ঠিক বেরনোর সময়ে দিদার পিছুডাক দেওয়া স্বভাবটা আমি জানিনা কবে যাবে! তাও ডাকার কারন কি! না পটল নিয়ে আসতে হবে ফেরার সময়! কোন মানে হয়? একে তো ওই এক সবজি যা আমার নিজের থেকেও অপ্রয়োজনীয় মনে হয় এই পৃথিবীর বুকে। এমনকি মাঝে মাঝে মনে হয় পটলের নাম বে’গুন’ কেন নয়! এর একটা গুন বলতে পারবেন? এমনকি পটলের ইংরেজি পর্যন্ত জানিনা আমি! কত চেষ্টা করেছি মনে করার যে পটলের ইংরেজি কি আমি শিখেছি স্কুলের ওয়ার্ড বুক-এ? নাহ…মনে পড়েনি! ওরকম তুচ্ছ সব্জির বইয়ে বা আমার স্মৃতিতে মোটে জায়গা নেই!
তার উপর ওই মেয়ে তো হেঁটে হেঁটে ফিরবে আমার সাথে কফিহাউস থেকে শিয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত! কালিকার দুটো ডিমের ডেভিল…আমি…আর নীল… এরকম একটা মাখোমাখো মুহূর্তে আমায় নাকি মনে রাখতে হবে, পটল নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে!
নীল কে, বুঝতে পারলেন না? নীল…মানে নীলাঞ্জনা চক্রবর্তী। এমনিতে তার পরিচয়ের কোন অভাব নেই। কিন্তু আমার ভীষণ পছন্দের পরিচয়টিই দেব আপনাদের। সেটি হল, নীল আমার প্রেমিকা। এই পরিচয়ের পিছনে এক কালজয়ী ইতিহাস সাক্ষী রয়ে গেছে। হবে না আমার পছন্দের পরিচয়? সে আপনাদের মনে হতেই পারে আমি টিপিকাল পুরুষমানুষ। তা আমি একটু তাইই বটে। প্রেমিকাকে বৌ ভাবতে ভালোবাসি, নম্বরটা মায়ের ভয়ে এখনও যদিও “বৌ” বলে সেভ করা হয়নি। সে আলাদা ব্যাপার!
কি বললেন? কতদিনের সম্পর্ক? যাহ্ … প্রেমিক প্রেমিকাদের এসব প্রশ্ন করতে হয়? উত্তর ঘষে পিটে সব্বার একই হয় মোটামুটি। ওই “ইয়ে বন্ধন তো পেয়ারকা বন্ধন হ্যায়…জন্মকা সঙ্গম হ্যায়”…. তবু বলি, সে প্রেমিকা হয়েছে হালে। তাই ওই ‘নীল’ ডাকটা বড্ড আমার। আর তাছাড়া একটা অসুবিধেও আছে বুঝলেন? নীলাঞ্জনা ডাকতে কেমন বাঁধে যেন। কদিন আগেও যাকে নীলাঞ্জনা দি ডাকতাম, তাকে প্রেমের সুবাদে এক্কেবারে নাম ধরে! মানে কেমন যেন একটা হয়…
হ্যাঁ… ঠিকই ধরেছেন। যাকে দিদি ডাকতাম, তার সাথেই ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখি। দেখবো না কেন? সিপিএম যদি আবার গদি ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন…মানে ওই আর কি…আমি বাবা রাজনীতি থেকে অনেক অনেক দূরে… যাক গে… যেটা বলছিলাম… তা স্বপ্ন দেখবনা কেন? ঠিকাছে … পরিচিত মহলে নাহয় সে আমার দোর্দণ্ডপ্রতাপ দিদি আর আমি তার বাধ্য ভাই… হ্যাঁ হ্যাঁ …মানলাম সে নাহয় ……
এই তো … কথা বলতে গিয়ে কেমন দেরী হচ্ছে দেখছেন? নীল তো আর আপনাদের চারটি কথা শুনাবেনা! সে যতই বলি আপনারা ধরেছিলেন গল্প শুনবেন বলে! ভবি মোটে ভোলবার নয়… তার সোজা কথা। আমি যেতে দেরী করেছি মানে আমারই দোষ! সে যদি বলি হেঁটে আসার সময় একহাত দূরে বোম পড়েছিলো, রাস্তা ধ্বংস হয়ে গেছিল, তাও মানেনা জানেন! উল্টে চোখ পাকিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বলবে “অন্য রাস্তা ছিল না? পা হাত তো বাদ যায়নি দেখছি! তো অন্য রাস্তা দিয়ে এসে ঠিক সময়ে পৌঁছতে কে বারন করেছিল?” এবার বুঝতেই পারছেন তাহলে আমায় কেমন পা চালাতে হবে!
