গীতাঞ্জলি হল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কাব্যগ্রন্থ l গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ মূলত ব্রাহ্ম ভাবধারার ভক্তিমূলক রচনা l এই বইয়ে মোট ১৫৭টি গীতিকবিতা সংকলিত হয়েছে। ১৯১৩ সালে দশই নভেম্বর তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন l
গীতাঞ্জলি/দ্য সং অফারিংস-এ ১০৩টি কবিতা/গান স্থান পেয়েছে। বাংলা গীতাঞ্জলি কাব্যের ১৭৫টি কবিতা/গান থেকে ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে ৫৩টি কবিতা/গানকে স্থান দিয়েছেন। অবশিষ্ট ৫০টি কবিতা/গান নিয়েছেন ৯টি কাব্যগ্রন্থ থেকে, যেমন—-
গীতিমাল্য থেকে ১৬টি, নৈবেদ্য থেকে ১৫টি, খেয়া থেকে ১১টি, শিশু থেকে ৩টি, কল্পনা থেকে ১টি, চৈতালি থেকে ১টি, উৎসর্গ থেকে ১টি, স্মরণ থেকে ১টি এবং অচলায়তন নাটক থেকে ১টি।
সঙ্গ অফরিংস-এর ভূমিকা লিখেছিলেন স্বয়ং কবি ইয়েটস্। এ ভূমিকাটি ছিল একই সঙ্গে আন্তরিক ও যথেষ্ট প্রশস্তিতমূলক। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ইংরেজ লেখক এবং রয়্যাল সোসাইটির সদস্য স্টার্জ মুর নোবেল পুরস্কারের জন্য রবীন্দ্রনাথকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচারের ৭০ জন সদস্যদের একজন ছিলেন তিনি l
গীতিমাল্য কাব্যটি কবির পরিণত জীবনে সঙ্গীতের পবিত্র মাল্য। কাব্যটিতে কবি ঈশ্বরের কাছে নানাভাবে নানামূর্তিতে নিবেদন প্রকাশ করেছেন;
নৈবেদ্য কাব্যের ‘চিত্ত যেথা ভয়-শূন্য’ কবিতায় কবি চিত্তের ঔদার্য, নির্ভিকতা এবং জ্ঞানের যুক্তির কথা বলেছেন;
অচলায়তন নাটকের বক্তব্য-অচলায়তনের রুদ্ধগৃহে যে জ্ঞান সংগৃহীত হয় সে নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ বলেই প্রাণহীন এবং নিঃস্ব। কিন্তু চতুর্দিকের দেয়াল যখন ভেঙে যায় এবং বাইরের আনন্দ চিত্তে প্রবেশ করে, জ্ঞানের প্রতিষ্ঠা তখনই সার্থক হয়। পঞ্চক হচ্ছে নিয়ম ও স্বাধীনতার প্রতীক আর মহাপঞ্চক বিধিবদ্ধ নিয়মের প্রতীক। অচলায়তন নাটকের
“আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা –” এই
গানের মাধ্যমে রবি কিরণের সঙ্গে প্রকৃতির আশীর্বাদকে জাগ্রত করেছেন জীবন-যৌবন-ভূবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সেখানে অন্ধকারের বিপরীত স্রোতে হূদয়ের স্পন্দন বীণার ঝংকারের মাধ্যমে কবি তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু কবিতাতে সুরের অলংকারে সাজিয়ে গান রচনা করেছেন l
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নৈবেদ্য, উৎসর্গ, খেয়া ও গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে বলেছেন- ‘আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে যে মুক্তি পরম পুরুষের কাছে আত্মনিবেদন, আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সেই মহামানবের মধ্যে যিনি সদা জনানাং হূদয়ের সন্নিবিষ্টঃ আজীবন সাহিত্য সাধনার গন্ডিকে অতিক্রম করে একদা সেই মহামানবের উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য আমার কর্মের অর্থাৎ আমার ত্যাগের নৈবেদ্য আহরণ করেছি-তাতে বাইরে থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি অন্তরের থেকে পেয়েছি প্রসাদ।’
কথা ছিল এক তরীতে কেবল তুমি আমি
যাব অকারণে ভেসে কেবল ভেসে
ত্রিভুবনে জানবে না কেউ আমার তীর্থগামী
কোথায় যেতেছি কোন্ দেশে সে কোন্ দেশে?
