“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
by
·
Published
· Updated
আমার দিনকর
রাতের নক্ষত্ররা যতই অতিকায় হোক না কেন আমাদের চোখে ক্ষুদ্র। পুঁচকে চাঁদেরও ষোল কলা যৌবনের আলো তারকাদের ম্লান করে দেয়। তার কারণ তারাগুলো বড্ড বেশি দূরে, এতটাই দূরে যে সেখান থেকে আলো আমাদের চোখে এসে পৌঁছতে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয়। সেই মিটমিটে আলো আমাদের বিশেষ কোনও কাজেও লাগাতে পারি না এক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা ছাড়া। কিন্তু দিনের নক্ষত্র সূর্য? সে আমাদের খুব কাছের প্রতিবেশী। তার আলোয় চরাচর দৃশ্যমান হয়, জীবকূল জেগে ওঠে, হয়ত বা দহন জ্বালাও আছে; তবু প্রাণের স্পন্দন সচল রাখতে দিনমণি অপরিহার্য।
সাহিত্যের আকাশেও রয়েছে অনেক অনেক নক্ষত্র। তাঁদের প্রতিভার পরিমাপ কতটা তার চেয়েও জরুরি প্রশ্ন – তাঁরা আমাদের কতটা কাছের, কতটা জড়িয়ে রয়েছেন আমাদের নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে? তাঁদের অনেকেই হয়ত গল্প উপন্যাসে আরও নিবিড়ভাবে আমাদের যাপনচিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারেন, কিন্তু এই সূর্য নিজের গানের মাধ্যমে আমাদের সকাল সন্ধ্যা যেমন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছেন তেমন ভাবে জড়িয়ে থাকেন কি? পশ্চিমবঙ্গে এমন শহর কম আছে. যেখানে রবীন্দ্র ‘সদন’ বা ‘ভবন’ জাতীয় নামের কোনও অনুষ্ঠান গৃহ নেই। ২৫শে বৈশাখ বিশেষ করে কবির জন্মদিন পালন হলেও সারা বছরে এমন কোনও বাংলা সাহিত্য বাসর হয় না যেখানে রবীন্দ্রনাথের নাম একবারও উল্লিখিত হয় না। সেইসব অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সঙ্গীতেও অধিকাংশত রবীন্দ্রসঙ্গীত আর তাঁর জন্মতিথিতে তো গঙ্গা জলেই গঙ্গা পুজো প্রথাসিদ্ধ ব্যাপার।
রবীন্দ্রনাথ প্রতিভাতেও সুপারনোভা আবার খুব কাছের মানুষও। তাঁর বেশ কিছু গদ্যে হয়ত অন্তরঙ্গতার চেয়ে আভিজাত্যই বেশি। কোথাও বা বাস্তব সাদামাটা জীবনের প্রতিচ্ছবি আঁকার চেয়ে জীবন দর্শন বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু কাব্যে-গীতিতে তিনি আমাদের বড়ই আপনজন। রবি ঠাকুরের কবিতাকেও যদি সেই যুগের শক্তিশালী মুদ্রা বলা যায় যা আধুনিক কালে আর অনুসরণীয় নয়, গানকে তবে বলতে হয় মোহর যার মূল্য সময়ের সঙ্গে কমে যায়নি বরং বেড়েই চলেছে। একটা ব্যাপার বোঝা শক্ত – বিশ্বভারতীর কপিরাইট উঠে গেছে বলেই ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’কে রাতারাতি নাম বদলে ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ হয়ে যেতে হবে! নজরুলগীতির বেলা এমন বাই ওঠেনি তো। বাংলার বিভিন্ন সাঙ্গীতিক ঘরানার অন্যতম হল রবীন্দ্রসঙ্গীত, যা কোনও সময় আধুনিকতার সাক্ষ্য বহন করে থাকলেও ক্রমশ এক ঐতিহ্যে রূপান্তরিত। ঘরানার নাম পাল্টালে সেই ঐতিহ্যকেই অস্বীকার করা হয়। আসলে নানা ধরণের সাঙ্গীতিক পরীক্ষা নিরীক্ষার কবল থেকে রবি ঠাকুরের গানও রেহাই পায়নি। রবীন্দ্রসঙ্গীত বললে তা তার নিজস্ব শৈলীতেই অভিব্যক্ত, পরীক্ষাগারের গিনিপিগ হিসাবে নয়। মূল স্বরলিপি মোটামুটি অনুসৃত হলেও সেখানেও নানা ধরণের সরলীকরণ বা ওস্তাদিকরণের অবকাশ তৈরি হচ্ছে। কোন দিন হয়তো শুনব সঙ্গীতকার ‘অমুক’ এবং গীতিকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শার্ধোশতবর্ষের পর দ্বিশতবর্ষের আগেই হয়ত আমাদের জন্য সেই চমকও অপেক্ষা করছে।
