• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় মানস চক্রবর্ত্তী 

একটি রবীন্দ্র জয়ন্তী 

গ্রামে প্রাইমারী স্কুলের স্যার বাবাকে বলেছিলেন ,

‘ পরেশ মেয়েটাকে গান শেখা , গানটা ওর আসে । ‘

বাবা কোনো উত্তর দেয়নি । শুধু

হ্যাঁ সূচক ভাবে ঘাড়টা নেড়েছিল ।

স্যার দিদিকে কী বুঝিয়েছিল কে জানে ;

দিদি প্রায়ই বায়না করত

হারমোনিয়াম কিনে দেওয়ার জন্য

বাবা হেঁসে বলতেন : কিনে দেবো রে মা ।

তারপর অনেকগুলি পঁচিশে বৈশাখ আর

বাইশে শ্রাবণ পেরিয়ে গেল

একদিন দিদি খুব গো ধরল

কেন , কে জানে, বাবার মেজাজ সেদিন চড়ে গেল

দিদির গালে সপাটে এক চড় ,

দিদিকে আর কোনোদিন বায়না করতে দেখিনি ।

 

আমার মা বরিশালের মেয়ে

দাঙ্গার সময় উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসেছিল

কিছুই আনতে পারেনি , কেবল

একখানা গানের খাতা ছাড়া ।

শুনেছি দাদু নাকি ভালো এসরাজ বাজাতেন

রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত ছিল

এ সব অবশ্য মায়ের কাছেই শোনা

মা যে গান জানতেন সেটা কোনোদিনও

আমাদের কাছে বলেনি ,

দিদিই প্রথম আবিষ্কার করেছিল  ।

একদিন ঝড়ের রাতে মা গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠেছিল

‘ যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে …’

দিদি চেঁচিয়ে  উঠেছিল , ‘ মা তুমি গান জান ? ‘

মা দিদির মুখ চেপে ধরেছিল

তোর বাবাকে বলিস না যেন ,

উনি রাগ করবেন ।

বাবা গান বাজনা খুব একটা পছন্দ করত না ।

গান যে বাবা কেন পছন্দ করত না

তার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা আমি আজও জানি না

হয়তো  অভাবের জন্য স্বভাবটা একটু রঙচটা হয়েছিল ,

অবশ্য এই নিয়ে মায়ের কোনো অভিযোগ ছিল কিনা

জানি না , থাকলেও  তা প্রকাশ করেনি ।

 

আমাদের বাড়িতে ঢাউস মার্কা  একটি

রেড়িও ছিল ,ওটা ঠাকুরদার সম্পত্তি ,

উত্তরাধিকার সূত্রে বাবা পেয়েছিল ।

কারখানা থেকে ফিরে রাত আটটার  খবর শুনত

মা দুপুরে শুনত মহিলা মহল , আর টুকুটাকি অনুষ্ঠান ;

সত্যি কথা বলতে কী রেড়িওর ওই ক’টা অনুষ্ঠাই

মায়ের বাঁচার অবলম্বন ছিল ।

 

আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন হতো

মূল উদ্যোক্তা মা

বাবা কাজে বেরিয়ে গেলে

মা কাপড় রাখার ট্যাঙ্ক থেকে গুরুদেবের ফটোটা বের করে

একটা জলচৌকির উপর রাখত ।

আমি ফুল নিয়ে আসতাম

দিদি বাটত চন্দন

মা সুন্দর করে গুরুদেবকে সাজাতেন , মালা পরাতেন ।

একটা আসনে বসে গাইতেন –

‘হেঁ নূতন

দেখা দিক আর-বার

জন্মের প্রথম শুভক্ষণ । ‘

আমি আবৃত্তি করতাম ।

দিদি কিছু বলত না , মা বললেও না ।

 

সেবার পাড়াতে পঁচিশে বৈশাখের প্রস্তুতি চলছে

অন্য বারের চাইতে জমকটা এবার একটু বেশি

অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি এবার নিমন্ত্রিত

সুলেখা দির কাছে আমি ক’দিন

বীরপুরুষ আবৃত্তিটা দেখে নিলাম ।

অনুষ্ঠানের দিন দিদি বাড়ির বাইরে বের হল না ।

সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরেই

আমি চেঁচিয়ে শুরু করে দিলাম –

‘ সন্ধ্যে হলো , সূর্য নামে পাটে

এলেম যেন জোড়া দীঘির মাঠে ।

ধু ধু করে যেদিক পানে চাই  ,

কোনোখানে জনমানব নাই ।

তুমি যেন আপন মনে তাই  – ‘

‘ মা দিদি কোথায় গো ? ‘

উত্তরের অপেক্ষা না করে

এক দৌড়ে দক্ষিণের বারান্দা ডিঙিয়ে

বীরপুরুষের মতোই দিদির ঘরে ।

‘ তুই আজ গেলি না দিদি ,

দারুণ হলো । আমি বীরপুরুষ আবৃত্তি করলাম ।

সুলেখাদি অনেকবার তোর খোঁজ করেছিল ।

তুই কেন গেলি না দিদি ?

গেলে খুব মজা হতো ।

বনানীদি মায়ের গানটা গাইল  –

হে নূতন দেখা দিক আর-বার  । ‘

দিদি কোনো কথা বলছে না দেখে বললাম ,

‘ কিরে আমার উপর রাগ করেছিস ? ‘

‘ না । তুই এখন যা ,আমার মন ভালো নেই  । ‘

আমার আনন্দটা কেমন যেন দমে গেল ।

গুটিসুটি মেরে মায়ের কাছে এসে বসলাম ।

মা রুটি করছিল ।

‘ জানো মা দিদি আমার সঙ্গে

ভালো করে কথাই বলল না । ‘

এমন সময় দরজা ঠেলে বাবা ঢুকল ।

হাতে বড়ো মতো কি একটা

আলোতে আসতেই দেখা গেল – হারমোনিয়াম ।

আমি সুখবরটা দিতে এক দৌড়ে দিদির কাছে

দেখি ঘরটা প্রায় অন্ধকার

প্রদীপের আলোটাও নিভু নিভু

দিদি মেঝেতে শুয়ে আছে ।

‘ দিদি । দিদি । ‘ দুবার ডাকলাম

কোনো উত্তর নাই

আমি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম – ‘ মা ‘ ।

মা দৌড়ে এল

‘ কী রে ,  কী হলো ? ‘

‘ মা দেখো , দিদি কথা বলছে না । ‘

মা গায়ে হাত দিয়ে কি বুঝল কে জানে !

আমাকে বলল : হারমোনিয়ামটা নিয়ে আয় ।

মা আসনটা পেতে বসল

হারমোনিয়ামটা কাছে টেনে নিয়ে গাইল –

‘ আছে দুঃখ , আছে মৃত্যু , বিরহ দহন লাগে

তবুও শান্তি , তবু আনন্দ , তবু অনন্ত জাগে । ‘
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *