পরজীবি
তাঁদের লড়াই কতোখানি ফলপ্রসূ হ’য়েছিলো সে’কথা সময় ব’লেছে। মানুষ হিসাবে তাঁরা কেমন ছিলেন, তার আমরা কতোটুকুই বা জানি। তবু তাঁদের অনুসৃত আদর্শগুলির মধ্যে একটির কথা অকারণেই বারবার মনে পড়ে, “সস্তার আবেগ বিপ্লবের শত্রু”। আসলে নকশালবাড়ি আন্দোলনের যেখানে জন্ম দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বহুকাল ধ’রে এবং তার পরেও বেশ অনেকদিনই উত্তরবঙ্গের সেই তরাই অঞ্চলে ‘নৈতিক বৈষম্য’ বেশ তীব্রভাবে প্রকট ছিলো। সেই সময়ে দেশের বাকি অংশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে এখানকার মানুষজনের তেমন মাথাব্যাথা ছিলো কিনা তা সেভাবে জানা যায়না, কিন্তু একটি বিষয় শতকরা ১০০ভাগ নিশ্চিত, যে নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ, মালিক, ধনিক ইত্যাদিরা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী আর আপামর দরিদ্র মজুর, কৃষক, শ্রমিক এরা পূর্বোক্তের তুলনায় সম্পূর্ণ পৃথক। এরা কোনো দেশী-বিদেশী, বাদী-বিবাদী মতবাদ আলাদা ক’রে পড়েনি কিন্তু জীবন দিয়ে বুঝতো, যে পৃথিবীকে ২টি অংশে একেবারে খালি চোখেই ভেঙে দেওয়া যায়, ১। সংখ্যালঘু শোষক, ২। সংখ্যাগুরু শোষিত। শোষকের শক্তি হ’লো ‘ক্ষমতা’ আর শোষিতের শক্তি ‘একতা’।
নিজের জন্ম থেকে এই প্রেক্ষিতেই সমগ্র ভারতবর্ষের সংখ্যাধিক্যের দুঃখকষ্টকে চিনেছিলেন জনৈক গান্ধীবাদী শিক্ষকের পুত্র চারু মজুমদার। ভেবেছিলেন সারা ভারতবর্ষ… না শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবীতেই শ্রমজীবিরা (প্রোলেতারিয়েত) সংখ্যায় ও শারীরিক সক্ষমতায় বেশী হ’য়েও নিজেদের শক্তি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র অবগত নয় ব’লেই দিনের পর দিন তারা পরজীবিদের (বুর্জোঁয়া) দ্বারা নিপীড়িত হ’য়ে এসেছে। অতএব বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হ’লে সকল শোষিতরা অস্ত্র ধরো, এই ধনিক শ্রেণীকে সুযোগ ক’রে দেওয়া গণতন্ত্রকে ভেঙে গুঁড়িয়ে নিজেদের পৃথিবীতে সাম্যবাদ এনে দাও। এতোদিনের মার্ক্স-লেনিনবাদই আজ নিজের প্রয়োজনে মাওবাদ হ’য়ে উঠেছে। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘সশস্ত্র বিপ্লবের সপক্ষে ৮টি ঐতিহাসিক দলিল’ তিনি লিখেছিলেন এই মানসিকতা থেকেই।
এখন প্রশ্ন হ’লো, তারা প্রচুর কেড়েছে অতএব তাদের ‘মেরেধ’রে’ এই তথাকথিত-বৈষম্যের অপনয়ন ক’রে দিলেই যে বিপ্লব সম্পূর্ণ হ’লো এবং এই ঘটনার পরেও প্রাপ্ত সম্পদের বন্টন চিরকাল একই লিখিত নিয়ম মেনে হওয়া সম্ভব কিনা এ উত্তর ‘মার্ক্সীয় সাম্যবাদ’ হয় ব্যাখ্যা করেনি অথবা সেই ব্যাখ্যা একটি নির্দিষ্ট পক্ষের স্বার্থে চেপে যাওয়া হ’য়েছে। অতএব দিনের শেষে সমাধান এসে দাঁড়ায় এইখানে, যে কোনোভাবে যারা প্রচুর পরিমাণে