• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় সীমন্তি চ্যাটার্জি

কবিগুরুর পরলোকচর্চা

‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?’ মৃত্যু যে জীবনের শেষ নয় এই বোধ রবীন্দ্রনাথের গানেই তো পেয়েছিলাম আমরা। জীবন-মরণের সীমানায় দাঁড়িয়ে দুয়ারটুকু পার হতেই আমাদের যত সংশয়। আমরা জানি না কী আছে পথের শেষে। মরণের পরে আত্মারা কোথায় যায়, সে ভুবন কেমন- এই জিজ্ঞাসা আমাদের প্রত্যেকের। রবীন্দ্রনাথও তার ব্যাতিক্রম নন। অমিতাভ চৌধুরীর ‘রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা’ বইটি এক অন্য রবীন্দ্রনাথের খোঁজ দেয় আমাদের। সেই সঙ্গে আমাদের যুক্তি আর ভাবনার ভুবনকে নতুন ভাবে প্রশ্ন করে অস্তিত্বের নন্দনে।
-“ বহু দুঃখ, বহু শোক তাঁর ভিতর জমা ছিল। অশরীরী প্রিয়জনদের সঙ্গে কথাবার্তায় কখনও বেরিয়ে পড়েছে স্নেহশীল পিতার রূপ, কখনো বা স্ত্রীবিয়োগবিরহী স্বামীর ছবি। আবার দেখি কখনও তিনি প্রিয়শিষ্যবিচ্ছেদে শোকাছন্ন কবি, কখনও বা পরলোকগত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের কাছে রয়ে গেছেন সেই ‘ছোট রবি’। ”
বাংলায় প্ল্যানচেট করার ধারাটা এগিয়ে চলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির উৎসাহে৷ কিন্তু সেখানেও অকালমৃত্যু এসে সব তছনছ করে দেয়৷ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘ভারতী’ পত্রিকার আশ্বিন, ১৩০১ সংখ্যায়, প্ল্যানচেট করার জন্য এক আশ্চর্যজনক ভৌতিক যন্ত্রের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল— ‘নির্মাতা শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, ১০৮, আপার চিৎপুর রোড, গরাণহাটা,কলিকাতা, মূল্য আড়াই টাকা, প্যাকিং ও ডাকমাশুল বারো আনা’৷ রবীন্দ্রনাথ যন্ত্রটির বাংলা নামকরণ করেছিলেন— ‘প্রেতবাণীবহ চক্রযান’৷
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, এই যন্ত্রের সাহায্যে প্ল্যানচেট করে কবির সঙ্গে মাইকেল মধুসূদনের প্রথম আলাপ হয়েছিল। মধুসূদনের মৃত্যুর সময়ে রবীন্দ্রনাথের বয়স বারো বছর, সুতরাং সেই আলাপচারিতা তাঁর কৈশোরের অভিজ্ঞতা বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে কারণ সেই সময়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে নিয়মিত প্রেতচক্র বসতো এবং কিশোর কবিরও সেই চক্রে বসার স্বাধীনতা ছিল৷ কুড়ি-একুশ বছর বয়সেও তিনি প্ল্যানচেট করতেন, তার লিখিত প্রমাণ রয়েছে৷ কিন্তু সেই চক্রের আয়ুও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। কারণ, অন্যতম উদ্যোক্তা হেমেন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যু৷
অনেক বছর পরে, তখন তাঁর বয়স আটষট্টি বছর, রবীন্দ্রনাথ আবার পূর্ণ মনঃসংযোগ করে পরিণত প্রজ্ঞার আলোকে পরলোকচর্চায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন৷ ১৯২৯ সালের অক্টোবরের শেষে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয হয় প্রেতচর্চায় অলোকসামান্য ক্ষমতার অধিকারিণী এক তরুণীর৷ সে বছর পুজো দেরিতে পড়েছিল, শরতের শেষ, আশ্রম জনশূন্য, রবীন্দ্রনাথ একাই ছিলেন উত্তরায়ণ ভবনে৷ তাঁর অতিথি হয়ে শান্তিনিকেতনে পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথের পুরোনো বন্ধু ও তাঁর বহু কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক মোহিতচন্দ্র সেনের মেয়ে উমা দেবী৷ কয়েক দিনের মধ্যেই কবির কানে খবর গেল, উমা একাধারে কবি এবং ভাল মিডিয়াম৷
রবীন্দ্রনাথ উপনিষদ থেকে পেয়েছিলেন একটি তথ্য— এক ধরণের অতি-সংবেদনশীল মানুষ থাকেন, যাঁরা মৃত আত্মাদের আকর্ষণ করতে পারেন এবং তাদের সঙ্গে মরজগতের একটা যোগসূত্র স্থাপন করতে পারেন৷ আধুনিক প্রেততত্ত্বের ভাষায় এঁদের বলা হয় ‘মিডিয়াম’৷