আঃ হা… আমি কি বলেছি বলবো না গল্প? এই শিয়ালদা প্রাচির মোর থেকে কফিহাউস যেতে যেটুকু সময় লাগবে, তার মধ্যে যতটুকু পারছি, বলছি। বাকিটা দেখে নেবেন চাক্ষুষ!
নীল…মানে ওই নীলাঞ্জনা নাম যে কি সার্থক সে আপনারা বুঝবেন কি করে বলুন! না না… নীল রঙের কাজল চোখে পরে কোনোদিন সামনে আসেনি সে। কিন্তু ওই ‘নীলাঞ্জনা প্রেমিকের কল্পনা’ হয়ে কারুর বাড়ির উঠানে আল্পনা দিয়ে বেড়াচ্ছিল! আর আমিও নচিকেতা বলেছে বলে ব্যর্থ প্রেমিককুল “দাম দিয়ে যন্ত্রণা কিনতে চায়”-এর সুবিধাজনক অর্থ বের করে শহরের অলিতে গলিতে ঘুরছি, হাত বদল করছি, আমার চিলেকোঠার ঘরের টিমটিমে আলো থেকে রিমঝিমে বর্ষা – সবেতেই ঝিমঝিমে ভাব পাচ্ছি।
একের পর এক নীলাঞ্জনা, শুধু অঞ্জনা, ব্যাঞ্জনা ইত্যাদি প্রভৃতির আকাশকুসুম দাবীতে নাকানিচোবানি খেয়ে – সবাইকে “রঞ্জনা আমি আর আসবো না” করে চলে আসতে হচ্ছে। এমন সময়ে……
না মানে ওই “এক লারকি কো দেখা তো এয়সা হুয়া” – এমন কিছু হয়নি! মাইরি বলছি। জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ডের অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম নিমপাতা গেলা ব্যাজার মুখে একটা হাফপ্যান্ট গেঞ্জি পরিহিতা মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
না না… গিয়ে কথা বলিনি। আরে …প্রেমে পড়েছিলাম নাকি যে কথা বলতে হবে গিয়ে! এমনিই মুখখানা চোখে লেগেছিল! কেমন যেন “তারে আমি চোখে দেখিনি…তার অনেক গল্প শুনেছি” গোছের একটা ভাব জানেন! তাই ওই একটু আধটু নজর রাখছিলাম। হঠাৎ দেখি কোথাকার কে একজন এসে দিব্যি তার সাথে এসে গল্প জুড়ে দিলো। সেও কথাবার্তা বলছিল টুকটাক। ওইদিন ওটুকুই…
হ্যাঁ… বলছি বলছি… কেন দিদি ডাকলাম, আবার কোথায় দেখা…সবটা বলছি। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিই।
বলছহিলাম, পৃথিবীটা খুব ছোট বুঝলেন! একদিন আমি এক বন্ধুর বাড়ি যাব বলে দমদম স্টেশনে অমানুষিক ভিড় ট্রেনে ঝুলতে ঝুলতে এসে নামলাম। জামা কাপড় এক্কেবারে যা নয় তাই অবস্থা! নেমে সেসব ঠিক করে নিচ্ছি। আর তা করতেই আমার পেয়েছে খিদে। তো বন্ধুর বাড়িতে যদিও খাওয়ার ব্যাবস্থা ছিল, তবু ভাবলাম কিছু একটু খেয়েনি। একটা ডিমসেদ্ধর দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ওমা! ডিমবিক্রেতা দাদা ঝড়ের গতিতে সুত দিয়ে ডিম কাটছে আর একটা ২ বাটির একটা টিফিনবক্সে চালান করছে। আমি একটা ডিমসেদ্ধ চাইতেই বলে উঠলো, “পনেরোটা ডিমের অর্ডার দাদা। একটু দাঁড়ান। দিচ্ছি।”