ধনী হ’য়েছে (সেটিও একেকজনের ব্যক্তিগত প্রেক্ষিতে) তাদের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার কোনো অধিকারই নেই। অথচ সাম্যবাদ স্বয়ং ব’লছে সামগ্রিক অগ্রগতির গভীরতর চর্চা তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফলেরই পরিচায়ক। কিন্তু পেট খালি থাকলে ভবিষ্যতের সুদূরপ্রসারী ভাবনা (যেখানে কীর্তি একটি সম্পূর্ণ সময়কালের প্রতিনিধিত্ব করে) একজনের মাথা কতোখানি খাটে তা কারোরই অবিদিত নয়। অদ্ভুতভাবে মার্ক্সীয় সাম্যবাদ এইখানে প্রতিটি চিন্তাবিদকে সরাসরি ব’লছে যে সমাজের কোনো ‘বিশেষ’ পরিচায়ক উদ্ভাবনের চিন্তায় সে তাঁদের ‘ব’সিয়ে খাওয়াতে’ পারবেনা। তাঁরাও জনৈক শ্রমিকের তুলনায় বেশী কিচ্ছু নন এবং কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রযন্ত্রের তাঁরা একেকটি অংশমাত্র। এর বাইরে তাঁদের ব্যক্তিগত ব’লে কোনো অস্তিত্ব নেই। কেবল পরিচিত মুখ চিন্তাবিদরাই নন, এর বাইরেও আপাতদৃষ্টিতে কোনো মানুষ যদি কায়িক শ্রম না করে সুবিধাভোগী হিসাবে সে ব্যক্তি আসলে বৈষম্যকেই সমর্থন ক’রছে।
এতোদূর অবধি প’ড়লে খুব স্বাভাবিকভাবেই এই বক্তব্যকে সাম্যবাদের সমালোচনা ব’লে মনে হ’তে পারে, কিন্তু একটু যদি ভাবেন উপরোক্ত নীতির কিছু সুফলও অবশ্যই আছে। ভেবে দেখুন, সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রায় পৌনে দু’শো বছরের জারতন্ত্র অথবা ভারতের তরাই অঞ্চলে দীর্ঘকালব্যাপী বৈষম্য এতোই মারাত্মক ছিলো… সত্যি ব’লতে কী আমাদের আশেপাশেই কিছু ক্ষেত্রে তা এখনও এতোই মারাত্মক আছেও, যে মানুষ হিসাবে কিছু হিংসাত্মক নীতির আমরা অজান্তে সমর্থক হ’য়ে উঠি। একই বা কিছুক্ষেত্রে তুলনায় বেশী কাজ ক’রেও কেবল পরিচালকের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সহকর্মীটিকে নিজের দ্বিগুণ বেতন পেতে দেখলে মনে মনে বহুবার তার ও অন্নদাতার মৃত্যু কামনা ক’রি আমরা। প্রথম মারণরোগ নিয়ে শহরে ঢোকা ছেলেটিকে আমরা কুবাক্যে ভ’রিয়ে ফেলি সে মূলতঃ আমলাপুত্র ব’লে। রাগ এখানেই হয়, যে পয়সা থাকলে নিজের ছেলেটিকেও আমি আপনি অক্সফোর্ডে পাঠাতাম। তার অভিভাবকেরা পেরেছেন কারণ তাঁরাও সে ক্ষমতা লাভ ক’রেছেন, সে ন্যায়-অন্যায় যে পথেই হোক। আমাদের কাছে তা অন্যায়ই, কারণ আমরা তো বঞ্চিতেরই দলে। কিন্তু এইবারে প্রশ্ন হ’চ্ছে, যে আমার হাতে অর্থ থাকলে আমি কি আর পাঁচজনের জন্য ভাবতাম? উত্তর হ’চ্ছে, “না”। আমিও একমাত্র নিজের ছেলেকেই সমস্ত তুলে দিতাম। যখন তা পারছিনা, তাই ব’লে কি মনুষ্যত্ব ভুলে একটি ছেলের মৃত্যু চাওয়া উচিত? হ্যাঁ উচিত তো। কেন? কারণ, সে’ও যে আমার কথা ভাবেনি তা তো দেখাই যাচ্ছে। বৈষম্যের অপনয়নে সস্তার আবেগ মাত্রেই বিপ্লবের শত্রু।
