• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় আলোক মণ্ডল

আমি ও রবীন্দ্রনাথ

ডিসেম্বরের হিমশীতে আমার যখন ঘুম ভাঙল তোমার কণ্ঠই শুনেছিলাম রবীন্দ্রনাথ, তারপর কত রোদবৃষ্টিঝড়ে, ঘরে ও প্রান্তরে তোমার কণ্ঠ বেজে উঠেছে, আজও বাজছে।
সেই নবীন প্রত্যুষে আমি তোমাকে পেয়েছি শালবনে এক-পশলা বৃষ্টির পর সোনা রোদের ঝিলমিলে তখন তো আমি হাঁটি-পা, ছোট খোকা বলে অ-আ শেখেনি সে কথা কওয়া,আমাকে আবদুল চাচা এনে দিত কচ্ছপের ডিম,সুধা এনে দিত ফুল, আমি পাঠশালা গেলাম। তুমিই তো হাত ধরে নিয়ে গেলে,বললে,বনে থাকে বাঘ,গাছে থাকে পাখি।আমি দেখতে শিখলাম।অবাক চোখে দেখি, পথ চলে গেছে এঁকেবেঁকে পাহাড় পেরিয়ে আরও দূরে,দেখি ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি আছে আমাদের পাড়া খানি।সেই তখন থেকেই তুমি আমার সঙ্গী ছিলে, আমি পিছন ফিরে তাকাই নি। ঘাসে-ঘাসে পা ফেলে দেখেছি ছড়িয়ে আছে আনন্দরই গান আর অনন্ত বিস্ময়। প্রশ্নময় চোখে দেখতে ও জানতে চেয়েছি, কী করে এত ফুল আসে খালি ডালে,কী করে বিশ্বভরা প্রাণের এই ছন্দময় ঐক্যতান!
একটু-একটু করে যখন বড় হোলাম, কৈশোর এল ঝলমলিয়ে তখন অমল এল, ফটিক এল। ওদের সাথে নিয়ে ঘুড়ি ওড়ালাম মাঠের আলে-আড়ালে। তুমি তো চোখ খুলে দিলে, দেখালে, দারিদ্র্য, ক্ষেতমজুর পরিবার, তাদের অভাব লাঞ্ছিত পরিবারে ঝগড়াঝাটির মধ্যেও কত ভালোবাসা! দেখলাম,প্রকৃতির রঙ্গশালায় ঋতুরঙ্গ,ছায়া ঘনিয়ে আসা বন,শীতের সকালে ডালা ভর্তি ফসলের গান, কত কি! তুমি না থাকলে কৈশোরে কে শেখাতো অসাম্প্রদায়িক মনের হয়ে ওঠতে, হিন্দু নয় মুসলমান নয় আসলে সবাই মানুষ। মুসলমানী মেয়েরাও যে কত মানবিক কত হৃদয়বতী তা কি করে জানতাম! কী করে জানতাম সওগাত আসলে বস্তুর নিক্তিতে নেই, ভালবাসার মননে তার বাস! তুমিই তো শেখালে অযথা কুসংস্কারের বিধি নিয়ম ভেঙে ফেলে অচলায়তনে উদার উন্মুক্ত জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালাতে।এও বুঝলাম ভয় আসলে একটা মুখোশ, যতবার তাকে বিশ্বাস করেছি হয়েছে অনর্থ পরাজয়। হম্বিতম্বি,স্বৈরাচার কিংবা এনকাউন্টারের সাজানো গপ্প যতই থাক তার বিরুদ্ধে, মুহূর্তে তুলিয়া শির প্রতিবাদে ফেটে পড়েছি। কৈশোরে বিদ্যায়তনের সেই সাজানো স্টেজে কিংবা পাড়ার ক্লাবের অনুষ্ঠানে নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গের দিনগুলিতে অথবা সমবেত ভাবে আলো আমার আলোর শিহরণ জাগানো সুরময়তায় তুমিই তো সাথে ছিলে,চোখে ছিল তোমার আধমরা দের ঘা মেরে বাঁচানোর শপথ।সবুজের অভিযান ছিল তখন প্রাত্যহিক জীবনমন্ত্র।
প্রত্যুষে যে কণ্ঠ শুনে এতটা পথ পেরিয়ে এলাম যৌবনে সেই সুরই পথ চাওয়ার আনন্দ এনে দিল। বাতাসকে বলতে শিখলাম দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর,
ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।বুঝলাম, একটুকু কথা শোনার মাঝে একটুকু ছোঁওয়ার অনুভব।তখন চক্ষে আমার তৃষ্ণা, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে! বুঝলাম ফ্যাশানটা আসলে মুখোশ, স্টাইলটা হচ্ছে মুখশ্রী। তুমি ছাড়া এভাবে কে চেনাত কমল-হীরের পাথরটাকে বলে বিদ্যে আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে তাকেই বলে কালচার,সংস্কৃতি। এখন থেকে তোমার নাটক, উপন্যাস আর প্রবন্ধ হয়ে উঠল আমার জীবনসাথী। আমি- পোস্টার সাঁটতে শিখলাম দেয়ালে-দেয়ালে,উচ্চস্বরে দাবি করতে শিখলাম আপামর প্রজার পেটে চাল চাই,পড়াশোনার জন্য চাই ন্যুনতম কেরোসিন-খাতাকলম,আলো চাই, প্রাণ চাই, চাই মুক্ত বায়ু আর চাই আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু! তুমিই তো সাহস দিলে কেউ যদি না আসে সে ডাকে তবে একলা চলতে! পুঁজিবাদী রাষ্ট্র তার করুণ নিঃস্বতা,রক্তকরবীর প্রাণের চির জয়যাত্রা,স্ত্রীর পত্রে যে নারী স্বাধীনতার সূচনা গোরা কিংবা ঘরে বাইরে না পড়লে কি ভাবে যৌবনে গড়ে উঠত স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গী। তুমিই তো শেখালে এলার হাত ধরে কৃত্রিম রাজনীতির অসারতা। তুমিই তো প্রশ্ন করতে শেখালে যাহারা তোমার বিষায়েছে বায়ু নিভায়েছ তব আলো তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ তুমি কি বেসেছ ভালো?তুমি দেখালে ফ্যাসিবাদ কী, তার হিংস্র অমানবিকতা কত বীভৎস! দেখালে সেই সব ভণ্ড ভক্তের দলকে, ওই দলে-দলে ধার্মিক ভীরু চলে গীর্জায়,চাটুবাণী দিয়ে ভুলাইতে দেবতারে, তুমিই দেখালে রাশিয়ার চিঠিতে বিকল্প পথের দিশা। তাই প্রতিবাদে গর্জে উঠলাম যখন ফিদেল কাস্ত্রোর দেশ কিউবাকে গিলে খেতে চাইল সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা কিংবা চাচা হো’র দেশ ভিয়েতনামে চালাল মার্কিন ব্যাভিচার আমি তো তোমার কন্ঠে সুর মিলিয়ে উচ্চারণ করলাম ধিক্কার হানিতে পারি যেন তীব্র বীভৎসায়। আমার যৌবন গড়ে উঠল তোমার মননে আমি তোমারই সংগে বেঁধে নিলাম আমার প্রাণ। তাই প্রথম যৌবনে তোমাকে পেলাম গানের ভিতর দিয়ে কিন্তু আমার সুর গুলি পায় চরণ আমি পাই নে তোমারে।
প্রৌঢ়ত্বে এসে তোমাকে পেলাম আরও মনের গভীরে।আত্মপরিচয় ও শান্তিনিকেতনের প্রবন্ধগুলি আমার চোখ খুলে দিল, বুঝতে শিখলাম জীবন কী,জীবনের লক্ষ্য কি।জল তরঙ্গ একটু থিতু হলে যেমন জলে ভাসা পানাগুলির সবুজ শিরাগুলি স্পষ্ট হয়ে যায় তেমনি জীবনের দুলুনি এখন একটু স্থির,দেখতে পেলাম জীবনের সব লেনদেন। এ সময়েই নিজের মধ্যে একা হতে শিখছি, মন যেন চাইছে এক অজানাকে কাছে পেতে, সেই অজানা আসলে আনন্দময়। তার স্বরূপ কী,কি তার পরিচয়? তাকে না পাওয়ার একটা দুঃখবোধ প্রৌঢ়ত্বে আমাকে অস্থির করেছে বারবার। বলেছি,”আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে।আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে”!তাকে না-পাওয়ার একটা বেদনা বোধের চারপাশে স্থির মগ্ন হয়েছি, পাশাপাশি সমগ্র বিশ্বকে দেখছি নতুন মূল্যায়নে কালান্তর কিংবা মানুষের ধর্ম প্রবন্ধ গুলির নিক্তিতে,দেখেছি ভারতীয় সাহিত্যের গভীর ভাণ্ডার রবীন্দ্রনাথের প্রাচীন সাহিত্য লোক সাহিত্য ও সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধগুলির ভেতরে প্রত্ন খনন করে,চোখ রেখেছি মহাকাশে তাঁর বিশ্ব পরিচয় প্রবন্ধ পড়ে। জীবনস্মৃতি যখন পড়েছি তখন নিজেকে খুঁড়তে শিখেছি, জীবনের এই অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ আমাকে তৈরী করলেন এক নিমগ্ন পাঠকে এক আত্ম জিজ্ঞাসু মানুষে। ছিন্নপত্রে আমার মনে বহিয়ে দিল এক কাব্যিক স্রোতধারা আমার চোখ খুলে দিল নিরাসক্ত ভাবে প্রকৃতির মাঝে আনন্দকে খুঁজে নেওয়ার পথ অন্বেষণের।
