“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় পায়েল চ্যাটার্জি
by
·
Published
· Updated
শ্রীচরণকমলেষু,
প্রিয় রবি ঠাকুর,
এইরকম একটা দিন যে আসবে , তুমি জানতে তাই না? তাইতো কত্ত বছর আগে বলে গিয়েছিলে , “ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে”। কিন্তু মানুষ শুনল কই বলো। আচ্ছা, তোমায় তুমি বলছি বলে রাগ কোরোনা। অনেকেই হয়তো ভাববে, কবিগুরু কে তুমি! এ কেমন ধ্যাষ্টামো! কিন্তু আপনি বললে যে বড় পর পর লাগে। তুমি তো আপন, খুব কাছের। আমিও তোমার মতই “সোজা ভাষায় বুঝি, যে আমায় বোঝে সে আপন, যে বোঝে না, সে পর। যার অনুপস্থিতি কষ্ট দেয় সে আপন, যার উপস্থিতিতেও কিছু আসে যায় না সে পর।আর তুমি ছাড়া আমায় এমন করে কে বোঝে বলো? তোমার উপস্থিতি? সে তো জীবনের প্রত্যেক অভিজ্ঞতায়। আমার সবটুকু দুঃখ জুড়ে, আনন্দময়তায়। কিন্তু তোমার উপস্থিতিতেও একটা বিরহ আছে, যাতে বিলীন থাকা যায়, বাস করা যায়। আমার কাছে তুমি ভালোবাসার ঠাকুর।
জানো আমরা রোজ দৌড়চ্ছি। গৃহবন্দী থাকার স্তব্ধতার মাঝেও ছুটে চলেছি। মৃত্যুর মাঠে আমরা জীবনের লড়াই করার জন্য ছুটছি। এক চিলতে আলো খুঁজছি। “হৃদয়হরা আলো”। আসলে জানো আমার মনে হয়, আমরা আজ নিজেদের করা অন্যায়ের ই শাস্তি পাচ্ছি।ভেবেছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে আমরা যা -ইচ্ছে -তাই করতে পারি। প্রকৃতি তো নির্বাক, আমরাতো সর্বশক্তিমান। তাই আমরা প্রকৃতির ঊর্ধ্বে। কিন্তু একটা আণুবীক্ষণিক বীজাণু সব চিন্তাভাবনাগুলো এলোমেলো করে দিয়েছে। কোন গৃহবাসী আর দ্বার খুলতে পারছেনা। কিন্তু মনের দরজা, সে তো খোলা রাখাই যায়। আমার মনের সেই সব দরজার হদিশ শুধু তুমি জানো। তবে আজ মন ভালো নেই। আমারও প্রকৃতিকে বলতে ইচ্ছে করছে তোমার মত করে “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ? তুমি কি বেসেছ ভালো?”না হলে এত মৃত্যু, শোক কেন! তাহলে প্রকৃতি আমাদের ক্ষমা করেনি বল! ভালোবাসেনি? তুমিই তো বলেছিলে “যদি তাকে ক্ষমা নাই করতে পারো, তাহলে তাকে ভালোবাসো কেন”,নাকি প্রকৃতি তার অপার স্নেহ দিয়ে আমাদের আগলে রাখতে চেয়েছিল, তার বুকে জায়গা দিয়েছিল, আমরা পারিনি তার সম্মান রাখতে? তোমার কথাই ঠিক “যে অভাব মানুষের সকলের চেয়ে বড়ো অভাব, সে প্রেমের অভাব”। আমরা প্রকৃতির ক্ষেত্রে আমাদের মনুষ্যত্বকে বাঁচাতে পারিনি।
জানো, আমরা কেউ ভালো নেই।আমরা প্রত্যেকে আমাদের ভাগ্যের বাতাসটাকে এতটাই দূষিত করে ফেলেছি যে, আজ ঝড়ের মুখে পড়েছি। আমাদের নৌকো গুলো আলাদা, কিন্তু ঝড়টা একটাই। তবে এই ঝড়ে আমার খড়কুটো তুমি। তোমার গান, গল্প, উপন্যাস সব আমার আশ্রয়। তোমার গান ই গাইছি এখন “বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা। বিপদে আমি না যেন করি ভয়।”কিন্তু ভয় তো পাচ্ছি আমরা। কতদিন শান্তিতে ঘুমোইনি। শান্তির ঘুম ব্যাপারটা কেমন যেন দুর্লভ হয়ে গেছে আজকাল। আর সেই দুর্লভতার প্রতি আমাদের মোহ। জানো, কত কত অমিত -লাবন্যর দেখা হয় না। বিরহে কাতর বিশু পাগলরা। কষ্ট পাচ্ছে গাছের ছায়ারাও। ওরা বলছে”সুন্দরী ছায়ার পানে তরু চেয়ে থাকে-সে তার আপন, তবু পায়না তাহাকে।”
কবে মুক্তি পাব বলোতো আমরা? শহরের সব কোলাহলেরা অপেক্ষা করে আছে। কত অমলেরা দইওয়ালার অপেক্ষায়। কথা দিচ্ছি আর কষ্ট দেব না পৃথিবীকে। লোভ, হিংসা ত্যাগ করে অগ্নিস্নানে শুচি করব ধরাকে। নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে বলো।এক শান্ত দিনে কোলাহলের মাঝে সব ভালোবাসা-বাসিরা তোমার কথা ধার করে বলবে “দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর। ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।”