ছোটবেলা থেকে রেডিও ও স্কুল কি পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সৌজন্যে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে পুজোআর্চার মতোই বাঙালীর নিত্য কর্তব্যের অঙ্গ বলে জেনে এসেছি। এক প্রকার সংস্কারই বলা যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত যে শোনে না, তার নিজের তো বটেই বাড়ির শিক্ষাদীক্ষা নিয়েও যেন প্রশ্ন উঠে যেত। আমি নিজে গানে লবডঙ্কা হলেও রবীন্দ্রনৃত্যে অংশগ্রহণের দৌলতে বেশ কিছু গান কন্ঠস্থ করে ফেলেছিলাম। শুধু নাচা নয়, আজকের ভাষায় বেশ কিছু অনুষ্ঠানের কোরিওগ্রাফিও করেছি ছাত্রীকালে। রবীবন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে বাধ্যতামূলক ও সংস্কারমূলক সংস্রবে সম্পৃক্ত হওয়ার পর একটা বয়স থেকে ঝুঁকি আধুনিক হিন্দী ও বাংলা মূলত রাগাশ্রয়ী গানগুলোর দিকে। সত্যি কথা বলতে কী, একই গান বারবার ভিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে শুনে নতুন কিছু পাই না। বিশেষত কিছু প্রাতঃস্মরণীয়া বা প্রাতঃস্মরণীয়র কণ্ঠে অমর হয়ে থাকা শৈশবের স্মৃতি নিত্যনতুন কণ্ঠের মন্থনে যেন কখনও কখনও একটু আহতই হয়। তবে ধ্রূপদী আঙ্গিক নিয়ে যতই বিতর্কিত পরীক্ষা নিরীক্ষা থাক, রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি এখনও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক করে রেখে দিয়েছে। বিশ্বভারতীর কপি রাইট উঠে যাওয়ার পর রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে অসংখ্য এক্সপেরিমেন্ট অধিকাংশই বেয়াদপি মনে হলেও এটাও তো ঠিক, এত বছর পরেও গানগুলো এতটাই প্রাসঙ্গিক যে আধুনিকতম বাংলা ব্যান্ডেও তাদের অবাধ বিচরণ। নিজের বাঁধা গানে বোধহয় কবি আরও দেড় শত বছর পরেও বাঙালির কাছে বাঁধা পড়ে থাকবেন।
তবে এই পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্যায়ে অধুনা ইউটিউবে অশ্লীল ভিডিও করে নাম কেনা জনৈক ইতরের অসভ্যতা বিবেচনাতেই আসে না। ঐ আচরণ উদ্দেশ্য শুধু এক মনীষীকে অসম্মান করা নয়, বাংলার সাংস্কৃতিক চেতনাকে নষ্ট করে যুবসমাজকে উচ্ছন্নে পাঠানোর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র রচনা। সে প্রসঙ্গে বিশদে যেতে চাই না। তবে প্রসঙ্গ যেহেতু ‘রবীন্দ্রনাথ ও আমি’, তাই ক্ষোভ গোপন করতে পারলাম না।
শেষ করার আগে আবার ফিরি গদ্যে। কিছু কিছু উপন্যাসে যে মণীষা আমার কাছে কিছুটা পোষাকী অধরা, তাঁকে নিবিড়ভাবে পাই ছোটগল্পগুলোতে। তালিকা দিয়ে লেখা দীর্ঘ করতে চাই না। তবে এটাও ঠিক আমার প্রিয় উপন্যাসগুলির একটি হল যোগাযোগ। গোরা, বিহারী, সন্দীপদের ক্যারিশমা কিংবা বিনোদিনীর কূহকিনী মায়ার মাঝে কুমুদিনীর চরিত্রটি মনে কেন দাগ কাটে পরে বলছি। মনোমতোভাবে বাঁচতে না পারার অতৃপ্তি নিয়ে সমঝোতা।
একটি কথা সভয়ে জানাই, রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা নারী স্বাধীনতার প্রবক্তা মনে করেন, তাদের সঙ্গে আমার মতের মিল হবে না কোনওদিনও। ‘স্ত্রীর পত্র’-এর বিদ্রোহী দৃঢ়চেতা মৃণাল কিংবা ‘নষ্ট নীড়’-এর দেবরের প্রতি অনুরক্ত চারুবালা – কেউই কিন্তু নিজের অবস্থান যে স্বামীর চরণকমল, মনে রাখতে ভোলেনি। চারু অমলের প্রতি দুর্বলতা মন থেকে মোছার আপ্রাণ চেষ্টায় জীবনসঙ্গী ভূপতির উচ্ছিষ্ট পাতে খেয়ে, চরণধূলি সীমান্তে লাগিয়ে যেন প্রায়শ্চিত্ত করছিল। প্রায়শ্চিত্ত