বয়স বাড়ল,জীবন সূর্য ক্রমশ পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়ছে। তারুণ্যের সেই রঙ, যৌবনের উচ্ছলতা ক্রমে কমে এল। একটা নিরাসক্তি বোধ, একটা উদাসীনতা ছেয়ে দিল মনে ও প্রাণে শীতল ছায়া। সেই ছায়া তো তোমারই দেওয়া রবীন্দ্রনাথ, তোমার গীতবিতান নিয়তই তো আমাকে নিয়ে যায় সেই পরম শান্তির দিকে। প্রিয় বিচ্ছেদে মন যখন বিমর্ষ হয়েছে,বিষন্ন সন্ধ্যা যখন মনের আলো কে নিষ্প্রভ করেছে তখনই তো তুমি এসে গানে-গানে উজ্জীবিত করলে,বললে,আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে তবুও শান্তি,তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে!আবার জেগে উঠলাম খুঁজে পেলাম আনন্দময় সত্তাকে, আমি আত্মহারা হয়ে বলে উঠলাম, সাগর পারে কূল মিলেছে আমি তো আর নাই! আবার পিছনে ফিরেও দেখতে শিখলাম,ভাবলাম এই যে যৌবন-তারুণ্যে এতো চঞ্চলতা, এতো পরিক্রমা তাতে কি সব দেখা সব বোঝা শেষ হয়ে গেল, নাকি কিছু রয়ে গেল জানতে, কিছু রয়ে গেল বুঝতে! কেননা বিপুল এই পৃথিবীর কতটুকু জানি,বিশাল বিশ্বের আয়োজন আমার মনে জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তার এক কণা।তোমার আলোয় ভাবতে শিখছি জীবনের অপূর্ণতা কোথায়,কোথায় চটকদারিত্ব! বার্ধক্যের আত্মমগ্নতায় ভাবি এই জীবন আসলে কী, কি করে এল, কোথায় তার শেষ! শেষ কোথায় শেষ কোথায় কি আছে পথের শেষে! ভাবি খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়!আত্মধী হয়ে ভাবি এই যে আমি, বাজার করেছি,যাপনক্ষেত্রে গিয়ে হাজিরা খাতায় সই মেরেছি আর বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়েদের ধরে-ধরে নামতা শিখিয়েছি, যে আমি একটু আঘাতে ভেঙে পড়েছি চুরচুর, প্রতিবাদে গলার শিরা ফুলিয়েছি,বজ্রমুষ্টি তুলে সূর্য কে ছিঁড়ে আনতে চেয়েছি কিংবা কবিতা পাঠের আসরে দু’পা ফাঁক করে দৃপ্ত কন্ঠে কবিতা পড়েছি এই আমিই কি একমাত্র আমি! এই আমি কি আমার পরিচয়!আসলে আমি কে?প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিল কে তুমি, মেলেনি উত্তর। দিনের “শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম সাগরতীরে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-কে তুমি, মেলেনি উত্তর।” নিরুত্তর এক প্রশ্ন নিয়ে দোলাচল আমি। তবু রবীন্দ্রনাথই একমাত্র পথ প্রদর্শক,তাঁর অমোঘ উচ্চারণ জীবনের অজস্র প্রচুর ভাঁড়ার শেষ করে একদিন চলে যেতে হবে, আমৃত্যু দুঃখের তপস্যায় ভরা এ জীবন ছেড়ে হয়তো একদিন যেতে হবে ” সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে / মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ করে দিতে!” এভাবেই রবীন্দ্রনাথআমার জীবনবোধ গড়ে দিলেন।
জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের পরতে-পরতে তাই আমি ও রবীন্দ্রনাথ পাশাপাশি দুটি সত্তা, আসলে এক!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।