খানিকবাদে ডিমসেদ্ধ চালান শেষ হতেই দেখলাম সেই মেয়ে দোকানের পাশের অন্ধকার ঘুপছি থেকে বেরিয়ে টিফিনবাটি নিয়ে টাকা মিটিয়ে চলে গেলো গম্ভীর মুখে! আরে না না … ডিম কিনতে দেখে প্রেম কেন হবে? কোন প্রেম ট্রেম না। শুধু একটু অবাক হয়েছিলাম হঠাৎ দেখে।
এরপর আমিও ৩০ মিনিটের মধ্যে ওই বন্ধুর বাড়ি পৌঁছই। সঠিক ভাবে বলতে গেলে বন্ধু স্থানীয় দাদা। প্রনব দা। ওর বাড়ির বিছানায় গা এলিয়ে শুলাম। প্রনবদা’র সাথে টুকিটাকি কথা বলছিলাম। হঠাৎ একটা ফোন এল ওর ফোনে। ওপাশে কে ছিল বুঝলাম না। কিন্তু এপাশ থেকে প্রনব দা’র এক তরফা কথোপকথন শুনে বুক ঢিপঢিপ, মাথা টিপটিপ- সব শুরু হয়েছে! কথোপকথনটি ছিল…
“কোথায় এখন তুই?”
………………..
“হ্যাঁ! সেকি! অন্ধকার গলিতে কি করছিস!”
………………..
“আরে… মুড খারাপ বলে ১৫ টা ডিম সেদ্ধ খাবি তুই?”
…………………
“খুব স্বাভাবিক নীলাঞ্জনা… অমানুষের মত ডিম খেলে মুড ঠিক হয় কোনোদিন শুনিনি্… এক কাজ কর… বাড়িতে গুপি দিয়ে চলে আয় আমার বাড়ি… ”
১৫ টা ডিমসেদ্ধর কথা শুনেই আমার মনে হয়েছিলো পৃথিবী কি এতই ছোট?
প্রমান পেয়ে গেলাম… পৃথিবীটা আমি যতটা ছোট ভাবতাম, তার চাইতেও ছোট! বেশ খানিক বাদে দেখলাম মাঝারি উচ্চতার কাঁধ পর্যন্ত চুল উলঝুল মাথা, চোখ টলমল সেই মেয়ে প্রনব দা’র ঘরে ঢুকে পিঠের ব্যাগ ধপ করে ওর খাটের উপর রেখে গা এলিয়ে দিয়ে বলল “৬ টা ডিম বেঁচে গেছে…খেয়ে নে না প্রনব… সবকটা সাঁটাতে পারিনি…”
আমার কেমন সন্দেহ হল, আমি অদৃশ্য না তো? এমনিতেই আমার মনে তখন পৃথিবী ঠিক কতটা ছোট সেই বিষয়ে বিস্তর তোলপাড় চলছিলো। তার উপর, মানুষ তো একবার তাকিয়ে দেখে ঘরে তৃতীয় ব্যাক্তি থাকলে! মোটে দেখেনি! উল্টে প্রনব দা’কে জিজ্ঞেস করল “বলিস্ নি তো তোর বাড়িতে আরও লোকজন আছে!”এমন একটা ভাব যেন প্রনব দা’র সাথে তার আলাপ, আমার আর প্রনব দা’র আলাপের থেকেও পুরনো!