উমাদেবীর ভাল মিডিয়াম হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে জানতে পেরে কবি খুবই আগ্রহী হয়ে নিয়মিত চক্রের আয়োজন করেন৷ তিনি প্রেতলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সরাসরি মিডিয়ামের সাহায্য নিয়ে শুরু করলেন প্ল্যানচেট৷ প্রেতচক্রের যাবতীয় নিয়ম ভঙ্গ করে রবীন্দ্রনাথ উমার মুখোমুখি বসে তাঁকে প্রশ্ন করতেন৷ মিডিয়ামের হাতে কাগজ পেন্সিল থাকতো, তিনি উত্তর শুনে দ্রুত কথাগুলি লিখে কবিকে দেখাতেন৷ তাঁকে লিখতে সাহায্য করেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী আর মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়৷ ঘরে আরও অনেকে উপস্থিত থাকতেন, কিন্তু প্রশ্ন শুধু কবিই করতেন৷ এই ভাবে আটটি ফুলস্কেপ কাগজের মোটামোটা খাতা ক’দিনে ভরে উঠেছিল৷
অক্টোবরের প্রারম্ভিক অধিবেশনগুলির কোন বিবরণ নেই, কিন্তু নভেম্বরে পর পর বেশ কয় দিন এবং ডিসেম্বরেও যে ক’দিন উমাদেবী শান্তিনিকেতনে ছিলেন, তাঁকে কেন্দ্র করে পুরোদস্তুর প্রেতচক্র বসেছিল, যার বিবরণী শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে পরম যত্নে সংগ্রহীত রয়েছে৷ কবির ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছিলেন তাঁর প্রায় সমস্ত প্রয়াত আত্মীয় ও বান্ধবকুল৷ এসেছিলেন মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ, নতুনদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, পত্নী মৃণালিনী, বড় মেয়ে মাধুরীলতা, ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ, প্রিয় ভাইপো বলেন্দ্রনাথ আর হিতেন্দ্রনাথ এবং তাঁর কাছের মানুষ সুকুমার রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, অজিত চক্রবর্তী, সন্তোষ মজুমদার, সতীশ রায় প্রমুখ ভক্তবৃন্দ৷
বারে বারে ডাকা সত্ত্বেও কখনোই আসেননি পিতা দেবেন্দ্রনাথ, মাতা সারদা দেবী, বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ও মেজ মেয়ে রেণুকা৷ যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা খোলাখুলি কবির প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এমনকী, ব্যক্তিগত ইচ্ছার কথাও বলেছেন৷ যেমন, সুকুমার রায় তাঁর একমাত্র পুত্রকে আশ্রমে রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ এছাড়া কী কথা হয়েছিল সুকুমারের সঙ্গে? রবীন্দ্রনাথ জানতে চান, ‘সুকুমার, কেমন আছ তুমি?’ সুকুমার বলেন, ‘অন্য কথা বলুন।’ রবীন্দ্রনাথ এরপর জিজ্ঞেস করেন, ‘পৃথিবীর সঙ্গে এখন তোমার যোগাযোগ আছে?’ সুকুমার উত্তর দেন, ‘নিশ্চয়ই, যোগাযোগ আছে।’ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আর কিছু বলো।’ সুকুমার বলেন, ‘আমার পৃথিবীর নেশা আজও কাটে নি। তাই পরলোকের কোনো সুর আজও মনে লাগে না।’
রবীন্দ্রনাথ নিজে স্ত্রী মৃণালিনীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বালবিধবা প্রতিমাদেবীর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে৷ আত্মপরিচয় না দিয়েও একজন বার বার এসে পড়েছেন, তিনি নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী৷ এই মহামিলনচক্রের কথোপোকথন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনে কোন সন্দেহ ছিল না যে, তাঁর প্রিয় মানুষেরাই তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে এসেছিলেন, যদিও তাঁর জীবিত নিকটজনেরা অনেকেই মৃত আত্মাদের চক্রে আসা সম্পর্কে ততটা নিঃসন্দেহ হতে পারেননি৷
এঁদেরই একজনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— “পৃথিবীতে কত কিছু তুমি জানো না, তাই বলে সে সব নেই? কতটুকু জানো? জানাটা এতটুকু, না জানাটাই অসীম৷ সেই এতটুকুর ওপর নির্ভর করে চোখ বন্ধ করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া চলে না….যে বিষয় প্রমাণও করা যায় না, অপ্রমাণও করা যায় না, সে সম্বন্ধে মন খোলা রাখাই উচিত ৷ যে কোন একদিকে ঝুঁকে পড়াটাই গোঁড়ামি৷”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।