• Uncategorized
  • 0

এইসময়ের লেখায় আকাশ কর্মকার

কোয়ারেন্টাইন ও গৃহবধূরা

আধুনিক সমাজে প্রতিটা ছেলে মেয়ে সবাই নানান কাজকর্মের সূত্রে নিত্যদিনই বাইরের পরিবেশের সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে সম্পর্কযুক্ত। আমরা প্রায় সবাই দিনের একটা বড়ো অংশ বাড়ির বাইরে কাটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি দিনের পর দিন। সেখানে আমাদের একটা অন্য জগত রয়েছে যেটা আমাদের কিছু ভালোলাগা ভালোবাসার মানুষজনদের দ্বারা পরিবেষ্টিত। হঠাৎ যখন এই এক ক্ষুদ্র অণুজীবের প্রকোপে আমরা সুস্থ থাকার তাগিদে ঘরে থাকতে বাধ্য হয়েছি তখন অনেকেই বাইরে বেরোনোর অজুহাত খুঁজছেন। যদিও তা মোটেই অভিপ্রেত নয় তবুও, মানুষ তো অভ্যাসের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে আজ যুগ-যুগান্তর ধরে। অভ্যাস যেমন একদিনে গড়ে তোলা যায় না, ঠিক তেমনই তা রাতারাতি বদলে ফেলাও যায় না।
আবার আসি আমার মায়ের কথায়। কথাটা আমি আমার মা-কে দিয়ে শুরু করলেও মিলে যাবে অনেক মায়ের সাথে। আসলে মা-এর তো কোনো প্রকারভেদ নেই, নেই কোনো রূপান্তরকরণ। মা একটা শব্দ, একটা ডাক, একটা মানুষ, একটা অনুভূতি, একটা অভিব্যক্তি। এখন প্রচুর নারী রয়েছেন যারা সমান দক্ষতার সাথে সংসারও সামলাচ্ছেন আবার কর্মক্ষেত্রও। কিন্তু যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, সমাজ নারীদের এতোটা স্বাধীনতা কখনো দেয়নি। বেশী যেতে হবে না, এই ধরুন ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগেও কিন্তু এই সংখ্যাটা নিতান্তই কম ছিল। শুধু যে নারীদের সুযোগ ছিল না তা নয়, প্রশ্ন টা ছিল ‘কোয়ারেন্টাইন’-এর। ইতিহাসের নানান বর্ণাঢ্য অধ্যায়ে নারীদের জীবনযাপনের নানারকম দিক উল্লিখিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি হল নারীদের ঘরের মধ্যে থাকা, বাইরের জগতের সাথে মেলামেশা পুরোপুরি বন্ধ। এমনকি ঘরের মধ্যেও যদি কোনো অতিথি আসেন তাদের সামনে যাওয়াতেও জারি ছিল নিষেধাজ্ঞা। ‘পর্দা সিস্টেম’ বা ‘purdah system’ বলে যে রীতি প্রচলিত ছিল তার বেশ দীর্ঘ সময় পর অবলুপ্তি ঘটেছে। এবং এই রীতির কবলে কিন্তু আমাদের বাড়ির অনেক ঠাকুমা-দিদিমাদেরও পেতে পারি। প্রথমত অল্প বয়সে বিয়ে, তারপর বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখা—এরপরেও ওনারা স্বামী, সন্তান, শ্বশুরবাড়ি নিয়ে সংসার সামলেছেন (হাসিমুখে!)।
আমি বিগত আট দিন ঘরের মধ্যেই রয়েছি, ভার্চুয়াল জগতে সময় কাটাচ্ছি, ভুলভাল লেখার চেষ্টা করছি; এত কিছুর মধ্যে যেন কোথাও একটা চরম অস্বস্তিকর পরিবেশে রয়েছি। কারণ, বাড়ির বাইরে বেরনো বন্ধ, গৃহবন্দী হয়ে মোকাবিলা করছি পৃথিবীর এক মারণ রোগের সাথে। এই গৃহবন্দীর অবস্থা হয়তো আরও এক মাস, দু’মাস চলতে পারে, আবার নাও পারে। সে যাই হোক্, খুব তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা মুক্তি পাব এই বন্দী দশা থেকে‌। আবার নেমে পড়ব রাস্তায় হৈ-হৈ করে, সাইকেল-বাইক-চারচাকা সব গতিশীল হয়ে উঠবে এই বসন্তের ঘুম ভাঙার পর। কিন্তু আমাদের মায়েরা তো তারপরেও ক্রমাগত ঘরের কাজেই সময় কাটিয়ে যাবেন। সকালে ঘুম ভাঙা থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত আমি মাকে কখনো বিশ্রাম নিতে দেখিনি। গৃহস্থালীর সমস্ত কাজ হাসিমুখে করে চলেছেন কোনো অভিযোগ ছাড়াই, কারণ ওনাদের কাছে বন্দীদশা মাস-সপ্তাহের হিসেবে নয়, ওটা আজীবনের। গ্রাম বাংলা কিংবা একটু শহরতলির প্রতিটা বাড়িতেই এই দৃশ্য ধরা পড়বেই আমি হলফ করে বলতে পারি। আমরা একুশ দিনে হাঁফিয়ে উঠেছি, পথ খুঁজছি নিত্যনতুন নিজেদের একাকীত্ব ঘোচানোর কিন্তু ওনাদের মুখে কখনো এ বিষয়ে একটি শব্দও ফোটেনি। কারণ খুব স্বাভাবিক, ওনারা ‘মা’ তাও আবার বছর ত্রিশ আগের। আমি ব্যতিক্রমে যাব না, কারণ ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হয় না।আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও নারীরা বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন, এখনও আছেন এবং আগামীদিনেও থাকবেন; হ্যাঁ সংখ্যাটা ক্রমবর্ধমান এবং তা যথাযথ।
আমি যখন দিনের শেষে বাড়ি ফিরি তখন সবার আগে যাকে দেখতে চাই তিনি আমার মা। তখনই একটু আধটু কথা হয়, বাইরের বিভিন্ন কথা মাকে এসে বলি; সারাদিন ঘরে কেমন কাটল মাও সেসব আলোচনা নিয়ে বসেন। কিন্তু এই কটাদিন বোধহয় সবচেয়ে ভালো নিজের পরিবারকে দেওয়ার জন্যে, নিজের মায়ের জন্যে। ‘গৃহবধূ’ শব্দটা ঠিক কতটা ভারী তা আমরা ভাবতেও পারব না। কোনোদিন ঘরে থাকলে একটু চা করে বা কোনো একটা পদ বানিয়ে ফেসবুকে ফলাও করে ছবি দিয়ে বলতেই পারি, দেখো আজ আমি বানিয়ে খাওয়ালাম তোমায়; আর ঐদিকের মানুষগুলো হাসিমুখে সমস্ত ক্লান্তিকে নিজেদের মধ্যে চেপে রেখে আমাদের জন্য, হ্যাঁ শুধু আমাদের জন্যই অনবরত পরিশ্রম করে চলেছেন। গৃহবন্দী বা কোয়ারেন্টাইন তাদের কাছে নতুন নয়, শব্দটাও যেমন পুরানো তাদের অবস্থাটাও তাই। আমরা আর কটাদিন ভালো ভাবে সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করে ঘরে থাকলে অবশ্যই তারপর মুক্তি পাব, সমস্ত বাঁধন আবার যাবে খুলে শুধু ঐ মানুষগুলোর ছাড়া। তাদের জীবনে কার্ফু টা সরকারী নয়, সেটা সামাজিক এবং সর্বোপরি সা‌ংসারিক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।