সানাইতে আহিরভৈরোঁ’র মধুর তানে ঘুম ভাঙল অবিনাশের। ভোরবেলা আহিরভৈরোঁর কোমল ঋষভ – কোমল নিষাদ মিলেমিশে কেমন যেন এক অনাবিল আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করে, গোটা দিনটা যেন পবিত্র হয়ে ওঠে। মনে মনে নানারকম কল্পনার জাল বুনতে বুনতে হঠাৎ অবিনাশের খেয়াল হল, আজ তো যে সে দিন নয়! আজ তো মহাসপ্তমী। আরও ভোরে উঠে স্নান সেরে বীণা চলে গেছে ঠাকুরদালানে। একটু পরেই তার ডাক পড়বে, নবপত্রিকা নিয়ে গঙ্গাস্নানে যেতে হবে তো।
আগেকার ধরণের চারমহলা বাড়ি অবিনাশদের। তার বিভিন্ন দিকে ছড়ানো-ছেটানো ছোটবড় অনেকগুলি ঘর, বেশ কয়েকটি বৈঠকখানা, পুরনো আমলের আসবাব, ঘর সাজাবার দেশী, ভিনদেশী ছোটবড় নানা সামগ্রী আর সবকিছুকে যেন একসুত্রে বেঁধে রেখেছে ভিতরের টানা বারান্দা। ছোটবেলায় অবিনাশ ও তার জেঠতুতো-খুড়তুতো ভাইবোনেরা মিলে এই বারান্দায় কত খেলা করেছে, আরেকটু বড় হওয়ার পর এই বারান্দাই ছিল তাদের স্বপ্নরচনার প্রাণকেন্দ্র – তাদের ছোটবেলার কাটুম-কুটুম, তাদের কৈশোরের গোপন কবিতা রচনা, তাদের পুজোর নাটকের মহলা সবকিছু ওই টানা বারান্দার কোলে। স্মৃতিসুখে মুচকি হেসে, বাইরে তাকিয়ে অবিনাশ দেখতে পেল তার ছেলে এবং তার ভাইবোনেদের ছেলেমেয়েরা একইভাবে বারান্দার এক ধারে গল্পে মেতে উঠেছে এই সাতসকালেই। হবেই তো – এখন তো একে অন্যের সাথে অত দেখাসাক্ষাৎ আর হয় না … এই পুজো পার্বণ আর অনুষ্ঠানবাড়িই যা উপলক্ষ্য। নীচের তলা থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ, ছেলেমেয়েদের কথার সমধুর রেশ এবং ভোরের সানাইয়ে তার নিজের ভাললাগা – এইসব নিয়ে অবিনাশ ধীরে ধীরে উঠে পড়ল।
খানিক বাদেই বীণা নীচের তলা থেকে উঠে এসে তাকে সকালের চা দিয়ে, তার কোঁচানো ধুতি, সাদা আদ্যির পাঞ্জাবী গুছিয়ে রেখে গেল। অবিনাশ স্নান সেরে নিয়ে বীণার রাখা ধুতি-পাঞ্জাবী পরে নিয়ে আস্তে আস্তে নীচে নেমে হাঁকডাক শুরু করে দিল। বাড়ির ছেলেরা মিলে নবপত্রিকা স্নান সেরে ফেরার পর, বাড়ির বউদের নিয়ে বীণা যখন লালপাড় শাড়ি পরে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে বরণ করবার জন্য এগিয়ে এল, তখন তাকে দেখে হঠাৎ অবিনাশের সেইদিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল যেদিন এই বীণাই নতুন বউয়ের সাজে দুরুদুরু বক্ষে ধীরপায়ে দুধে-আলতায় পা ভিজিয়ে তাদের বাড়িতে প্রবেশ করেছিল। এক আলাদা ভালোলাগায় তার মন যেন আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল।
পরের কয়েকদিন, পুজোর নির্ঘন্ট অনুযায়ী সকালের ভোগ-আরতি, মহাষ্টমী পুজো, সন্ধি পুজো, আবার তারই সাথে সপ্তমীতে মাছ, অষ্টমীতে লুচি-আলুরদম আর নবমীর মাংস-ভাতে সকলে সাগ্রহে মেতে রইল। নবমীর সন্ধ্যায়, যখন সানাইতে হংসধ্বনির আমেজ, চারধারে অগুন্তি মানুষ সম্বৎসরের উৎসবের শেষ আনন্দের রেশটুকু ধরে রাখতে মরিয়া, তখন অবিনাশের মনে যেন সামান্য বিষাদের ছোঁওয়া। রাত পোহালেই তো বিসর্জনের বাজনা বেজে উঠবে। ভাই বোন, আত্মীয়স্বজন সবার জন্য আবার সেই বছরভোরের প্রতীক্ষা।
দশমীর সকালে সানাইয়ে টোড়ির কোমল স্বরগুলির ওঠাপড়া কেমন এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা ছড়িয়ে দেয় চারধারে। বাড়ির পুজোর বিসর্জন একটু তাড়াতাড়িই হয়। বেলা গড়াতেই বাড়ির মেয়ে-বউরা সিঁদুরখেলা সেরে নিয়ে মা’কে বরণ করে বিদায় জানাল, আগামী বছর পুনরাগমনের প্রণাম জানিয়ে। মা’কে যখন গঙ্গার জলে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছিল, অবিনাশের মনে কেমন যেন একটা ধাক্কা লাগছিল – প্রতিবারই লাগে, চোখের কোণ যেন অল্প চিকচিক করে ওঠে।
“ও দাদু, দাদু … ও দাদু, ওঠো … উঠে পড়ো। চা তো ঠান্ডা জল হয়ে গেল! আমি সেই কখন দিয়ে গেছি!!” খানিকক্ষণের ডাকাডাকিতে অবিনাশ চোখ তুলে তাকালেন। তাকালেন বটে, কিন্তু যেন ঠিক দেখতে পেলেন না সামনের কিছু … হঠাৎ যেন চারপাশ কেমন যেন ঘোলাটে মনে হল তাঁর। বেশ কয়েকবছর হল, বীণা চলে গেছেন এমন এক লোকে যেখান থেকে কেউ ফেরে না। একমাত্র ছেলে তার দারা-পুত্র-কন্যাসহ সাত সমুদ্রের ওপারে। দেখাশোনার ও পরিচর্যার সুবিধার্থেই হোক, অথবা দায়ভার থেকে দূরে থাকতেই হোক, গত কয়েকবছর তাঁর আশ্রয় বারুইপুরের কাছে ছায়াঘেরা প্রকৃতির কোলে এক বৃদ্ধাশ্রমে। যেখানে দিনের পরে দিন আসে আবার সায়াহ্নে মিশে যায় নিস্তব্ধ রাত্রির নিঃসীম অন্ধকারে। অবিনাশেরই মতন আরও কতজোড়া চোখ সহস্র প্রত্যাশা নিয়ে একফালি জানলা দিয়ে অনন্ত দিগন্তে তাকিয়ে থাকে শুন্যদৃষ্টিতে। ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে অবিনাশ আজ আবার আহিরভৈরোঁ শুনতে পেলেন সানাইতে, কিন্তু এ সানাই যেন তার কানে বয়ে নিয়ে এল বিষণ্ণ একাকিত্বের বার্তা। তাঁর হঠাৎ খেয়াল হল, আজও তো মহাসপ্তমী।