হলেও বুঝতাম, সেটা যেন ছিল স্ত্রীর শুদ্ধিকরণ। যোগাযোগ উপন্যাসে কুমুদিনীর বর মধুসূদনের সঙ্গে অবৈধ প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল তার বড়ো বৌদির। এক রাতে দেখা যায় সেই বৌদি সম্পর্কে গুরুজন হয়েও মাটিতে পড়ে বিবাহিত দেবরের পা জড়িয়ে ধরেছে। রবি ঠাকুরের রচনায় কখনই স্ত্রীর উচ্ছিষ্ট স্বামী বা প্রেমিক পুরুষকে গ্রহণ করতে দেখা যায়নি, পায়ে ধরতেও নয় (ব্যতিক্রম থাকলেও আমার চোখে পড়েনি)। ওদিকে ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের যে সন্দীপ তার প্রেমিকা বিমলা বৌঠানকে দেশের কাজে প্রাণীত করার সময় প্রণাম করে বিমোহিত করে দেয়, সে কিন্তু লেখক বা পাঠক উভয়ের চোখেই প্রবঞ্চক ও নিন্দিত। নারীকেন্দ্রিক কাহিনী পাঠককে আকর্ষণ করলেও সমাজ মনস্তত্ত্বের পরতে পরতে যে পুরুষতান্ত্রিক ক্লেদ জমে আছে, তাতে আধুনিকা কেটি রায়রা মূর্তিমান অপসংস্কৃতি, মৃণালরা বিদ্রোহিনী ন্যায়পরায়ণা হয়েও স্বামীর চরণকমলের দাসী, চারুবালারা পরপুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই স্বামীর উচ্ছিষ্টভোজী, বিনোদিনীরা সর্বগুণসম্পন্না হয়েও মায়াবিনী ঘর ভাঙানিয়া আর ‘দেহী পদপল্লব মুদারং’ ভঙ্গিতে নারীর বন্দনা করা পুরুষটি তঞ্চক লেডি কীলার থেকে যায়। এই প্রেক্ষিতে তাই যোগাযোগের কুমুদিনীর আপোশটাই বাস্তব বলে মনে গেঁথে আছে।
ব্যক্তিগত জীবনেও বিশ্বকবি শিক্ষিতা মেধাবী নারী পছন্দ করতেন তাঁদের মননে রাজত্ব করবেন বলে। তিনি মেয়েদের মনন চর্চা একটা সীমার বেশি অনুমোদন করতেন বলে মনে হয় না। যদিও ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সাহিত্য ও শিল্প চর্চা এবং তৎসহ সমাজসেবা সেই যুগের নিরিখে তো বটেই, বিভিন্ন অভিজাত পারিবারিক ইতিহাস ঘাঁটলেও খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল; তবে কবিগুরুর কাছে সম্ভবত নারীর প্রার্থীত ভূমিকা ছিল অনুপ্রেরণাদাত্রীর। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজেও তাঁর গুণমুগ্ধা নতুন বৌঠান কাদম্বরীদেবী যতটা প্রসিদ্ধি পেয়েছেন, তাঁর নিজের বিদুষী বাংলাভাষার প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার, গীতিকার, সমাজ সংস্কারক দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী তার সিকিভাগও আলোচিত নন। বরং শোনা যায় ১৯৯৮ সালে স্বর্ণকুমারীদেবীর অষ্টম প্রকাশিত উপন্যাস ‘কাহাকে’ ব্রিটেনের এক প্রকাশনা থেকে ঐ বছরই ইংরেজীতে অনুদিত হয়ে The Unfinished Song (1898) নামে বিলেতে প্রকাশ পাওয়ার পর পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হলে, রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করে চিঠিচাপাটি পর্যন্ত করেছিলেন এই মর্মে, যে প্রতিভার চেয়ে উচ্চাশা বেশি। যেহেতু ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা, তাই হাতের কাছে তথ্যসূত্র মজুত নেই। এজন্য আমাকে জবাবদিহি চেয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই পারেন। তবে ঘটনাটা অনেক গবেষকেরই জানা এবং পড়েছিলাম তেমন একটি বিশ্বস্ত সূত্র থেকেই।
তবু অশান্ত সময়ে প্রতিনিয়ত অশান্তি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিনযাপন করতে গিয়ে দিনের শেষে এতটুকু স্নিগ্ধতার জন্য দিনকর রবির তেজেই ছায়া খুঁজতে হয়। “আধেক ঘুমে নয়ন চুমে স্বপন দিয়ে যায়/ শ্রান্ত ভালে যুথিরও মালে পরশে মৃদু বায়….”