• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় সৌরিশ বন্দ্যোপাধ্যায়

রবি ও ভানুসিংহের পদাবলী

উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ,বাংলা সাহিত্যে সূচনা হতে চলেছিল নবজাগরণ , আর এসময়ের দুই শ্রেষ্ঠ কবি আকৃষ্ট হলেন এমন এক সাহিত্য রসধারায় যা প্রায় অবলুপ্ত হতে চলেছিল অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকেই ।
কিন্তু মনে হয় সাহিত্য রসের কোন দিনই মৃত্যু হয় না, আর তাই ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের স্বর্ণময় যুগের কৃতিত্বের অধিকারী বৈষ্ণব সাহিত্যের রসে প্রভাবিত হয়ে উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শ্রেষ্ঠ কবি মাইকেল মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের কবি কল্পনায় সৃষ্টি হয়ে গেল ব্রজাঙ্গনা কাব্য ও ভানুসিংহের পদাবলী ।
ভানুসিংহের পদাবলীর রচনা কাল যেহেতু সন্ধ্যা সংগীতেরও আগে তাই এটা সহজেই অনুমান করা যায় যে তখন রবীন্দ্র কাব্যের শৈশব অবস্থা। আর তাই এই সৃষ্টির পেছনে লুকিয়ে রয়েছে কিশোর মনের রোমাঞ্চ, চপলতা ও সৃষ্টির উত্তেজনা।
ঠাকুর বাড়িতে সবসময়ই সাহিত্য ও সংস্কৃতির আবহাওয়া থাকার সুবাদে ছোট্ট রবি খুব অল্প বয়স থেকেই সমকালীন সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের গুণী মানুষদের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। কোন কোন ক্ষেত্রে বেশ কিছু ব্যক্তিত্বের সাহিত্য কল্পের ছায়া ওনার মনে রেখা পাত করতে শুরু করে । রবির কৈশোর কালের এমনই দুই ব্যক্তিত্ব হলেন শ্রীযুক্ত অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র । ওনাদের প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ তথা বৈষ্ণব সাহিত্য সংগ্রহের প্রতিটি খণ্ড রবীন্দ্রনাথের চোদ্দ বছরের কিশোর মনে আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল । এই আগ্রহের বিশেষ দুটো কারণ ছিল ।
যার মধ্যে একটা , ব্রজবুলি ভাষার অর্ধপরিচিত রূপ , ছন্দ ঝংকার , ভাবোদ্দীপন- শক্তি , অনভ্যস্ত প্রকাশ ভঙ্গীর ও অর্ধ – অবাস্তব মায়ালোকের প্রতি । আর তাই এই ভাষা তার পক্ষে দুর্বোধ্য হলেও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি ডুব দিয়ে ছিলেন এর রস আস্বাদনের মধ্যে থেকে কাব্যরত্ন আবিষ্কারের নেশা ।
আর দ্বিতীয়টা নিজেকে দ্বিতীয় চ্যাটার্টন তৈরি করা । এক্ষেত্রে এই দ্বিতীয় চ্যাটার্টনের বিষয়টা একটু বলে রাখা দরকার ।
কিশোর রবি অক্ষয়বাবুর কাছে ইংরাজ বালক কবি চ্যাটার্টনের গল্প শুনে ছিলেন । এই কবি নাকি প্রাচীন কবিদের নকল করে এমন কবিতা লিখে ছিলেন যা অনেকেই ধরতে পারে নি । এই কবি মাত্র ষোলো বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন বটে, কিন্তু কিশোর রবির মনে এই আত্মহত্যার অংশটুকু বাদ দিয়ে বাকি অংশটুকু বেশ গভীর দাগ কাটে । , আর ঠিক সেই কারণে মন দিয়ে অনুশরণ করতে থকলেন ব্রজবুলির বাহ্য লক্ষণগুলো ।
