• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। খন্ড – ৮)

কফি পাহাড়ের রাজা

প্রথম পর্ব:

৮)

পরের দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে বিদ্যা নিজের ঘরে গেল একবার। ঝকঝকে করে ঘরদোর ঝাঁটমোছ করল। ঠাণ্ডা জলে স্নান করে তার নিত্যকার শাড়ি পরে নিল। তারপর এক কাপ ফিল্টার কফি হাতে নিয়ে বসল আরাম করে। এইটুকুই তার নিজস্ব আরাম, নিজস্ব ছন্দ। এইসময় সে প্রায় কিছুই ভাবে না, মনটাকে হাল্কা করে দূরের পাহাড়ে ছড়িয়ে দেয়। বলা ভাল, মেলে দিয়ে আসে সকালের রোদে। মনের জমাট ভাব কেটে যায় এক নিমেষে। কিন্তু আজ সে উপায় নেই। একনাগাড়ে বৃষ্টিতে দূরের পাহাড় ঝাপসা হয়ে আছে। অবশ্য ওর বৃষ্টিও খুব ভাল লাগে। লাগছেও আজ। নিজেকে কল্পনায় পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে ভিজে ভিজে নেমে আসতে দেখল। আগে হামেশাই ভিজত। বয়স বাড়ছে, আর সহ্য হয় না অনিয়ম। তাই একটা বড় ছাতা মাথায় ও চলল আবার মুরুগানের বাড়ির দিকে। এখন তো লাইনও বন্ধ। কাজ কম। মুরুগান সারাদিন বাড়িতে থাকবে এই বৃষ্টির ক’টা দিন, তাই ওর সঙ্গ পাওয়ার জন্যই আগে আগে চলে গেল ওদিকে। মানুষটা তো চিরকাল ক্ষ্যাপাটেই রয়ে গেল। কেমন যেন ছন্নছাড়া। অমন ভাল বউও কপালে সইল না। কারুর সঙ্গে বনেও না বড় একটা আজকাল। বড় বেশি খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে! ওর সঙ্গেই বা ক’টা কথা হয়! কী যে বসে বসে ভাবে সারাদিন…কে জানে! বিদ্যা যখন মুরুগানের বাড়ির গেট খুলে ঢুকছে, তখনই দেখল, বাগানের চেয়ারটায় নিঝুম বসে আছে মুরুগান। চুপচুপে ভিজে গেছে। ছাতা ফেলে দৌড়ল ওর দিকে বিদ্যা। দেখ দেখি কাণ্ড! এইবার নির্ঘাত জ্বর বাঁধাবে লোকটা। হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো ঘরে। তারপর বাথরুমে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড় খুলিয়ে স্নান করালো। গা মুছিয়ে, মাথা মুছিয়ে শুকনো কাপড় পরিয়ে দিল মুরুগানকে। এতক্ষণ ধরে মুরুগান চুপচাপ লক্ষ্মী ছেলের মতো বিদ্যার সেবা নিচ্ছিল। যেন, এই আদরটুকু, যত্নটুকু পাওয়ার জন্যই তার এই আদিখ্যেতা, এত ভড়ং দেখিয়ে জলে ভেজা। চোখে জল এসে গেছিল ওর। আছে, আছে, এখনও এই পৃথিবীতে তার জন্য ভাবার বা করার মতো কেউ আছে। ‘চল্‌ রে বিদ্যা! আমরা আজও পার্টি করি’। বিদ্যা প্রবলবেগে মাথা নাড়তে থাকল। ‘না, না, একদম না! রোজ রোজ আমি খাব না। তুমি অল্প একটু আধটু খেতেই পার, তবে আজ আর নানরি নয়, অন্য কিছু খাওয়াব। সঙ্গে রোজকার কুল্লু খেতেই হবে’। মুরুগান এতেও সায় দিল হেসে।