চারুবাবু তরাইয়ের বিচারে পৃথিবী মাপতে গেছিলেন। জনৈক দক্ষ নেতা হিসাবে তিনি জানতেন, যে একশো বিপ্লবীতে (বা হন্তারকে) একটি লোকের ভেতরে উপরোক্ত টানাপোড়েন উদয় হবেই, হ’তে বাধ্য। তাই তিনি ‘আবেগ’ শব্দটির আগে বীজমন্ত্রের মতো একটি বিশেষণ ব’সিয়ে দিয়েছিলেন, সেটি হ’লো ‘সস্তা’। সত্যি ব’লতে কী এতে তাঁর ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থও ছিলোনা, তিনি সুসময় প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে একটি মনোভাবের উত্তরাধিকারকে বহন ক’রেছিলেন মাত্র। কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের পথে যে চিন্তাই বাধা হ’য়ে দাঁড়াকনা কেন, সে আবেগে বিপ্লবীর মনুষ্যত্ব ‘শূন্য’ ব’লে ধ’রে নেওয়া হয়। কেবল এই মনোবৃত্তি থেকে তিনি অজস্র তরুণের সাদা বাংলায় “মাথা খেয়েছেন”, চীনকে ভারতের আগে স্থান দিয়েছেন, সারা ভারতবর্ষের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বকে রক্তে স্নান ক’রিয়ে ফেলেছেন, সর্বোপরি পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সরকারটি চিরকালের মতো ফেলে দিয়েছেন।
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভারতীয় শাসনব্যবস্থার সমস্যা মূলতঃ ত্রিমুখী। ১। স্বাস্থ্য, ২। বর্তমান অর্থনীতি, ৩। ভবিষ্যৎ অর্থনীতি। এখানে জানিয়ে রাখি, স্বাস্থ্যের চিন্তা প্রত্যেকেরই থাকলেও বৈষম্যের প্রাথমিক পরিচায়ক কিন্তু ব্যক্তিবিশেষে তার প্রাধান্য। যার পেটের চিন্তা আছে, সে নিজের পরের যারই হোকনা কেন হাজার বিপদেও এই মুহূর্তে স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেবেনা কেবল নিজেকে সচল রাখতে। যার ‘আপাততঃ পেটের চিন্তা নেই’ সে আজ না হোক কাল বাজারে ভীড় ক’রবেই, তার আগে যতোটুকু পারে চেষ্টা ক’রবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে। যার পেটের মোটেই চিন্তা নেই, সে ঘরে থাকবে কেবল মৃত্যুভয়ে। ঠিক এইখানেই আসছে আসল বক্তব্য, ধনী হোক বা গরীব, একটি বিষয়ে তাদের ভেতরে কোনো বিভেদ নেই তার নাম ‘মৃত্যু’। প্রবাসী শ্রমিকদের ভীড় দেখে যাঁরা “মর মর” ক’রছেন উন্নাসিকতা তাঁদের ভেতর এই মুহূর্তে যথেষ্ট কম, বরঞ্চ অনেক বেশী ভয়ের অনুভূতি ‘এরা এখানে এলে কী হবে’ তাই ভেবে। যাঁরা এই আপাত-অমানুষগুলির নিন্দায় মুখর, তাঁরা কোনো মেডিক্যাল কলেজফেরত ছাত্রকে স্বেচ্ছায় স্বগৃহে স্থান দেবেন কিনা, জানবার ইচ্ছে র’ইলো। যাঁরা ভাবছেন, যে বাড়ি ব’সে শ্রমিকদের দুচ্ছাই করা আসলে পরজীবি মনস্তত্ত্বের প্রকাশ তাঁরা সম্ভবতঃ ‘মানসিক স্বাস্থ্য’ ব’লে কোনো তত্ত্বেরই নাম শোনেননি, শুনবেনই বা কী ক’রে, নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করা মানুষের চিন্তার ব্যপ্তি কতোটুকুই বা হবে আর? যে পেটের দায়ে ২বেলা দৌড়ে যাচ্ছে তার মাথা খাটাবারই তো সময় নেই। পর্দায় ২৪ ঘণ্টা শুধু কে কোথায় মারা গেলো, কে কোথায় আক্রান্ত হ’লো, কাল আমরা খাবো কী, কোথায় ভীড় হ’চ্ছে, সর্বোপরি প্রাণভয়ে গৃহবন্দী দশা, এর হাত থেকে বাঁচতে কেউ যদি শৈশবের ছবি গণমাধ্যমে দেওয়া নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন তা কোনোভাবেই অপরাধ হ’তে পারেনা। অপরাধ তো তখন হয়, যখন বোঝা যায়, যে আমাদের দ্বারা নির্বাচিত সরকার এমন পরিবেশ আদৌ তৈরী ক’রতে পারেননি, যাতে দেশী বা বিদেশী শিল্পপতিরা ভারতবর্ষে বিনিয়োগে উদ্যমী ও উদ্যোগী হন। ব্যর্থতা তখন দগদগে হ’য়ে ওঠে, যখন দেখা যায়, কয়েককোটি লোককে বাড়ি পৌঁছে দিতে তাঁরা এখনও অবধি ‘১৭টি’ বাসের ব্যবস্থা ক’রেছেন। এমন কোনো ভরসা তাঁরা দিতে পারেননি যাতে সামান্য বেশী বেতনের লোভে কেউ তার বাড়িঘর ছেড়ে প্রবাসী হ’তে বাধ্য না হন। তাঁরা ব’লতে পারেননি, যে এতোগুলি কর্মহীন দেশবাসীর জন্য তাঁরা ভবিষ্যতে কী পদক্ষেপ নিতে চ’লেছেন? শ্রমিকেরা জানেননা, তাঁরা এই মুহূর্তে একেকটি বিস্ফোরকের পর্যায়ে আছেন। আমাদের অপরাধ এইই যে তথাকথিত শিক্ষিতরা বিদেশের প্রতি অনুগত থাকেন আর কিছু অমেরুদণ্ডী ভেড়া নির্বাচনে অংশ নেয়। ছবি আদানপ্রদান করা বরং আতঙ্ক ছড়ানোর তুলনায় ঢের বেশী গ্রহণযোগ্য।
১৩০কোটি জনসংখ্যার ন্যূনতম একটি অংশই সরাসরি কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সরকারকে। বাকি আয়টুকুর অধিকাংশই হয় বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে। এই দুর্যোগের শুরুতে খুব ছড়াচ্ছিলো বার্তাটি, বিদেশের কোনো এক ডাক্তার ভদ্রমহিলা তিনি অভিযোগ ক’রছেন, যে বিপদের মুহূর্তে এতো ভালোবাসা যখন অভিনেতা, খেলোয়াড়দের কাছেই সাধারণ মানুষ নয় যান, তাঁদের মতো স্বল্প আয়ের ডাক্তারদের কাছে এসেছেন কেন? এ বিষয়ে ব’লি, আমাদের দেশে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষই আছেন ৮৫%। বাকিরাও বিনোদন জগতের দিকে যাতে পা না বাড়ান সেজন্য মূল্য বাড়িয়ে ইত্যাদিভাবে পরোক্ষে তাতে বাধা দেওয়া হয়, তা ছাড়া সেখান থেকে উদ্ভূত অর্থ দ্বারা বৈষম্য অপনয়নের চেষ্টাও করা হয় বারবার। সাম্যবাদের প্রয়োজন তো তখনই প্রবল হ’য়ে ওঠে, যখন দেশীয় আয়ের ২০% ভোগ করেন সাকুল্যে ৮০% মানুষ, বাকি ৮০% আয় মাত্র ২০% মানুষের কুক্ষিগত থাকে। সেইজন্যই জনৈক ব্যবসায়ী নিজের আয় থেকে ১৫০০কোটি টাকা নির্দ্বিধায় দান ক’রতে পারেন আর আমরা হাততালি দিই। কিন্তু দোষারোপ ক’রতে আমরা সবসময় এই ‘উচ্চমানের নিম্ন মধ্যবিত্ত’ শ্রেণীটিকেই খুঁজি, কারণ ‘উচ্চবিত্ত’ সম্পর্কে আমাদের ধারণা তার বেশী আর পৌঁছোয়না যে। সাম্যবাদের কোনো রঙিন পোশাক হয়না আসলে। বৈষম্য অপনয়ন রাষ্ট্রের একটি নৈতিক দায় মাত্র। রাষ্ট্র নাগরিকের ঠিক ততোখানিই, যতোখানি সে স্বয়ং রাষ্ট্রের।