এমনই এক দিন দুপুরে, যখন আকাশ ঘন মেঘে ছেয়ে রয়েছে , হাওয়ার গতি বেড়ে উঠেছে, তখনই মন ময়ূরীর আনন্দের ডাকে সাড়া দিয়ে একটা শ্লেট হাতে কিশোর রবি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন খাটে । লিখে ফেললেন ” গগন কুসুমকুঞ্জ মাঝে ” । এই লেখা শেষ হতেই মনের ময়ূর পেখম মেলে ধরল আনন্দে , ছুটে গিয়ে শোনাতে লাগলেন সকলকে এমন কি যার এ লেখা বোঝার বিন্দু মাত্র সম্ভবনা নেই সেও পর্যন্ত বাদ পড়ল না । কিন্তু আনন্দ স্থিতু হতেই মনে হতে লাগল তার অভিসন্ধিতে সে ঠিক কতটা সফল তা যাচাই করা দরকার । আর তাই তার থেকে বয়সে বড় কিন্তু মন মানসিকতায় যাকে বন্ধু মনে করেন দেখালেন সেই প্রবোধ চন্দ্র ঘোষ মহাশয় কে । তবে লেখাটি উপস্থাপন করেলেন অন্য ভাবে। বললেন ব্রাহ্মসমাজের একটা লাইব্রেরি খুঁজতে খুঁজতে বহুকালের এক জীর্ণ পুথি পাওয়া গেছে , যাতে ভানুসিংহ নামে কোন এক প্রাচীন কবির পদ আছে। সে লেখা কপি করে এনেছেন এই বলে লেখার গুণগত মান যাচাইয়ের ইচ্ছায় তাঁকে শোনাতে লাগলেন । প্রবোধ চন্দ্র মহাশয় শুনে ভারি উৎফুল্ল হলেন এবং বললেন বিদ্যাপতি , চণ্ডীদাসের পক্ষেও এমন লেখা সম্ভব নয় , তাই এই পুঁথি তার চাই । শুধু তাই নয় তিনি ঠিক করে ফেলেন যে এটি প্রাচীন কাব্য সংগ্রহের কারণে অক্ষয় বাবুকে ছাপার জন্য দেবেন । এ কথা শেষ হতেই কিশোর রবীন্দ্রনাথের মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল । তাই নিজের সৃষ্টির আনন্দ আর প্রকাশ না করে পারলেন না । নিজের খাতা দেখিয়ে প্রমাণ দিলেন এ লেখা অন্য কারো নয় , এ লেখা তার নিজের । যদিও এই কথায় প্রবোধ চন্দ্র মহাশয়ের মন ভেঙে গেল, আর নিজের কথার রেশমাত্র টেনে গম্ভীর মুখে বললেন
” নিতান্ত মন্দ নয় ” ।
” ভানুসিংহের পদাবলী ” রবীন্দ্রনাথের শৈশব কালের সৃষ্টি বলে এই সৃষ্টির বিভিন্ন অঙ্গে অনেক উৎকট অপপ্রয়োগ , ভাষাগত অসামঞ্জস্য ও অপটু হাতের ছাপ সুস্পষ্ট । আর এ কথা তিনি নিজে জানতেন।
তাই উনি নিজেই বলেন ” ইহা একটা কৃত্রিম ভাষা ; ভিন্ন ভিন্ন কবির হাতে ইহার কিছু না কিছু ভিন্নতা ঘটিয়াছে । কিন্তু তাঁহাদের ভাবের মধ্যে কৃত্রিমতা ছিল না । ভানুসিংহের কবিতা একটু বাজাইয়া বা কষিয়া দেখিলেই তাহার মেকি বাহির হইয়া পড়ে। তাহাতে আমাদের দিশি নহবতের প্রাণ – গলানো ঢালা সুর নাই , তাহা আজকালকার সস্তা আর্গিনের বিলাতি টুংটাংমাত্র । “
কবি কল্পনায় শৈশবের অপরিণত চিন্তার মধ্যেও বৈষ্ণব রসলীলাকে অবলম্বন করে যে ভাব ও সৌন্দর্যের প্রকাশ হয় তা আত্মস্ফুরনের এক অস্পষ্ট পথ রেখার সন্ধান দেয়। যার প্রভাব নানা বিচিত্র রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে ধরা পরে কবির মনন চিত্রে আর তাই বৈষ্ণবতত্ত্বকে, তিনি স্বীকার না করলেও বৈষ্ণব গীতির সুরের অনুরণন বা ভাব, তাঁর কবিতায় কোথাও সুস্পষ্ট আবার কোথাও অস্পষ্ট রূপে শোনা যায় । একথা বলা যেতেই পারে যে ” ভানুসিংহের পদাবলী ” রবীন্দ্রনাথের সাথে বৈষ্ণব পদাবলীর আত্মিক যোগাযোগের সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট তাৎপর্য পূর্ণ ।।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।