প্রবন্ধও
ভালো প্রাবন্ধিকের একটি অন্যতম গুণ হ’লো প্রকাশভঙ্গিমার আকর্ষণ। শুরু থেকে প্রবন্ধ যাঁদের পড়ার অভ্যাস নেই (পৃথিবীতে কারোরই থাকেনা, যেহেতু পাঠকের নিজস্ব মনস্কতা ব্যতীত স্বয়ং লেখকেরও দায়িত্ব থাকে মনোগ্রাহিতা আরোপ করার) তাঁরা প্রথমবার প’ড়েই বুঝে যান এতো রসকষহীন, কেজো জিনিসে লেখক যন্ত্রের মতো মূলতঃ লিখেই গেছেন, সাধারণ পাঠকের কথা ভাববার বিশেষ সময় পাননি। এভাবেই এক পাতা প’ড়ে, “ধুর এ আর কী প’ড়বো” থেকে শুরু ক’রে দশ পাতা প’ড়ে “দেখি এই বিষয়ে বিস্তারিত কী বলা আছে”র যাত্রাপথে জনৈক সাধারণ পাঠক ক্রমশঃ এক অসাধারণ পর্যবেক্ষক হ’য়ে ওঠেন।
আসলে গল্পকার আর প্রাবন্ধিকের মধ্যে যে পার্থক্য প্রায়শই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়, গল্পকারের নিজস্ব দায় থাকে ঘটনাক্রম সম্পর্কে পূর্ণ আগ্রহ পাঠকের ভেতর জাগিয়ে তোলার, যা প্রাবন্ধিকের আদৌ থাকেনা। অথচ ২জনেরই মূল লক্ষ্য থাকে একটি নির্দিষ্ট বার্তা জনসাধারণের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেওয়ার। জানবেন, কোনো ব্যক্তির ‘লেখা’ ছাপার অক্ষরে পাঠকের হাতে পৌঁছোলেই তিনি কিন্তু ‘লেখক’ নন। না না, আমি লেখার মান নিয়ে কোনো সন্দেহ প্রকাশ ক’রছিনা, আমি ব’লছি গল্পকার গল্প লিখলেও তিনি মূলতঃ কলমের আঁচড়ে একটি নির্দিষ্ট অবস্থার ছবি পাঠকের সামনে পরিস্ফূট ক’রেছেন, কিছু আবেগ, কিছু দৈনন্দিন প্রয়োগ হওয়া ভাষা ইত্যাদি ব্যবহার করে। মানে তিনি লেখক ঠিকই, কিন্তু মূলতঃ একজন ‘কথক’। উল্টোদিকে নিজের কলমে এই কথনভঙ্গিমাকে একপ্রকার তাচ্ছিল্য ক’রে একটি বিষয়ের অন্তর্নিহিত দর্শনকে তথ্যপ্রমাণাদি দ্বারা প্রতিষ্ঠা করাই প্রাবন্ধিকের মূলমন্ত্র। আসলে জ্ঞানের বাহুল্য ক্রমাগতঃ বাড়তে থাকলে লেখকের পক্ষে আবেগকে প্রাধান্য দেওয়া মানসিক ও শারীরিক উভয় প্রেক্ষিতেই শ্রমসাধ্য হ’য়ে দাঁড়ায়।
অতএব এ কথা ঠিক, যে প্রবন্ধের শুরু আসলে গল্পের শেষ থেকেই হয়। সমস্যা এইবারে উঠে আসে, তাহ’লে আদর্শ পাঠক হ’তে গেলে কি গল্প বিষয়টিকে ধর্তব্যে আনার কোনো দরকার নেই? এর উত্তর হ’লো দরকার যে শুধু আছে তা’ই নয়, সাহিত্যের প্রতি পাঠকের কৌতূহলের প্রাথমিক জন্মদাতাই হ’লো গল্প এবং ভালো পাঠক ব্যতীত মানুষ কোনোদিনও ভালো লেখক হ’তে পারেনা, তা সে সাহিত্যের যে শাখার চর্চাই তার অভীষ্ট হোকনা কেন। যে ব্যক্তি কথনভঙ্গিমা দেখে উৎসাহিত হ’য়ে একটি বিষয়ের গভীরে প্রবেশের মানসিকতাই পোষণ ক’রবেনা তার নিজের জ্ঞান অন্বেষণে উপস্থিত যান্ত্রিকতার তলাতেই লেখনক্ষমতা চাপা প’ড়ে যাবে। মনে রাখবেন, কল্পনা হৃদয় থেকে আসে আর সত্য জমা থাকে মস্তিষ্কের একান্ত গভীরে। বার্তা তখনই দেওয়া সম্ভব যখন বিষয়বস্তু প্রাপকের হৃদয় স্পর্শ করে এবং আবেগে লেখক ও পাঠক একাত্ম হ’য়ে যান। শুধু এইজন্যেই জনৈক গল্পকার চাইলেই প্রাবন্ধিক হ’তে পারেন, প্রাবন্ধিক চাইলেই কিন্তু গল্পকার হ’তে পারেননা। কাঠামো তৈরীতে নৈপুণ্য অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু বিনা সাজের কাঠামোর কখনও পুজো হয়না। উল্টে সাজ পাল্টে কার্তিক ঠাকুরকে মা সরস্বতী ক’রে ফেলা কিন্তু মুহূর্তের ব্যাপার।