প্রনব দা নির্লিপ্ত মুখে জবাব দেয়, “ও হল কিংশুক…আমার অনেক পুরনো বন্ধু আজ নাইট স্টে করার কথা ছিল… ফোনে বলতে ভুলে গেছিলাম…”
তারপর আর কিসসু বলতে হয়নি। নীলাঞ্জনা দি নিজেই আলাপ করে নিয়েছিলো আমার সাথে। আর প্রনব দা’র বন্ধু বলে আমারও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই নীলাঞ্জনা নামের পিছনে একটা দি জুড়ে গেছিলো। ঠিক সেদিনের পর থেকে আমাদের প্রথমে প্রনব দা’র বাড়িতে আর তারপর অন্যান্য জায়গায়ও দেখা হয়েছে বহুবার।
ধীরেধীরে আমি দেখেছিলাম নীলাঞ্জনা দি কি সাঙ্ঘাতিক একজন প্রশ্রয়দাত্রী দিদি। আমি নীলাঞ্জনা দির সবটুকু স্নেহের ভাগিদার ছিলাম, তা আমি বেশ বুঝতাম। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, আমাদের বয়সের পার্থক্য ১ বছর মোটে। কিন্তু দিদি ডাকের যে কি মাধুর্য… আমি আর নীলাঞ্জনা দি দুজনেই খুব খুশী ছিলাম কিন্তু এই ডাক নিয়ে। আমি তো বলতাম আমরা নিশ্চয়ই কুম্ভ মেলায় হারিয়ে গিয়েছিলাম কোন এক সময়ে। বিস্তর মিল আমাদের দুজনের। ক্রিয়া থেকে প্রতিক্রিয়া সবেতেই আমাদের হুবহু মিল। আমাদের বড় হয়ে ওঠা, জীবনের ওঠা পড়া, বয়ঃসন্ধিক্ষনের ক্রাইসিস, মূল্যবোধ – সব কিছুর কি ভীষণ মিল!
ধীরেধীরে আমরা একজন আরেকজনের সিক্রেটকিপার থেকে ক্রাইম পার্টনার সব কিছু হয়ে গিয়েছিলাম জানেন!
হ্যাঁ? নীলাঞ্জনা দি কেমন ছিল? তা সে একটু দাপুটে মহিলাই ছিল। কড়া শাসনে রাখবে সবাইকে, এমন মনোভাব। আমার প্রতি স্নেহে একচোখা ছিল বটে। চোটপাট দেখার মত! কিন্তু ঝকঝকে একটা মানুষ। সাহায্য করতে জানতো প্রান খুলে। হাসির কথায় অট্টহাসি ছাড়া কোনোদিন ঠোঁট চিপে, মুখ ঢেকে হাসতে দেখিনি। আবার দুঃখ হলেও লুকতে দেখিনি কিংবা রাগ হলেও না। আমার চোখে সবটুকু দিয়ে বড্ড প্রকট ছিল নীলাঞ্জনা দির অস্তিত্ব।
অন্যদের চোখে? উম্মম্মম্মম… নীলাঞ্জনা দির একটা বড় বদনাম ছিল, যা সে নিজেও মানত। নীলাঞ্জনা দি নিজের মর্জির মালকিন বরাবর। এমনকি নীলাঞ্জনা দি নিজেকে আরও একটা বিশেষণ উপহার দিত। “স্বার্থপর”। আমার দ্বিমত ছিল। কিন্তু ওই যে…শুনছে কে!
এই তো প্রায় পৌঁছে গেছি কফিহাউস। আজ অনেক কাজ বুঝলেন!
আরে না না… পটল কেনা নয়। আরও অন্যান্য কাজ আছে! আজই তো সেই দিন যার অপেক্ষায় আমি আমার চিলেকোঠার ঘরে জীর্ণ কম্পিউটারে “আজ ফাগুনি পূর্ণিমা রাতে চল পলায়ে যাই” লুপে চালিয়ে রাখতাম!
হ্যাঁ! ঠিক ধরেছেন। আজ-ই পালাবো!না না… পালাবো না… চলে যাবো… অনেক দূরে…। নীলের সাথে। ঘর বাঁধতে…
আর দাঁড়াতে পারছিনা বুঝলেন! ওই যে দেখুন… নীল কফিহাউসের উল্টো ফুটে দাঁড়িয়ে আছে! মুখখানা সিগন্যালের মত লাল হয়ে গেছে রেগে গিয়ে। দেখেছেন! ছাড়ুন এবার আমায়…
অ্যাঁ? কি বলছেন? ঘর বাঁধতে হলে চলে কেন যেতে হবে?
কারন নীল আগেও একবার লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ি পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল…