সাপ্তাহিক কোয়ার্কো ধারাবাহিক উপন্যাসে সুশোভন কাঞ্জিলাল (পর্ব – ১৮)
আঠারো
বাড়ি ফেরার সময় শ্রেয়ান জোর করেই রামের একটা সাড়ে সাতশোর বোতল কিনে নিল এবং আমাকেও রাজি করিয়ে নিল তাতে ভাগ বসাবার জন্য। ওর যুক্তি দুজনেই আজ চোট পেয়েছি তাই আজ এর একটু দরকার আছে। বাড়ি ফিরেই শ্রেয়ানের হাতে ড্রেসিং করে দিলাম। শ্রেয়ান তাড়াতাড়ি বোতল খুলে শুরু করে দিল। আমাকেও এক পেগ বানিয়ে দিলো যত্ন করে। নেশা বেশ মাথাচারা দিয়ে উঠেছে। বাল্মীকি মাঝে মাঝে চপ ও পকোড়া ভেজে দিয়ে যাচ্ছে গরম গরম। রাম উইথ কোকের একটা আলাদা আপিল আছে সত্যি। অর্ধেকের বেশি শেষ। যার অধিকাংশই শ্রেয়ানের পেটে। শ্রেয়ান হঠাৎ সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়লো, “অর্কদা তুমি ছাড়া আমার আপন বলতে কেউ নেই। ছোটবেলায় বাপ, মা-কে হারিয়েছি। তারপর থেকে বাউন্ডুলে লাইফ কাটাচ্ছি। বাবা মায়ের জমানো টাকা সলিসিটারের মাধ্যমে প্রত্যেক মাসে পেয়ে যাই। কাকা জোর করে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি করাল। বাবার মতো নাকি আমারো ইঞ্জিনিয়ার হওয়া উচিত। কাকার মতে ফোর-ফাদার্স এর প্রফেশনে গেলেই নাকি উত্তরসূরিরা সবথেকে সফল হয়। জিনে নাকি গুনগুলো চলে আসে। শালা জ্ঞানপীঠ পুরস্কার দেওয়া উচিত মালটাকে”। আমি বললাম, “শ্রেয়ান ডিনার করে নি চল”। শ্রেয়ান বলল, “না, অর্কদা সত্যি আই লাভ ইউ। তুমি ভাবছ মদ খেয়েছি বলে বলছি। বাট বিলিভ মি, তোমায় আমি নিজের বড় দাদার মতো দেখি। আমি কিন্তু যাকে তাকে ভাও দিই না। বাট তোমায় আমি রেস্পেক্ট করি। তোমার দম আছে বস।”আমার অস্বস্তি হচ্ছে। কারণ নিজের প্রশংসা শুনতে আমার খুব সংকোচ হয়। শ্রেয়ানকে বললাম, “ছাড় তো ওসব কথা। চল গিয়ে শুয়ে পর। আর ডিনার তোকে খেতে হবে না। তুই ড্রাঙ্ক।”শ্রেয়ান থামতে চায়না। বলতে লাগল, “যখন প্রথম তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তখনই তোমার মধ্যে স্পার্কটা দেখেছিলাম। তাই তোমার ফ্যান হয়ে গেছি। সত্যি কথাটা বলি তোমাকে দেখতে অনেকটা আমার বাবার মতো। তাই প্রথম দেখার পর যখন তোমাকে ভালো লেগে গেল, তোমার সঙ্গ আর ছাড়তে চাইনি।”বলেই শ্রেয়ান একেবারে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ড্রয়িংরুমের সোফাতেই ওকে শুইয়ে দিলাম। লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম। বাল্মীকি আগেই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমারো নিজের বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল। আমার বাবাও বেঁচে নেই। আমার জন্ম কোলকাতাতে হলেও আমার তিন বছর বয়সে বাবা মাকে আর আমাকে নিয়ে জার্মানির হামবার্গে বাস করতে লাগলেন। ওখান থেকেই বাবা পি.এইচ. ডি করেন। তারপর একটা সরকারি আসাইনমেন্ট
নিয়ে বছর পাঁচেকের জন্য ভারতে চলে আসেন। এর পর আমাদের একটা পারিবারিক বিপর্যয় হয়। বাবাকে আমি ঠিক বুঝিনা। মার সঙ্গে বাবার বিয়ে ভেঙ্গে গেলো। পাকা পাকি ভাবে ডিভোর্স হয়ে গেলো দুজনের। আমার বয়স তখন আট বছর। আমি বাবার কাছে জার্মানিতে ফিরে যাই। কিন্তু মা থেকে জান ভারতে। বাবার কিছু ব্যাপার আজও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। বাবা খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন আর আমাকেও তাই করান। বাবা ছিলেন কেমিস্ট্রির রিসার্চ সাইনটিস্ট এবং প্রফেসর। কিন্তু নিজের শেষ জীবনে তার ধর্মের প্রতি অধিক টান ছিল। আমার মনে আছে বাবার একটা পার্সোনাল ল্যাবরেটরি ছিল। সেখানেই জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটাতেন তিনি। ল্যাবরেটরি তে কারুর ঢোকার অধিকার ছিল না। এমনকি আমারও না। আমার যখন চৌদ্দ বছর বয়স বাবা হঠাৎ একদিন বিষ খেয়ে সুইসাইড করলেন। আমি তখন খুব অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। পড়ে অবশ্য মা আমায় দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। আমার ধর্মান্তরের ব্যাপারটা মা চেপে গিয়ে আমার আবার পৈতা দিলেন। সেই থেকেই আমার ধর্মের প্রতি কোনো আস্থা নেই। আমি নাস্তিক। মাও বছর দুয়েক পর ক্যান্সার হয়ে মারা গেলেন। আমি আবার একা হয়ে গেলাম। সেই সঙ্গে অসহায়ও। চোখটা জলে ভিজে গেছে। এসব ভাবলে এমনই হয়। তাই এসব এখন আর ভাবি না।