  লুঙ্গির নিচ দিয়ে মুরুগানের একটা পা দেখা যাচ্ছিল। কাঠের পা’টা সোফায় হেলান দিয়ে রাখা এখন। বিদ্যা রান্নাঘরে জলখাবার তৈরিতে ব্যস্ত। ও নাকি আজ রাইস নুডল বানাবে, যাকে ওরা নুলপুট্টু বলে থাকে। মন্দ লাগে না খেতে। কাঠের পায়ের দিকে চোখ গেল মুরুগানের। আর তখনই আবার এতদিন বাদে মনে পড়ল শ্রীনি’র কথা। শ্রীনি এখনও জেল খাটছে। তবু তো তার দুই পা আছে। আর ও জেলের বাইরে বটে, কিন্তু এই কাঠের পা সম্বল করেই এগোতে হয়। মানুষ কি বন্ধু হয় না কখনও? হয়ত। বিদ্যা কি তার বন্ধু নয়? কুগান, সেও তো একপ্রকার বন্ধুই। তবে শ্রীনির মতো বন্ধু যেন কারুর না থাকে। সেদিন শ্রীনিকে তাড়িয়ে দেওয়ার বদলা যে ও এভাবে নেবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কেউ। অবশ্য শ্রীনি শেষে বলেছে এটা নাকি অনিচ্ছাকৃত অ্যাক্সিডেন্ট। ওর এরকম কোন পরিকল্পনা ছিল না। হয়ত তাই। মুরুগানের ভাগ্যে এরকমই লেখা ছিল। বুকের ক্রশটা হাতে নিয়ে আলতো ঠোঁট ছোঁয়াল ও। এও এক অভ্যেস। অকারণ অভ্যেস। যে আছে কিনা, যার অস্তিত্ব সম্বন্ধে ও নিঃসংশয় হতে পারেনি কোনদিন, সেই ঈশ্বরের আদলকে বারবার ধন্যবাদ দেওয়া। হ্যাঁ, সেদিন তো ও মরে যেতেও পারত। একচুলের জন্য সে সেদিন বেঁচে ফিরেছিল। নইলে ওই ভয়াল রাতে, ভয়ানক এক ট্রাকের নিচে পিষে যেতে পারত ও। কী করে বেঁচে গেল, সেটাই আশ্চর্য।
  শ্রীনিকে তাড়িয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিল মুরুগান। কুগানও ঘর ছেড়ে আর নড়ত না। কাজকর্ম সব নিয়মিত ছন্দেই চলছিল। ফলে মাসখানেক কেটে গেলে ও মন থেকে শ্রীনিকে ঝেরে ফেলেছিল। কিন্তু সেদিনের রাতটা ছিল অন্যরকম। মাঝে ওর কানে আসছিল, এই জঙ্গলে নাকি রাতে চোরাশিকারির উৎপাত বেড়েছে। বনদপ্তর থেকে আসত টহল দিতে, কিন্তু তাতেও সুরাহা কিছু হয়নি। হরিণ, শম্বর, নীলগাই—একের পর এক শিকার হয়ে যাচ্ছিল। মুরুগান এই সব খবর শুনে মনে মনে বিধ্বস্ত হচ্ছিল খুব। শেষে একদিন থাকতে না পেরে কোরাবাদের গ্রামে গিয়ে এই নিয়ে বৈঠক ডাকল। ওদের বোঝাল—রাতে নিজেরা সকলে মিলেমিশে পাহারা না দিলে, এই জঙ্গলের গাছ, পশুপাখি সব একদিন খতম হয়ে যাবে। ওরা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। জঙ্গলকে ওরা নিজেদের অংশ হিসেবেই ভাবে। ফলে চোরাশিকারিদের হাতে পেলে যে তাদের আর প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরতে হবে না, সেও মুরুগান বুঝে গেছিল। মুরুগান বরং প্রশ্রয়ই দিয়েছিল ওদের, বলা ভাল উস্কে দিয়েছিল ওদের ভেতরের আগুনকে। ফলে সেই রাত থেকেই পাহারা শুরু হল। ছোট ছোট দল করে ওরা জঙ্গলে টহল দেবে ঠিক হল। মোট