(গীতাঞ্জলি)
‘কখন তুমি আসবে ঘাটের পরে
বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে।
অস্তরবির শেষ আলোটির মতো।
তরী নিশীথ-মাঝে যাবে নিরুদ্দেশে।’ (গীতাঞ্জলি)
এ গানে মানবিক প্রেমের বেদনা যেমন আছে, তেমনই গানের বাণীতে তার ভগবান প্রেমের আকুতিও ধরা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ তার অনিশ্চয়তার গহ্বর থেকে বের হতে পারছেন না; অজানা, অসীমের প্রতি এই বিষাদ গন্ধমাখা আকর্ষণই রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন দেশে তিনি যাবেন তিনি তা জানেন না; এও তিনি জানেন তার এ যাত্রা নিরুদ্দেশের পথে। রবীন্দ্রনাথ যখন গীতাঞ্জলির গানগুলো রচনা করেন, তখন ‘ইংরেজ দের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল কিন্তু গীতাঞ্জলির গানগুলোর মধ্যে নিরাশক্ত অসীমের বন্দনার গানগুলোর পাশাপাশি স্বদেশীকতার বিষয় যে গানগুলো লিখেছেন তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব গান গীতাঞ্জলি মূল বাণীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণও নয়; কিন্তু এগুলোতে রবীন্দ্রনাথের সমাজ ও রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠছে l সাহিত্যই সময়ের ধারক ও বাহক একথা স্বীকার্য l
সেবছর পূজোর ছুটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে গিয়েছিলেন। শিলাইদহে তিনি লালনের বাউল সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন ও নিজে রবীন্দ্র বাউল সঙ্গীত রচনা করেছেন l ছুটির পর ফিরে শান্তিনিকেতনে একটানা পাঁচ মাস ছিলেন। এই সময় তিনি তাঁর বিখ্যাত শান্তিনিকেতন প্রবন্ধ গ্রন্থটি রচনা করেন। পরের বছর বর্ষা ও শরৎকালে তিনি কিছুদিন শিলাইদহে গিয়েছিলেন। ফিরে কিছুদিন কলকাতায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কাটান। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের কবিতা ও গানগুলো শিলাইদহ, শান্তিনিকেতন এবং কলকাতায় রচিত হয়। জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ এই সময় কঠোর নিরামিষাশী ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশ্রম পরিচালনার আদেশগুলি এই সময় তিনি কঠোরভাবে মেনে চলতেন। এমনকি অসুস্থতার সময় ডাক্তার আমিষ খাওয়ার পরামর্শ দিলেও, তিনি তা শোনেননি। সুইডিশ একাডেমির কর্তৃক প্রাপ্ত নোবেল পুরস্কার রবীন্দ্রনাথের কাছে নয় ভারতের কাছেও অত্যন্ত গর্বের l
আলোকিত হওয়া, আলোকিত করা বা এনলাইটেনমেণ্ট কি একটা শব্দ, নাকি এর অন্তর্নিহিত কোন তাৎপর্য আছে? এই প্রশ্নের উত্তর শব্দের ভিতরে খোঁজার থেকে সৃষ্টির অভ্যন্তরে খোঁজা সহজ হবে তাই নয় কি ?
কিছু মানুষ আছে যাদের জীবনাচার, তথা চিন্তা-কথা-কাজ ও পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে অন্য-আলোর স্বরূপ ধরা পড়তে পারে আমাদের অন্তঃদৃষ্টিতে।
প্রকৃতির লীলায় তিনি আঁকলেন সীমা ও অসীমের লীলা মরুময়, অসহায় মরীচিকা; রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, বিষাদ বেদনায় আমরা অসীমের মাঝে নিজেকে হারিয়ে মুক্তি পাই- এই অসীম, অনিশ্চিত, শূন্যতায় তার আনন্দলোক।
তাই তিনি লিখেছেন —
“আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে –” l