই মলিনাদির সাথে ওর মনোমালিন্য হওয়া টা সুমিতাদি ভালোভাবে নেয় নি ভোলে ও নি। মলিনাদি হঠাৎ খুব অসুস্থ হলো। অফিসে আসছে না এক সপ্তাহ হয়ে গেলো। আমরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকলেও অবসরেই মলিনাদিকে মিস করছি।
লাঞ্চ টাইম, সবাই বসে খাচ্ছি আর মলিনাদির কথা বলাবলি করছি। হঠাৎ সুমিতাদি বললো, মলিনাদির সেরে উঠতে আরো এক সপ্তাহ লাগবে।
আমরা এ ওর মুখের দিকে চাইছি, ও কি করে জানলো! তুমি দেখতে গেছিলে সুমিতাদি?
সুমিতাদির খুব সাধারণ একটা মোবাইল ফোন। রূপা নম্বরটা নিয়ে রাখলো।
রাত নটা সাড়ে নটায় রূপা সুমিতাদিকে ফোন করলো।
হ্যালো, সুমিতাদি শোনো না তোমার সময় আছে? আমি একটু কথা বলবো.।
হ্যাঁ হ্যাঁ বলো আমি সবেই রান্না সেরেছি। খেতে খেতে আরো এক থেকে দেড় ঘন্টা বাকি।
তুমি যে লাঞ্চ টাইমে বললে তুমি অনেক কিছু বুঝতে পারো বিষয়টা যদি একটু বলো। আমি খুব ইন্টারেস্টেড।
রূপা শুনতে পারছে সুমিতাদির কাছাকাছি একটা কুকুর খুব জোরে ডেকে উঠলো। সুমিতাদি ও কে বেটা বেটা বলে চুপ করতে বলছে। কিন্তু কুকুরটা খুব অস্থির হয়ে চিৎকার করছে।
সুমিতাদি তোমার বাড়িতে কুকুর আছে? উফ কি জোরে জোরে ডাকছে গো। কিছু শুনতে পারছি না।
যা মনে হচ্ছে রূপা ও এখন আমাকে কথা বলতে দেবে না। আমি কাল অফিসে তোমার সাথে কথা বলবো। রূপার মনকে খুঁতখুঁত করলেও অগত্যা।
পরের দিন কাজের চাপে আর কথা বলা হয় নি ওদের।
আরও দুদিন পরে। আজ সানডে আজ সুমিতাদিকে ফোন করে জানতেই হচ্ছে ব্যাপারটা কি।
বিকেল সাড়ে চারটেয় রূপা সুমিতাদিকে ফোন করলো।
এখন কথা বলতে পারবে?
হ্যাঁ বলো, ও আচ্ছা সেই বিষয়টা? তা তুমি ঠিক টাইমেই ফোন করেছো। আমার কর্তা কুকুরটাকে নিয়ে বাইরে গেছে। আগের দিন যা অস্থির করছিলো তোমার সাথে কথাই হলো না। আসলে কি জানো তো তোমরা আজকালকার মেয়ে অনেক কিছু বিশ্বাস করো না। আমি কিন্তু শুভ অশুভ অনেক কিছু দেখতে পাই।
সে আবার কি, কেমন শুনি বলোতো একটু।
তোমরা অনেক কিছু দেখতে পাও না আমি পাই, আমি বুঝতে পারি কোনো খারাপ ঘটনার আগের মুহূর্ত গুলো। সেই জন্যে আমি ছেলেকে ছোট থেকে হোস্টেলে রেখেছি। আমার কাছে খুব একটা আসতে দি না। ছুটিতে আসে আমার কাছে। থাকে দুএকদিন। তারপর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিই।
তুমি সেদিন কুকুরটাকে বেটা বলে ডাকছিলে কেনো? সামান্য একটা কুকুর।
না রূপা ও সামান্য কুকুর নয়। ও আমার আগের জন্মের ছেলে। গত জন্মে রোড এক্সিডেন্টে যে রাস্তায় ও স্পট ডেট হয়েছিল এ জন্মে আমি ওকে ওখানেই রাসবিহারীর রাস্তায় খুঁজে পেয়েছি। তা প্রায় ছয় বছর হয়ে গেল। দেখে ঠিক চিনতে পেরেছি। তারপর থেকে এক মুহূর্ত কাছ ছাড়া করি নি।
কি যাতা বলছো সুমিতা দি? মাথা খারাপ নাকি তোমার?