আমরা কি গল্পে দর্শন বা তথ্যের উপস্থিতি দেখিনি? নিশ্চয়ই দেখেছি। শুধু দেখেছি তাই নয়, শ্রী সত্যজিৎ রায় এই শিল্পে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু তিনি আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের উৎসাহবর্ধনে সেগুলিকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার ক’রেছিলেন মাত্র, আজকের লেখকদের মতো তথ্যের মনোগ্রাহিতা বেচে খাননি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যে আজ আট থেকে আশি প্রত্যেকের মনোরঞ্জনের একমাত্র রাস্তা হিসাবে জনৈক লেখক তথ্যের বাহুল্যকেই বেছে নিচ্ছেন, কথা তুললে পাল্টা “এখনকার পাঠকের কি তথ্য সংগ্রহের শ্লাঘা আছে” এহেন প্রশ্নও ছুঁড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু ব’লছিলাম ‘ভালো প্রাবন্ধিকের’ কথা। ভালো ব’লতে কথার বুননে যিনি দক্ষ আর কী। এই দক্ষতার একমাত্র প্রমাণ হ’লো আদ্যোপান্ত খোলনলচেহীন দর্শনের প্রকাশে তিনি কতোখানি ছুঁতে পারলেন পাঠকের হৃদয় এবং মস্তিষ্ককেও। বর্তমানে প্রাবন্ধিক সংখ্যায় এমনিতেই যথেষ্ট কম, তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতর বেছে নেওয়া ততোধিক কঠিন কাজ।
নিজের লেখায় আমি কোনোদিনও অন্য লেখকের নাম উল্লেখ করার পক্ষপাতী ন’ই, যেহেতু আমি চাই যে অনুসন্ধিৎসাবশতঃ স্ব-পরিচিত পাঠকমহল নিজে থেকেই তাঁকে খুঁজে বার ক’রুন। উপায়ান্তর না থাকায় আজ ইতিমধ্যেই একজনের নামোল্লেখ ক’রেছি, পরে আরো একজনের ক’রতে হবে। আসলে জীবন বা দৈনন্দিন প্রয়োগ হ’তে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলি বিশেষ ক্ষেত্রে অন্যান্যদের তুলনায় কিছু বেশীই যত্নে থাকে, দৈবাৎ সেগুলিকে মহানন্দে সকলের সামনে তুলে ধরার ইচ্ছা হয়। যেমন আদর্শ প্রবন্ধের ভাষা খুঁজছিলাম বহুদিন যাবৎ। প্রশ্ন বরাবরই ছিলো, যে ঠিক কীভাবে নিজের বক্তব্য রাখলে যেকোনো ক্ষেত্রে নিজের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা যায়? বিরোধে দুই পক্ষের ভুলই তুলে ধরা হ’য়েছে এমন বিচার তো প’ড়েছি, লিখেওছি। সে ব্যতীত অন্য কোনো রাস্তা আছে কি?
আজ যা প’ড়ছিলাম, সেটিকে পুরোপুরি প্রবন্ধ ব’ললে নেহাত ভুল হবে। ওটি মূলতঃ পত্রসাহিত্য, কিন্তু দর্শন ও প্রকাশ মুগ্ধতার শেষ সীমানা ছুঁয়ে ফেলায় প্রবন্ধের সাথে এক সারিতে রাখতে বাধ্য হ’য়েছিলাম। বইয়ের একস্থানে এসে হঠাৎ খেয়াল ক’রলাম, ঠিক আগের বাক্যে যে পক্ষের সদর্থক সমালোচনা শেষ হ’য়েছে পরের বাক্যে তার বিপক্ষে একটি কথাও না ব’লে সরাসরি দ্বিতীয় পক্ষের সম্পর্কে ঠিক একইরকম গুরুত্ব দিয়ে সদর্থক সমালোচনা শুরু হ’য়েছে।অবস্থান পরিবর্তনটুকু এতো বেশী সাবলীল, ইতিহাস না জানলে পাঠকের বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা নেই লেখকের ব্যক্তিগত সমর্থন কোনদিকে। সমালোচকের বৈশিষ্ট্য এখানেই প্রকাশ পায়, যখন তিনি আপন বাচনভঙ্গিমায় আপামর পাঠকের সমান স্তরে অবস্থান ক’রলেও তাঁর নিজস্ব সমর্থনকে বিচার করার মতো উচ্চতায় পাঠক হাজার চেষ্টাতেও পৌঁছোতে পারেননা।
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিশ্বকবি’, ‘কবিগুরু’, ‘নোবেলপ্রাপ্ত সাহিত্যিক’ এসব অনেক পরের কথা, প্রথমে তিনি দার্শনিক। এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর একার মৃত্যুতে ‘বাঙলার নবজাগরণের ইতি’ ঘোষণা করা যায়। এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর কীর্তিসমূহ সাগরপারের শ্বেতাঙ্গদেরও বাধ্য করে ভারতীয় দর্শনের গভীরতা সম্পর্কে নতুন ক’রে ভাবতে। সাহিত্য ব’ললেই সারা পৃথিবীতে যাঁর নাম তৎক্ষণাৎ উচ্চারিত হয়।