ছটা গ্রুপ। মুরুগান বনদপ্তরে যোগাযোগ করে পারমিশন করিয়ে আনল। সাতদিনের মধ্যে টিম গুছিয়ে ফেলল ও। প্রথমদিন রাতে বেরল ওরা। বন্দুক, রাইফেল তো ছিলই, সঙ্গে ড্যাগার, বল্লম, লাঠি, সড়কিও। একটা মিটিং পয়েন্টে এসে ওরা ছ’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। আর সাত নম্বর টিমে রইল মুরুগান একা, সঙ্গে তার চারটে কুকুর। জঙ্গলের মধ্যে কিছুক্ষণ টহলের পরেই দুপদাপ করে ছুটে চলে যাওয়ার আওয়াজ পেল মুরুগান। কুকুরগুলো তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করল একসঙ্গে। কান খাড়া করে শুনল মুরুগান—কাদের বাইকের তীব্রবেগে ছুটে যাওয়ার শব্দ! বুঝল, পাখি পালিয়ে গেল এযাত্রা। অন্য দলের কাছ থেকেও একই রিপোর্ট পেল ও শেষরাতে। চিন্তিত মুখে বাড়ি গেল মুরুগান। ওরা অ্যালার্ট হয়ে গেল…নিশ্চই এবার অন্য কোন ফন্দি নেবে। এরপর সত্যি সত্যিই কিছুদিন কোনরকম কোন সন্দেহজনক ঘটনা ঘটল না। তাহলে কি ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল? এভাবেই কেটে গেল একমাস। মুরুগান ভাবল, সত্যিই হয়ত পোচাররা পালিয়েছে। নইলে এতদিনের মধ্যে নিশ্চই একবার-আধবার হানা দিত। নিশ্চিন্ত হয়ে ছটি দলের ছেলেদের পাহারায় যেতে বারণ করে দিল।
  তবে মুরুগান নিজে যেমন একা ঘুরতে বেরয়, তেমনিই বেরিয়েছিল কুকুর নিয়ে। হাল্কা মেজাজেই ছিল। ঘন্টা দুয়েক বাদে ও যখন ফিরে আসবে ভাবছিল, সেইসময়েই দেখল, একটা জোরালো হেডলাইটের আলোর আভা জঙ্গলে পড়েছে। আলো লক্ষ্য করে ছুটে গেল ওরা। ট্রাক স্টার্ট দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পিছনের পাল্লা খুলে লোডিং হচ্ছিল কয়েকটা সদ্য কাটা গাছ, আর দুটো মরা নীলগাই। এসব দেখে নিজের কথা চিন্তা না করে শূন্যে ফায়ার করল মুরুগান। ট্রাক ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। লাফ দিয়ে কয়েকটা লোক উঠে পড়ল ট্রাকে। মুরুগান উদভ্রান্তের মতো ট্রাকের সামনে গিয়ে পথরোধ করে দাঁড়াল। জোরে ব্রেক কষল ট্রাকের ড্রাইভার। সেটা দেখে ভেতর থেকে কে যেন বলল, ‘পিষে দে হারামিটাকে’…ওই স্বর খুব চেনা মুরুগানের। কার গলা সেই মুহূর্তে মাথায় আসছিল না…ও রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে তখন…কুকুরগুলো ট্রাকের গায়ে লাফালাফি করছে হিংস্র ভাবে। সেই অবস্থায় তীব্র গতিতে মুরুগানকে পাশ কাটিয়ে ট্রাকটা এগোতে চাইল…এক ধাক্কায় হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল রাইফেল। চোখে ঝাঁক ঝাঁক অন্ধকার…তারপর আর কিছু মনে নেই ওর।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।