ওই যে তোমরা অনেক কিছু বিশ্বাস করো না। আগের দিন হয়তো এ কথা গুলো আসবে জেনেই বেটা এতো চেঁচামেচি করছিলো। যাতে আমি এসব কথা তোমায় না বলতে পারি।
রূপা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ও আচ্ছা তাহলে এখন আমিও ফোন রাখি। কখন আবার তোমার বেটা এসে চ্যাঁচামেচি শুরু করবে।
আচ্ছা ভাই পরে কথা হবে।
আস্তে আস্তে আমরা সবাই বুঝতে পারলাম সুমিতাদির মধ্যে কিছু একটা তো আছেই।
সেদিন এক আশ্চর্য ঘটনা শুনে তো আমরা সবাই হতবাক। সকাল বেলা এক এক করে সবাই অফিসে ঢুকছি। রেজিস্টার খাতায় সই করে আমি দেখে নিচ্ছি পেনের কালিটা ঠিকঠাক চলছে কি না.,.
রমা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল কাল রাতে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেছে। সুমিতাদিকে কুকুরটা কামড়ে ফালাফালা করে দিয়েছে।
সে কি! কুকুর? কোথাকার কুকুর? আঁতকে উঠলাম।
কাল রাত ৮.২০ নাগাদ সুমিতা দি ফোন করে রমাকে জানায় এখুনি একবার ওদের বাড়ি যাবার জন্য। ওর হাসবেন্ডে আজ রাতে ফিরবেন না। এদিকে কুকুরটা সুমিতাদিকে বিভিন্নভাবে কামড়ে ছিঁড়ে দিয়েছে।
পোষা কুকুর এই ভাবে কামড়ালো কেনো এই রকম নানা প্রশ্ন চলতে থাকলো। রমা সুমিতাদিকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। রক্তে গেসে গেলেও সুমিতাদির মুখে কোনো যন্ত্রণার ছাপ নেই। Intra darma injection গুলো ক্ষতের চারপাশে দেওয়ার সময় ও যেনো একটুখানি যন্ত্রণা ও হচ্ছে না। নিজের মনে জোরে জোরে কুকুরটাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।
সান্ত্বনা? আমি হলে তো ওকে লাঠি দিয়ে মেরেই ফেলতাম।। বাড়ির কুকুর এই ভাবে মালিককে কামড়াতে পারে এই প্রথম দেখলাম।
দিন পনেরো বাড়ি থাকা কালীন আমরা কেউ ই দেখতে যেতে পারি নি। ফোনেই কথা হয়েছে। তবে ওর গলায় কষ্টের কোনো ছাপ পাই নি।
ছুটিতে থাকা কালীন এক দিন বিকেলে রাস্তায় দেখা হলো আমার সাথে সুমিতাদির।
সুমিতাদি এদিকে কোথায় যাচ্ছো? পাতলা ঠোঁট গুলো চেপে হাসতে হাসতে বললো, এই তো কয়েকটা জিনিস কেনাকাটা করবো। খুব দরকার তাই বেরোতেই হলো।
কাটা জায়গায় বেশ বড়ো একটা ব্যান্ডেজ। হাতটা একটু ফুলেও আছে।
বললাম তোমার হাসবেন্ড আসতে পারতো। এই ভাবে তুমি কেনো?
না গো আসলে বিকেলে কুকুরটা কে নিয়ে না বেরোলে ও খুব অস্থির করে দেয়।
তুমি আর৷ এই কুকুরের জন্য ভেবো না তো৷ যত আদিখ্যেতা তোমার।
না গো ওমন করে বলো না। ও আমাকে কামড়াতে চায় নি। বেশ কিছু দিন ধরে আমি আমার চারপাশে এক জোড়া কালো পা দেখতে পাচ্ছিলাম। কোনো অশুভ ছায়া আমার ক্ষতি করতে চাইছিলো। জানি তোমরা এত সব বিশ্বাস করবে না। কিন্তু মাঝরাতে মশারীর বাইরে, রান্নাঘরে, বাথরুমে কেবলই আমার চার পাশে ঘুরছিলো। যে দিন রাতে আনার হাসবেন্ড বাইরে গেলো সে দিন সরাসরি আমার বুকের ওপর পা জোড়া তুলে দিয়েছিলো। তাই দেখে তো মেরা বেটা নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। ছায়াটাকে ভেবে আমাকে কামড়ে টুকরো করলো। কোন সন্তান চায় বলো মায়ের ক্ষতি হোক?
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথা গুলো শুনছিলাম। সুমিতাদি আসি বলে রাস্তার ওইপারে চলে গেলো